শুক্রবার, ৮ মার্চ, ২০২৪ ০০:০০ টা

পেশাগত সাফল্যে ঈর্ষণীয় নারী

♦ সরকারি-বেসরকারি চাকরিতে ইতিবাচক অবস্থান ♦ শ্রমজীবী হিসেবে পরিশ্রমে পুরুষের সঙ্গে পাল্লা ♦ উদ্যোক্তা হিসেবে বাড়ছে পরিধি

জিন্নাতুন নূর

পেশাগত সাফল্যে ঈর্ষণীয় নারী

ঘরে-বাইরে সমান্তরালভাবে পাল্লা দিচ্ছে নারী। বাংলাদেশে পেশাগত সাফল্যে নারীর অবস্থান শীর্ষে। প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষক থেকে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক হিসেবে নারীরা ভালো করছেন। গাড়ির চালক থেকে শুরু করে প্লেনের পাইলট এবং বাড়ির আয়া থেকে শুরু করে হাসপাতালের নার্স, ধান কাটার শ্রমিক থেকে শুরু করে স্থাপনা নির্মাণে জড়িত নারী শ্রমিক সবাই কর্মক্ষেত্রে নিজ যোগ্যতা ও দক্ষতার পরিচয় দিয়ে যাচ্ছেন। এ অবস্থায় আজ বিশ্বের সঙ্গে তাল মিলিয়ে দেশেও উদযাপিত হচ্ছে আন্তর্জাতিক নারী দিবস। এবার দিবসটির প্রতিপাদ্য, ‘নারীর সমঅধিকার, সমসুযোগ এগিয়ে নিতে হোক বিনিয়োগ’।

দেশে সচিব, ডিসি ও ইউএনওসহ প্রশাসনের সবস্তরে নারীর অবস্থান শক্ত হচ্ছে। আবার বেসরকারি চাকরিজীবীদের ক্ষেত্রে নারীরা আগের থেকে তাদের মেধা ও যোগ্যতা প্রমাণের সুযোগ বেশি পাচ্ছেন। বিভিন্ন বহুজাতিক কোম্পানি, বেসরকারি ব্যাংকে নারীর শক্তিশালী অবস্থান দেখা যাচ্ছে। ব্যাংকিং খাতের সমতাবিষয়ক বাংলাদেশ ব্যাংকের ষান্মাসিক প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়, ব্যাংকিং খাতে নারীকর্মীর সংখ্যা ক্রমেই বাড়ছে। বিশেষ করে ব্যাংকে মধ্যম ও উচ্চপর্যায়ের তুলনায় প্রারম্ভিক পর্যায়ে নারী কর্মীদের সংখ্যা বেশি।

চ্যালেঞ্জিং পেশাগুলোতেও নারীর অংশগ্রহণ আগের চেয়ে বাড়ছে। নারীরা এখন শুধু পেশাগতভাবেই যে প্রাইভেট গাড়ি চালাচ্ছেন তা নয়, কেউ কেউ নিজেই ব্যক্তিগত গাড়ি চালাচ্ছেন। আবার কেউ কেউ বাণিজ্যিক জাহাজে নাবিক ও রেলপথ এবং মেট্রোরেলের চালক হিসেবেও দায়িত্ব পেয়েছেন। আছেন প্লেনের পাইলটও। আজ ৮ মার্চ বিশ্ব নারী দিবসে বিশেষ ফ্লাইট পরিচালনা করবে বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইনস। এই ফ্লাইটটির পাইলট থেকে শুরু করে গ্রাউন্ড স্টাফ সবাই থাকবেন নারী। জানা যায়, রাষ্ট্রীয় এই বিমান সংস্থার রয়েছে মোট ১৫ জন নারী পাইলট। এ ছাড়া আছে ৩৪৫ জন নারী কেবিন ক্রু। বাংলাদেশ হিউম্যান রাইটস ফাউন্ডেশনের চেয়ারপারসন অ্যাডভোকেট এলিনা খান বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, নারীদের এই এগিয়ে যাওয়ায় এবং তাদের সাফল্যে আমরা আনন্দিত। নারীরা চ্যালেঞ্জিং খাতগুলোতেও যেভাবে এগিয়ে যাচ্ছে তাতে আমরা গর্ববোধ করছি। নারীরা যদি যথাযথ পৃষ্ঠপোষকতা পায় তাহলে তারা আরও এগিয়ে যাবে। প্রত্যন্ত অঞ্চলের অনেক নারী আছেন মেধা থাকা সত্ত্বেও তারা এগিয়ে আসতে পারছেন না। এ জায়গায় নারীদের সহযোগিতা করতে রাষ্ট্রকে এগিয়ে আসতে হবে। আবার নারীরা সাফল্য পেলেও অনেক ক্ষেত্রে বৈষম্যের শিকার হয়। আমাদের নারী ক্রিকেটাররা প্রত্যন্ত অঞ্চল থেকে অনেক কষ্ট করে আজকের অবস্থায় পৌঁছেছে। কিন্তু নারীরা ক্রিকেটে যেভাবে সাফল্য দেখিয়েছে পুরুষ ক্রিকেটারদের সঙ্গে তুলনা করলে রাষ্ট্রের কাছ থেকে তারা সেভাবে সহযোগিতা পায়নি।

সংশ্লিষ্টরা বলছেন, নারীর নেতৃত্ব ও সাফল্যে বিশ্বে নতুন বার্তা দিচ্ছে বাংলাদেশ। নারীর এই সাফল্য দক্ষিণ এশিয়াসহ বিশ্বের বিভিন্ন দেশের জন্য ঈর্ষণীয়। নারীরা পুরুষের সঙ্গে সমানতালে অফিস-আদালত ও ব্যবসা-বাণিজ্য সামলে নিজের ঘর-পরিবারের দেখভাল করছেন। কর্মক্ষেত্রের পাশাপাশি নিজ পরিবারেও গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষেত্রে মুখ্য ভূমিকা রাখছেন। বিভিন্ন প্রতিবেদন এবং বিশ্বনেতাদের দৃষ্টিতে বাংলাদেশ নারীর ক্ষমতায়নে বিশ্বে এখন রোল মডেল। সারা দেশে ৫ হাজারের বেশি ডিজিটাল সেন্টার স্থাপিত হয়েছে, যেখানে অর্ধেকেরও বেশি সংখ্যক নারীকর্মী কাজ করছেন। দেশের অর্থনীতিতে এখন নারীদের অবদান জিডিপির ২০ শতাংশের বেশি। শ্রমবাজারে দু-তিন দশক ধরে নারীর অংশগ্রহণ বাড়ছে। যা বর্তমানে দাঁড়িয়েছে ৪২ দশমিক ৮৫ শতাংশ। দেশের সেবা খাতেও কর্মরতদের মধ্যে ৭০ শতাংশই নারী। এ ছাড়া গুরুত্বপূর্ণ বিভিন্ন দায়িত্বে নারীরা সফলভাবে কাজ করে যাচ্ছেন। এর মধ্যে আছে বিচারপতি, ডেপুটি গভর্নর, উপাচার্যসহ গুরুত্বপূর্ণ পদ। ইতোমধ্যে নেতৃত্বের দৃঢ়তায় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা নারীর ক্ষমতায়নের জন্য ইনস্টিটিউট অব সাউথ এশিয়ান উইমেন কর্তৃক ‘লাইফটাইম কন্ট্রিবিউশন ফর উইমেন এমপাওয়ারমেন্ট অ্যাওয়ার্ড’, বাংলাদেশে নারী শিক্ষা ও উদ্যোক্তা তৈরিতে নেতৃত্ব দানের জন্য ‘গ্লোবাল উইমেনস লিডারশিপ অ্যাওয়ার্ড’, নারীর ক্ষমতায়নে অবদান রাখার জন্য তিনি ইউএন উইমেন ‘এজেন্ট অব চেঞ্জ’ পুরস্কার ও ‘প্লানেট ৫০-৫০ চ্যাম্পিয়ন’ পুরস্কারে ভূষিত হন। দেশে জাতীয় সংসদের স্পিকারও নারী। এ ছাড়া সশস্ত্র বাহিনীসহ প্রায় সব পেশায় ঊর্ধ্বতন দায়িত্বশীল পর্যায়ে এবং ঝুঁকিপূর্ণ অবস্থানে নারীর অংশগ্রহণ বেড়েছে। কৃষি খাত ও শিল্পশ্রমে ক্রমেই নারীর ভূমিকা গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠছে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার মতে, নারীদের উন্নয়নে দ্রুত এগিয়ে যাওয়া এবং নারীর স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিতকরণে বাংলাদেশ প্রশংসার দাবিদার। নারীরা নিজেদের শিক্ষা, মেধা আর সৃজনশীলতাকে কাজে লাগিয়ে গড়ে তুলছেন ছোট-মাঝারি ও বড় শিল্প। পাটপণ্য উৎপাদন, বুটিক, হ্যান্ডিক্রাফটস, আইসিটি ফার্ম, অনলাইন বিপননের মাধ্যমে নিজেরাই সাবলম্বী হয়ে উঠছেন। এ ছাড়া জাতিসংঘ শান্তিরক্ষা বাহিনীর কর্মকান্ডে দেশের নারীরা দক্ষতার সঙ্গে প্রশংসনীয় দায়িত্ব পালন করছেন। এরই মধ্যে আন্তর্জাতিক সাহসী নারী পুরস্কার পেয়েছেন সুপ্রিম কোর্টের জ্যেষ্ঠ আইনজীবী ফাওজিয়া করিম ফিরোজ। তিনি গত তিন দশকের বেশি সময় ধরে প্রান্তিক গোষ্ঠীর অধিকারের জন্য আইনি লড়াই করছেন। বিশ্বের বিভিন্ন দেশে বাংলাদেশের নারী রাষ্ট্রদূতরা দক্ষতার সঙ্গে তাদের দায়িত্ব পালন করে যাচ্ছেন। এবারের নারী সাফ চ্যাম্পিয়নশিপে দেশবাসীকে একের পর এক আনন্দঘন মুহূর্ত উপহার দিয়েছে বাংলাদেশের নারী ফুটবলাররা। সাফ নারী ফুটবল চ্যাম্পিয়নশিপে নতুন ইতিহাস গড়েছে বাংলাদেশ। নেপালকে ৩-১ গোলে ধসিয়ে দিয়ে সাফ নারী ফুটবলে চ্যাম্পিয়নের মুকুট পরে বাংলাদেশের মেয়েরা। সব মিলিয়ে পেশাগত সাফল্যে ঈষর্ণীয় অবস্থান তৈরি করেছে বাংলাদেশের নারী।

সর্বশেষ খবর