শনিবার, ২৩ মার্চ, ২০২৪ ০০:০০ টা

কারসাজির মুনাফায় লুট হয়ে যায় ব্যবসায়ীর আখেরাত

মাওলানা সেলিম হোসাইন আজাদী

কারসাজির মুনাফায় লুট হয়ে যায় ব্যবসায়ীর আখেরাত

একে একে ১১টি সিয়াম সুস্থ-সুন্দরভাবে যাপন করলাম। হাদিসের ঘোষণা অনুযায়ী রহমতের দশক শেষ করে এখন আমরা মাগফিরাতের দশকে আছি। গত ১০-১২ দিনে কতটা রহমত কুড়াতে পেরেছি গায়েবের মালিক ভালো জানেন। সামনের দিনগুলোতে কতটা মাগফিরাত ও নাজাত ভাগ্যে জুটবে সেটাও আল্লাহর অজানা নয়। তবে আল্লাহর একটা অসীম দয়া যে, আখেরাতের প্রাপ্তির খাতায় কার কত জমা সেটা বোঝার সামর্থ্য বান্দাকেও দেওয়া হয়েছে। দুনিয়ার জীবনেও এমনটা হয়। রেজাল্ট প্রকাশ হওয়ার আগেই পরীক্ষার্থী বলে দিতে পারে সে পাস করবে নাকি ফেল করবে। কোনো কোনো শিক্ষার্থী তো হলফ করেই বলে আমি একশতে পঁচাশি পাব। কে কত পাব এটা দুনিয়ায় যেমন বোঝা যায়, তেমনি বোঝা যায় আখেরাতের বেলায়ও। মাহে রমজানের ১১টি দিন থেকে আমার প্রাপ্তি কী সেটা আমিই ভালো জানি।

হাদিস শরিফে রসুল (সা.) বলেছেন, রমজান হলো সহমর্মিতার মাস। অন্যের প্রতি দরদ দেখানোর মাস। যে না খেয়ে আছে তার কষ্ট উপলব্ধির মাস। যার ঘরে বাজার নেই তার অসহায়ত্ব অনুভবের মাস। আফসোস! বাংলাদেশে রমজান আসে ঠিক বিপরীত দৃশ্য নিয়ে। কিছু ব্যবসায়ী ভাইয়ের কাছে রমজান যেন ‘গলাকাটার মাস’। সারা বছরের লাভ কয়েক গুণে তুলে নেওয়ার মাস। গত ছয় মাস মওজুদ করে রাখা নিত্যপণ্যের উচ্চমূল্য হাঁকানোর মাস। মাস শেষে ঘরমুখো যাত্রীদের কাছে ‘ভাড়া ডাকাতির’ মাস। অর্থাৎ রোজাদারকে যত উপায়ে হয়রানি করা যায়, আর্থিকভাবে বিপর্যস্ত করা যায়, মানসিকভাবে বিধ্বস্ত করা যায়; একদল ব্যবসায়ী ভাই সবটুকু সুযোগ ষোলো আনায় কাজে লাগিয়ে ছাড়েন।

খেটেখাওয়া মানুষ থেকে শুরু করে ভালো চাকরি করেন, ব্যবসা করেন এমন মানুষেরও বাজারে গিয়ে ঘাম ছুটে যায় নিত্যপণ্যের উচ্চমূল্য শুনে। রোজার আগের দিন যে সবজির দাম ছিল ৫০ টাকা, রোজার পয়লা দিনেই সেটা হয়ে যায় ৮০ টাকা, ১০০ টাকা। ফলের কথা বিশেষ করে বলতে হয়। সারা বছর যেমন যায় যাক, একজন দিনমজুরও চায় রোজার দিনগুলো যেন পরিবার-পরিজনের মুখে দু টুকরো আপেল, কমলা, আঙ্গুর তুলে দিতে। আফসোস! ফল নিয়ে কী জালিয়াতিই না করা হয় ভোক্তাদের সঙ্গে। প্রথমত বাজারে ফল মানেই বিষ। হয় খেতে থাকতেই বিষ মেশানো হয়, নতুবা আড়তে আনার পর বিষ মিশিয়ে আমাদের হাতে ধরিয়ে দেওয়া হয়। সেও আবার কম ওজনে, বেশি দামে। হাজারো মিথ্যা বলে। হায়! দুই দিনের দুনিয়ার জন্য কী সাংঘাতিক প্রতারণা করছেন আমাদের ব্যবসায়ী সমাজ। খবরে দেখেছি, পচা খেজুর, বিষাক্ত তরমুজ, ফরমালিন দেওয়া কমলা বিক্রি করছেন ব্যবসায়ীরা। মাছ-মাংস, শাক-সবজি, তরিতরকারি সবকিছুতেই বিষ ঢুকে গেছে। এসব বিষ আমাদের কিডনি, হার্ট, লিভার সব অকেজো করে দেবে অল্প কয়েক বছরেই। বলছিলাম, শিক্ষার্থীই জানে পরীক্ষায় সে কী রেজাল্ট করবে। আমাদের অসাধু ব্যবসায়ীরাও ভিতরে ভিতরে ঠিকই টের পান মানুষকে ধোঁকা দিয়ে অতি মুনাফার ফলাফল দুনিয়াতেও মঙ্গলজনক নয়, আখেরাতেও ভালো নয়। আমি ব্যক্তিগতভাবে কয়েকজন ব্যবসায়ীকে জিজ্ঞাসা করেছিলাম, রোজাদারদের টার্গেট করে কেন তোমরা ভেজাল পণ্য, উচ্চ মুনাফার ফিকির করো? কেউ তেমন সদুত্তর দিতে পারেনি। তবে একজন ব্যবসায়ী বড় লজ্জিত সুরে অপরাধবোধ নিয়ে বলেছিল, হুজুর! বুঝতে পারি অতি মুনাফার লোভে শয়তান আমার আখেরাত লুট করে নিয়ে যায়। খুব ভালো করেই বুঝতে পারি, মানুষকে ঠকিয়ে যতই নামাজ পড়ি, রোজা রাখি, ইবাদত করি, দান-খয়রাত করি কোনো লাভ হবে না। প্রতিবারই তওবা করি সামনের বছর থেকে আর ভেজাল পণ্য বিক্রি করব না। কিন্তু লোভ এমন খারাপ জিনিস, আমাকে এই জাহান্নাম থেকে বোরোতেই দিচ্ছে না। আসলে আপনারা যে বলেন ঠিকই বলেন, অসাধু ব্যবসায়ীর ওপর আল্লাহ এমন গজব ফেলেন, অভাবের বৃত্ত থেকে সে আর কখনো বেরোতে পারে না।

তবে আশার কথা হলো, আমাদের সমাজে এখনো দু-একজন ভালো-দীনদার ব্যবসায়ী আছেন। যারা রমজান উপলক্ষে সাধ্যমতো নিত্যপণ্যের দাম কম রাখেন। কেউ কম লাভে ছোলা-বেসন বিক্রি করেন, কেউ গোশত-মাছ সীমিত লাভে রোজাদারদের হাতে তুলে দেন। এসব ব্যবসায়ীর সম্পর্কেই রসুল (সা.) বলেছেন, ‘আত-তাজিরু হাবিবুল্লাহ। সৎ ব্যবসায়ী আল্লাহর বন্ধু।’ অন্য হাদিসে রসুল (সা.) বলেছেন, ‘সৎ ব্যবসায়ীর হাশর হবে নবী-সিদ্দিকদের সঙ্গে।’ আমরা দোয়া করি, আমাদের ব্যবসায়ী ভাইয়েরা যেন নিজেদের আখেরাত ঠিক রেখে সততার সঙ্গে ব্যবসা-বাণিজ্য করতে পারেন। আল্লাহ আমাদের সবাইকে দীনের সঠিক বুঝ দিন। আমিন।

লেখক : চেয়ারম্যান, বাংলাদেশ মুফাসসির সোসাইটি, পীর সাহেব, আউলিয়ানগর, www.selimazadi.com

সর্বশেষ খবর