শুক্রবার, ৫ এপ্রিল, ২০২৪ ০০:০০ টা

ব্যাংক লুটের পর থানায় আক্রমণ

♦ অপহৃত ব্যাংক ম্যানেজার উদ্ধার ♦ চলছে যৌথ বাহিনীর অভিযান

নিজস্ব প্রতিবেদক, ঢাকা ও বান্দরবান প্রতিনিধি

ব্যাংক লুটের পর থানায় আক্রমণ

র‌্যাবের মধ্যস্থতায় সোনালী ব্যাংকের বান্দরবানের রুমা শাখার ম্যানেজার নিজাম উদ্দিন উদ্ধার -বাংলাদেশ প্রতিদিন

দুই দিনে তিনটি সরকারি ব্যাংক লুটের পর গতকাল রাতে কুকি-চিন ন্যাশনাল ফ্রন্টের (কেএনএফ) সশস্ত্র শাখা ‘কুকি-চিন ন্যাশনাল আর্মি (কেএনএ)’ সদস্যরা থানায় আক্রমণ করে। গতকাল রাত ৮টার দিকে ২০০-৩০০ জনের সশস্ত্র দলটি প্রথমে গুলি করতে করতে সোনালী ব্যাংক লুট করতে আসে। এ সময় পুলিশি বাধার মুখে পড়ে তারা। দুই পক্ষের গোলাগুলির মধ্য দিয়ে অস্ত্রধারীরা থানচি থানা ঘেরাও করে ব্যাপক গুলি ছুড়তে থাকে। বান্দরবানের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার (প্রশাসন) মো. রায়হান কাজেমি জানান, রাত ১০টার দিকে পুলিশ ও সন্ত্রাসীদের মধ্যকার গুলি বিনিময় বন্ধ হয়।

স্থানীয় সূত্রগুলো জানায়, রাত ৮টার কিছু পরে সন্ত্রাসীরা গুলি ছুড়তে ছুড়তে থানচি বাজারে ঢুকে সোনালী ব্যাংকের উদ্দেশে যায়। এ সময় পুরো বাজার জনশূন্য হয়ে পড়ে। গোলাগুলির তথ্য নিশ্চিত করে অতিরিক্ত পুলিশ সুপার রায়হান কাজেমি জানান, সোনালী ব্যাংকের সামনে আগে থেকে পাহারায় থাকা পুলিশ ও নিরাপত্তা বাহিনী সে সময় পাল্টা গুলি ছোড়ে। এ অবস্থায় টিকতে না পেরে ‘কেএনএ’ সদস্যরা থানচি থানামুখী হয়। সেখানে থানা পুলিশ ও অস্ত্রধারীদের মধ্যে গোলাগুলি শুরু হয়। তিনি জানান, আগে থেকেই থানায় পুলিশ সদস্য সংখ্যা বাড়ানোর ফলে পুলিশ সদস্যরা সন্ত্রাসীদের মোকাবিলা করতে পেরেছে। এ ঘটনায় এখন পর্যন্ত কোনো হতাহতের খবর পাওয়া যায়নি। এদিকে সন্ত্রাসী হামলা ও দুই দিনে তিনটি সরকারি ব্যাংকের টাকা লুটের ঘটনায় বান্দরবানে থমথমে অবস্থা বিরাজ করছে। অপহরণের দুই দিন পর গতকাল সন্ধ্যায় সোনালী ব্যাংক ম্যানেজার নিজাম উদ্দিন রাসেলকে উদ্ধার করেছে র‌্যাব। তিন ব্যাংকে ডাকাতির ঘটনায় কেএনএর নাম আসায় শান্তি সংলাপ স্থগিত করেছে শান্তি প্রতিষ্ঠা কমিটি। তাদের সঙ্গে আলোচনা চালিয়ে যাওয়া আর ‘সম্ভব নয়’ বলে মন্তব্য করেছেন পাহাড়ের নৃ-গোষ্ঠীগুলোর সদস্যদের নিয়ে গঠিত শান্তি প্রতিষ্ঠা কমিটির আহ্বায়ক ক্য শৈ হ্লা মারমা। গতকাল বান্দরবান জেলা পরিষদের সম্মেলন কক্ষে সংবাদ সম্মেলনে তিনি বলেন, কমিটি মনে করে এসব ঘটনার মধ্য দিয়ে কেএনএফ (‘কুকি-চিন ন্যাশনাল ফ্রন্ট) শান্তি প্রতিষ্ঠা কমিটির সঙ্গে সংলাপ করার সব ধরনের পথ বন্ধ করে দিয়েছে। কেএনএফের সশস্ত্র শাখা কেএনএর সঙ্গে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সংঘর্ষে পাহাড়ে আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়লে ২০২৩ সালের ৩০ মে বিভিন্ন নৃ-গোষ্ঠীর সদস্য নিয়ে শান্তি প্রতিষ্ঠা কমিটি গঠিত হয়। ব্যাংক ডাকাতির সঙ্গে জড়িত সন্ত্রাসীদের গ্রেফতারে বুধবার (৩ এপ্রিল) ভোর থেকে রুমা ও থানচির দুর্গম পয়েন্টগুলোয় সেনা, পুলিশ ও অন্যান্য বাহিনীর সমন্বয়ে যৌথ অভিযান চলছে। রুমায় সোনালী ব্যাংক এবং থানচিতে সোনালী ও কৃষি ব্যাংকে সন্ত্রাসী আক্রমণের পর বুধবার সন্ধ্যা থেকে জেলা সদরের সোনালী ব্যাংকে বাড়তি পুলিশ সদস্য মোতায়েনের মধ্য দিয়ে ব্যাংকিং কার্যক্রম চলছে। মঙ্গলবার (২ এপ্রিল) রাতে রুমা উপজেলা সদরে অবস্থিত সোনালী ব্যাংকে আক্রমণ, অস্ত্র লুট ও ব্যাংক ম্যানেজারকে অপহরণ করে অস্ত্রধারী সন্ত্রাসীরা। পরদিন দুপুরে পাশের থানচি উপজেলায় গুলি ছুড়তে ছুড়তে সোনালী ও কৃষি ব্যাংকের ভিতরে ঢোকে অস্ত্রধারী সন্ত্রাসীরা। তারা ব্যাংকের কর্মী, গ্রাহক ও নিরাপত্তারক্ষীদের জিম্মি করে টাকা লুটে নিয়ে যায়। এদিকে বান্দরবানের রুমায় সন্ত্রাসীদের হাতে অপহৃত সোনালী ব্যাংক কর্মকর্তা নিজাম উদ্দিনকে উদ্ধার করা হয়েছে। গতকাল সন্ধ্যায় বান্দরবানের রুমা বাজার থেকে তাকে উদ্ধার করে র‌্যাব। র‌্যাব-১৫-এর অধিনায়ক লে. কর্নেল এইচ এম সাজ্জাদ হোসেন জানান, রুমা বাজার থেকে ব্যাংক কর্মকর্তা নিজাম উদ্দিনকে উদ্ধার করা হয়েছে। র‌্যাব সদর দফতরের পাঠানো এক বার্তায় বলা হয়েছে, র‌্যাবের মধ্যস্থতায় সোনালী ব্যাংকের বান্দরবানের রুমা শাখার ম্যানেজার নিজাম উদ্দিনকে উদ্ধার করা হয়েছে। মঙ্গলবার রাতে তারাবি নামাজের সময় রুমা শাখা সোনালী ব্যাংক ও আশপাশ এলাকা ঘিরে ফেলে শতাধিক সশস্ত্র দুর্বৃত্ত। প্রত্যক্ষদর্শীরা জানান, মসজিদ থেকে ব্যাংক ম্যানেজার নিজাম উদ্দিনকে ধরে নিয়ে ব্যাংকের ভিতরে মারধর করে তারা। পরে তাকে ধরে নিয়ে যায়। গতকাল দুপুরে রাজধানীর কারওয়ান বাজারে র‌্যাব মিডিয়া সেন্টারে আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনে র‌্যাবের আইন ও গণমাধ্যম শাখার পরিচালক কমান্ডার খন্দকার আল মঈন জানিয়েছিলেন, নিজাম উদ্দিনকে মুক্তি দিতে কেএনএফ ২০ লাখ টাকা পণ দাবি করে। তিনি জানান, ঘটনার দিন ২ শতাধিক কেএনএফ সদস্য একযোগে আক্রমণ করে। শান্তি আলোচনা চলাকালে তারা কেন এমন বেপরোয়া হয়ে উঠল খতিয়ে দেখা হচ্ছে। টাকার প্রয়োজনেই তারা ব্যাংক ডাকাতি করেছে বলে প্রাথমিক ধারণা। থানচি উপজেলা নির্বাহী অফিসার মো. মামুন জানান, সন্ত্রাসীরা ব্যাংকের ভল্ট ভাঙতে না পারলেও সোনালী ব্যাংকের ক্যাশ কাউন্টার থেকে ১৫ লাখ এবং কৃষি ব্যাংকের ক্যাশ কাউন্টার থেকে ৫-৭ লাখ টাকা ছিনিয়ে নিয়ে গুলি করতে করতে বেরিয়ে যায়। বান্দরবানে সেনাবাহিনীর নেতৃত্বে যৌথ অভিযান পরিচালনা করা হবে বলে জানিয়েছেন চট্টগ্রাম রেঞ্জ পুলিশের উপমহাপরিদর্শক নূরে আলম মিনা। গতকাল দুপুরে থানচি উপজেলায় টাকা লুট হওয়া দুটি ব্যাংকের শাখা পরিদর্শন শেষে সাংবাদিকদের তিনি এ কথা বলেন। ডিআইজি নূরে আলম মিনা বলেন, লুট হওয়া অস্ত্র উদ্ধার ও অপরাধীদের দমনে যৌথ অভিযান হবে। রুমা ও থানচিতে ব্যাংকের টাকা লুট, পুলিশের ওপর হামলাসহ নানা অভিযোগে আট থেকে নয়টি মামলা হতে পারে। মামলার সব প্রস্তুতি চলছে। কোনো সন্ত্রাসী সংগঠনের নাম উল্লেখ না করে ডিআইজি বলেন, ফান্ড সংগ্রহের জন্য দুটি ব্যাংকে হামলা হয়েছে। রুমায় বেশি টাকা রয়েছে, তাই ভল্ট ভেঙে নেওয়ার চেষ্টা করে। থানচিতে ঘটনার দিন হাটবার থাকায় ব্যাংকে লেনদেন বেশি হবে। তাই সেখানে ডাকাতি হয়েছে। লুট হওয়া অস্ত্র অবশ্যই উদ্ধার করা হবে বলে জানান ডিআইজি নূরে আলম মিনা। তিনি জানান, সোনালী ব্যাংক রুমা উপজেলা শাখার ব্যবস্থাপক নিজাম উদ্দিনকে মঙ্গলবার রাতে ব্যাংকের পাশে একটি মসজিদ থেকে ধরে নিয়ে যায় অস্ত্রধারীরা। পরে তাঁকে নিয়ে ব্যাংকের ভল্টে রক্ষিত ১ কোটি ৫৯ লাখ টাকা ডাকাতির চেষ্টা করা হয়। কিন্তু ব্যর্থ হয়ে অস্ত্রধারীরা তাঁকে নিয়ে যায়। স্থানীয় লোকজন ও পুলিশ প্রশাসন বলেছে, নতুন সশস্ত্র গোষ্ঠী কুকি-চিন ন্যাশনাল ফ্রন্ট (কেএনএফ) জড়িত এ অপহরণে। অস্ত্রধারীদের পোশাকেও ‘কেএনএফ’ লেখা ছিল। রুমায় সোনালী ব্যাংকের শাখায় মঙ্গলবার রাতে আক্রমণ করেও অস্ত্রধারীরা কোনো টাকা নিতে পারেনি। তবে বুধবার দুপুরে থানচিতে সোনালী ব্যাংক ও বাংলাদেশ কৃষি ব্যাংকের শাখায় আক্রমণ করে তারা সাড়ে ১৭ লাখ টাকা নিয়ে যায়। আক্রমণকারীরা নিজাম উদ্দিনকে অপহরণের পাশাপাশি পুলিশ ও আনসার সদস্যদের ১৪টি অস্ত্র ও ৪১৫টি গুলি লুট করেছে। মানুষের মুঠোফোনও নিয়ে গেছে। রুমায় সোনালী ব্যাংকের শাখায় ডাকাতির সঙ্গে নতুন সশস্ত্র গোষ্ঠী কেএনএফ সদস্যরা জড়িত বলে প্রাথমিক তথ্যের ভিত্তিতে জানিয়েছেন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান। স্থানীয় লোকজন বলছেন, থানচিতে আক্রমণের সঙ্গেও একই গোষ্ঠী জড়িত। কেএনএফ সদস্যদের স্বাভাবিক জীবনে ফিরিয়ে আনার জন্য জেলা পরিষদের চেয়ারম্যান ক্যশৈহ্লা মারমার নেতৃত্বে ‘শান্তি প্রতিষ্ঠা’ কমিটি গঠন করা হয় গত বছরের মে মাসে। ওই কমিটির সঙ্গে কেএনএফের কয়েক দফা আলোচনা হয়েছে। সর্বশেষ আলোচনা হয় ৫ মার্চ। এরপর আক্রমণের ঘটনা ঘটল। এদিকে থানচিতে দুটি ব্যাংক থেকে টাকা লুট হওয়ার সময় বাধা দিতে যাচ্ছিলেন ওসিসহ পুলিশের একটি দল। তাদের লক্ষ্য করে দুই দফা গুলি চালায় অস্ত্রধারীরা। তারা ব্যাংক কর্মকর্তা, দুজন বিজিবি সদস্য, ৯ পুলিশ সদস্য, ব্যাংকে আসা লোকজনসহ প্রায় ৪০ জনকে জিম্মি করে। পুলিশ গুলি চালালে জিম্মিদের গুলি করার হুমকি দেওয়া হয়। ঘটনার প্রত্যক্ষদর্শী পুলিশ সদস্যরা বলছেন, পুলিশ ধৈর্যের পরিচয় না দিলে অনেক লাশ পড়ত। গতকাল বেলা ১১টার দিকে থানচি উপজেলা সদরে সোনালী ব্যাংক ও কৃষি ব্যাংকের দুটি শাখার সামনে গিয়ে দেখা যায় সতর্ক পাহারায় রয়েছেন পুলিশ সদস্যরা। ব্যাংক দুটি থেকে ১০০ গজ দক্ষিণে পাহাড়ের ওপর থানচি থানা। থানচি থানার ওসি জসীম উদ্দীন বলেন, ‘ব্যাংক লুটের খবর পেয়ে থানা থেকে পুলিশ ফোর্স নিয়ে যখন যাচ্ছিলাম, তখন থানার প্রধান ফটকের সামনে থেকে পুলিশ সদস্যদের লক্ষ্য করে গুলি করা হয়। অল্পের জন্য প্রাণে বেঁচে যাই। একই সঙ্গে থানার পেছন দিক থেকেও গুলি করা হয়। পরে বিকল্প পথে পুলিশ ফোর্স নিয়ে ব্যাংকের সামনে যখন যাই, ততক্ষণে অস্ত্রধারীরা টাকা নিয়ে চলে যায়।’

এই রকম আরও টপিক

সর্বশেষ খবর