রবিবার, ৭ এপ্রিল, ২০২৪ ০০:০০ টা
দিল্লির চিঠি

বাংলাদেশে আমার দিনগুলো

মহেন্দ্র বেদ

বাংলাদেশে আমার দিনগুলো

আজ থেকে ৫০ বছর আগে এই দিনে ইউনাইটেড নিউজ এজেন্সি অব ইন্ডিয়ার (ইউএনআই) ব্যুরোপ্রধান পদে যোগ দেওয়ার জন্য ঢাকায় পৌঁছাই। ঘটনাটি আমার পেশাদার ও পুরো জীবনের ওপরই গভীর ছাপ রেখেছিল। এর পরের ২২ মাসে আমি যা শিখেছি, তা আমি ১০ বছরেও শিখতে পারতাম না।

অন্য আরেকটি চাকরির প্রস্তাব নাকচ করে বাংলাদেশে আসার সিদ্ধান্ত আমার কিছু শুভাকাক্সক্ষীকে বিস্মিত ও হতাশ করে। যে বাংলাদেশে চাকরি করাটা আমার জন্য দারুণ ‘উপভোগ্য’ ব্যাপার হবে-এটা তাঁরা মনে করতেন না, বিশেষ করে আমার মতো কারও জন্য যে কিনা এই অঞ্চলের নয়। জীবনে প্রথমবারের মতো কলকাতা হয়ে ঢাকা আসছিলাম। আমার শুভাকাক্সক্ষীদের একজন আমার হাতে বেশ কিছু বাংলা শব্দের একটা ‘অভিধান’ ধরিয়ে দিয়েছিলেন, যাতে আমি এখানকার মানুষের সঙ্গে সহজে যোগাযোগ করতে এবং বিভিন্ন জায়গা সহজে খুঁজে পেতে পারি; এর বেশি কিছু নয়। তেজগাঁও বিমানবন্দর (এখনকার বিমানবন্দরটি অনেক দিন পরে হয়েছে) পর্যন্ত আমার ফ্লাইট ছিল মাত্র মিনিট তেইশের। বিমানের ভিতরেই আমার কাজ শুরু হয়ে যায়। কথা বলা শুরু করলাম, চলচ্চিত্র নির্মাতা বি আর চোপরা, তার স্ত্রী এবং ফিল্ম অ্যান্ড টেলিভিশন ইন্সটিটিউট অব ইন্ডিয়ার পরিচালক ড. জগৎ মুরারির সঙ্গে। ড. মুরারি বললেন, কাল ‘ভারত-বাংলাদেশ চলচ্চিত্র উৎসব’ শুরু হচ্ছে জানেন? এই ইভেন্ট কাভার করাই ছিল আমার প্রথম অ্যাসাইনমেন্ট। সাপ্তাহিক সিনে পত্রিকা ‘স্ক্রিন’-এ আমার পাঠানো প্রতিবেদন প্রধান শিরোনাম হয়েছিল। প্রতিবেদনটি উদারচিত্ত বিআর চোপরা তাঁর সঙ্গে করে বোম্বেতে নিয়ে গিয়েছিলেন। প্রতিবেদনের জন্য পাই ২৫০ রুপি। যা হোক, চলচ্চিত্র উৎসব উপলক্ষে, এবার আমার দায়িত্ব ছিল বাংলাদেশি চলচ্চিত্র তারকাদের ওপর প্রতিবেদন করা, এমনকি সে যদি স্থানীয় ফিল্মে ছোটখাটো ভূমিকায় নামা ‘তারকা’ও হয়। শুরুটা যতটা সহজ হতে পারত, ততটাই হয়েছিল। পরের কয়েক মাসের সময়ে, আমাকে দুর্ভিক্ষ এবং অনাহারে মানুষের মৃত্যুর প্রত্যক্ষদর্শী হতে হলো। দেখলাম, নিরন্ন অসহায় মানুষ স্রেফ দুমুঠো খাদ্যের জন্য আমার দ্বিতীয় তলায় অবস্থিত অফিস কাম বাসার দরজায় এসে আছড়ে পড়ছে। এরপরে দেখা দিল বন্যা। তখন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জন্য অনেক বড় চ্যালেঞ্জ ছিল এই নতুন জন্ম নেওয়া দেশকে নেতৃত্ব দেওয়া, যে দেশ অসীম সম্ভাবনা থাকার পরেও অস্বাচ্ছন্দ্যকর সময়ের ভিতর দিয়ে যাচ্ছিল। দেশকে নতুন আত্মপরিচিতি দেওয়া এবং গভীর রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক সমস্যাবলির সঙ্গে সংগ্রামও ছিল অনেক বড় চ্যালেঞ্জ। এর পরের কয়েক মাসে আমাকে প্রত্যক্ষদর্শী হতে হয়েছিল এবং দুর্ভাগ্যজনকভাবে প্রতিবেদনও করতে হয়েছিল বঙ্গবন্ধুর মর্মান্তিক হত্যাকাণ্ড ও এই বিয়োগান্তক ঘটনার সঙ্গে জড়িত সংকটকে নিয়েও। এই মর্মান্তিক ঘটনার নেপথ্যে ছিল বিদেশি ষড়যন্ত্র, সম্ভবত স্নায়ুযুদ্ধকালীন রাজনীতি, যেটির ব্যাপারে পরে খুব কম মানুষই কথা বলতে আগ্রহী ছিল। পরের ছয় বছরে অভ্যন্তরীণ কারণে এই দেশে সংঘটিত হয়েছিল আরও ২৩টি ক্যু। তবে, আজ আর অবস্থা তেমনটি নেই, কেননা স্বভাবত মানুষকে পূর্বাবস্থা অতিক্রম করে যেতে হয়।

এমন না যে বাংলাদেশে এরকম কাজের জন্য ভারতীয়দের পাঠানো হতো না। সংবাদ জগতে পিটিআই-এর সঙ্গে ছিল আমাদের প্রতিদ্বন্দ্বিতা। তারাও ঢাকায় দক্ষিণ ভারতের লোকদের পাঠিয়েছিল। এরপরও ভারতের সম্মানীয় দুজন হাইকমিশনার সুবিমল দত্ত ও সমর সেন আমাকে জিজ্ঞাস করছিলেন আমি বাংলা না-জানা সত্ত্বেও কীভাবে কাজ চালিয়ে যাচ্ছি। আমার এক সহকর্মী সৈয়দ দিদার বখত এই ব্যাপারে আমাকে যথেষ্ট সহযোগিতা করতেন। আর ব্যক্তিগতভাবে আমি এক ডজনেরও বেশি ‘শব্দ-অভিধান’ অধ্যয়ন করে নিজেকে তৈরি করেছিলাম। যা শিখেছিলাম, সেটার চর্চা করতাম জাতীয় প্রেস ক্লাবে এবং বন্ধুদের সঙ্গে, টেবিল টেনিস (স্থানীয়ভাবে খেলাটি পরিচিত ছিল পিংপং নামে) খেলার সময়, এমনকি লেবু চা খেয়ে আড্ডা দিতে দিতে।

সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান ও সংগীত সন্ধ্যাগুলোও অনেক কিছু শেখার ক্ষেত্র ছিল, যা আমার জন্য উপমহাদেশের এই পূর্ব প্রান্তে কাজ করেছিল ‘টিউটোরিয়াল’-এর মতো। উষ্ণ ও আতিথেয়তাপূর্ণ বাংলাদেশের মানুষ আমার এই শেখার অভিযাত্রাকে দারুণভাবে সাধুবাদ জানিয়েছিল। তাই এটাই স্বাভাবিক ছিল যে বিয়ের পর স্ত্রীকে আমি ঢাকায় নিয়ে এসেছিলাম। এখানকার অনেকেই আমাদের তাদের গৃহে নিমন্ত্রণ ও স্বাগত জানিয়েছিলেন। বাংলাদেশে আমার কর্ম অভিজ্ঞতা ছিল অনেকটাই বলিউডের সিনেমার মতো, টক ঝাল মিষ্টিতে পরিপূর্ণ। এখানে আমি শিখেছি, জেনেছি অনেক কিছু; একই সঙ্গে রোমাঞ্চকর ছিল এই স্মৃতিটুকু। শুধু শেষটা বলা যায় কাক্সিক্ষত হয়নি। আমি এবং আমার অর্ধাঙ্গিনী এখানে থাকার ঝুঁকিটা নিতেও রাজি ছিলাম। কিন্তু ভারতে জরুরি অবস্থা এবং বাংলাদেশে সামরিক আইনের কারণে আমার কাজ করাটা কঠিন হয়ে উঠেছিল। আর ওদিকে উভয় দেশেই আমার তৈরি করা প্রতিবেদনগুলো কাটছাঁট করা হতো, ছাপতে করা হতো দেরি এবং আমার প্রচেষ্টা নিষ্ফলাই থেকে যেতে লাগল। স্মৃতির করিডোরে ৫০ বছর পিছিয়ে গেলে দেখতে পাই, সাংবাদিক (তবে, আরও কিছু হওয়ার সম্ভাবনা বাস্তবায়িত হয়নি) হিসেবে বিদেশে আমার এই কর্ম অভিজ্ঞতা ছিল দারুণ মূল্যবান। লেবু চায়ের সঙ্গে টোস্ট খেতে খেতে সেই স্মৃতি আমি রোমন্থন করতে পারি তৃপ্তির সঙ্গেই।

ধন্যবাদ ও ভালোবাসা জানিয়ে

মহেন্দ্র বেদ

কলামিস্ট, লোকমার্গ ডটকম

ইমেরিটাস সভাপতি, কমনওয়েলথ জার্নালিস্ট অ্যাসোসিয়েশন (সিজিএ)

এই রকম আরও টপিক

সর্বশেষ খবর