রবিবার, ৭ এপ্রিল, ২০২৪ ০০:০০ টা

ইবাদত বাড়িয়ে আল্লাহর পুরস্কার আশা করি

মুফতি আমজাদ হোসাইন হেলালী

ইবাদত বাড়িয়ে আল্লাহর পুরস্কার আশা করি

আজ ২৭তম রোজা। দেখতে দেখতে মাহে রমজানের ইবাদতে শান্তির দিনগুলো শেষ হয়ে যাচ্ছে। আনন্দের সময়গুলো খুব দ্রুতই চলে যায়। সাহরির সময় একে অন্যকে ডেকে দেওয়া, পরিবারের সবাই একসঙ্গে বসে সাহরি করা, সময় পেলেই কোরআন তেলাওয়াত করা, কোরআন খতম করা, বেশি বেশি নফল ইবাদত করা, দান-সদকা বাড়িয়ে দেওয়া, আত্মীয়স্বজন পাড়া-প্রতিবেশীর খোঁজখবর নেওয়া, মাগরিবের সময় ইফতার সামনে নিয়ে সবাই একসঙ্গে আল্লাহর দরবারে হাত তুলে ফরিয়াদ করা, নিজেদের সব প্রয়োজন তাঁর কাছে চাওয়া, কাউকে ইফতার করানো, রাতে খতম তারাবি পড়া, তাহাজ্জুদ নামাজ পড়া, তওবা-ইস্তেগফার করা ও শেষ ১০ দিন ইতিকাফে বসা ইত্যাদি আরও অনেক নেক আমল করা। এ কাজগুলোর সুযোগ শুধু রমজান মাসেই তৌফিক হয়। অন্যান্য মাসে এই সুযোগ হয় না। রমজান মাসে শয়তানকে বেঁধে রাখা হয়। জান্নাতের দরজাগুলো উন্মোচন করে দেওয়া হয়। জাহান্নামের দরজাগুলো বন্ধ করে দেওয়া হয়। হাদিসে এসেছে, যখন রজযান মাসের আগমন ঘটে, তখন রসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, ‘তোমাদের কাছে বরকতময় মাস রমজান এসেছে। আল্লাহতায়ালা তোমাদের জন্য এ মাসের রোজা ফরজ করেছেন। এ মাসে জান্নাতের দরজাগুলো খুলে দেওয়া হয় এবং জাহান্নামের দরজাগুলো বন্ধ করে দেওয়া হয়। আর শয়তানকে শিকলে বন্দি করা হয়। এ মাসে এমন একটি রাত আছে, যা হাজার মাসের চেয়েও উত্তম। যে এর কল্যাণ থেকে বঞ্চিত হলো, সে তো প্রকৃতপক্ষেই বঞ্চিত। (মুসনাদে আহমদ : ৭১৪৮; সুনানে নাসায়ি : ২৪১৬) শয়তানকে বেঁধে রাখার কারণে অনেক গুনাহ থেকে বেঁচে থাকা যায়। প্রশ্ন হতে পারে, তারপরও তো মানুষ গুনাহ করে। গুনাহ থেকে বেঁচে থাকতে পারে না। তাহলে শয়তানকে বেঁধে রাখার অর্থ কী? এর উত্তর হলো- বড় শয়তানকে তো বেঁধে রাখা হয়েছে। কিন্তু প্রতিটি মানুষের ভিতর একটি নফস আছে। এই নফসের একটি দিক আছে। যাকে আরবি ভাষায় নফসে আম্মারাহ বলা হয়। এই নফসের প্রবঞ্চনায় মানুষ গুনাহের প্রতি ধাবিত হয়। ফলে তার দ্বারা গুনাহ হয়ে যায়। হজরত ইউসুফ আলাইহিস সালাম এই নফস থেকেই পানাহ চেয়েছিলেন। পবিত্র কোরআনে ইরশাদ হচ্ছে, ‘আমি এ দাবি করি না যে, আমার মন সম্পূর্ণ পাক-পবিত্র। বস্তুত মন সর্বদা মন্দ কাজেরই আদেশ করে। অবশ্য আমার রব যদি দয়া করেন সেটা ভিন্ন কথা। নিশ্চয়ই আমার প্রতিপালক অতি ক্ষমাশীল, পরম দয়ালু।’ (সুরা ইফসুফ : ৫৩) গুনাহ থেকে বেঁচে থাকাটাই হচ্ছে রোজার অন্যতম একটি মাকসাদ। গুনাহ থেকে বেঁচে থাকার প্রতিদানস্বরূপ এক আয়াতে ইরশাদ হচ্ছে, ‘তোমাদেরকে যে বড় বড় গুনাহ (কবিরা গুনাহ) থেকে নিষেধ করা হয়েছে, তোমরা যদি তা পরিহার করে চলো, তবে আমি নিজেই তোমাদের ছোট ছোট গুনাহ মিটিয়ে দিব এবং তোমাদেরকে এক মর্যাদাপূর্ণ স্থানে দাখিল করব।’ (সুরা নিসা : ৩১) আমরা এত কষ্ট-মুজাহাদা করে রোজা রাখছি, সেই রোজার প্রতিদান সম্পর্কে হাদিসের ভাষ্যমতে কিছু তুলে ধরছি। হজরত আবদুল্লাহ ইবনে আমর (রা.) হতে বর্ণিত, রসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, ‘রোজা ও কোরআন কিয়ামতের দিন বান্দার জন্য সুপারিশ করবে। রোজা বলবে, হে রব! আমি তাকে খাদ্য ও যৌনসম্ভোগ থেকে বিরত রেখেছি। অতএব তার ব্যাপারে আমার সুপারিশ গ্রহণ করুন। কোরআন বলবে, আমি তাকে রাতের ঘুম থেকে বিরত রেখেছি, (অর্থাৎ না ঘুমিয়ে সে তেলাওয়াত করেছে) অতএব তার ব্যাপারে আমার সুপারিশ কবুল করুন। রসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, অতঃপর তাদের উভয়ের সুপারিশ গ্রহণ করা হবে। (মুসনাদে আহমদ : ৬৬২৬) অন্য হাদিসে এসেছে, ‘রোজা হলো (জাহান্নাম থেকে পরিত্রাণলাভের) ঢাল এবং সুরক্ষিত দুর্গ। (মুসনাদে আহমদ : ৯২২৫) অন্য হাদিসে এসেছে, হজরত জাবির (রা.) থেকে বর্ণিত হয়েছে, রসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, ‘অবশ্যই আল্লাহতায়ালা রমজান মাসে প্রতি ইফতারের সময় অসংখ্য ব্যক্তিকে জাহান্নাম থেকে মুক্তি দান করেন। আর প্রতি রাতেই তা হয়ে থাকে।’ (সুনানে ইবনে মাজাহ : ১৬৪৩) রোজাদারের পুরস্কার হচ্ছে শ্রেষ্ঠ এক পুরস্কার। শুধুমাত্র রোজার ব্যাপারেই আল্লাহ বলেন, রোজার পুরস্কার আমি স্বয়ং নিজে দিব। অন্য কোনো ইবাদতের ক্ষেত্রে তিনি এমনটি বলেননি। রোজাদারের পুরস্কার সম্পর্কে হাদিসের ভান্ডার থেকে কতিপয় হাদিস। (ক.) হজরত জাবির (রা.) হতে বর্ণিত, রসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, ‘মহান রব ইরশাদ করেছেন- রোজা হলো ঢাল। বান্দা এর দ্বারা নিজেকে জাহান্নামের আগুন থেকে রক্ষা করবে। রোজা আমার জন্য, আর আমিই এর পুরস্কার দিব।’ (মুসনাদে আহমদ : ১৪৬৬৯) (খ.) ‘যে ব্যক্তি ইমান এবং ইহতিসাব তথা আল্লাহর প্রতি বিশ্বাস এবং সওয়াবের প্রত্যাশা রেখে রমজান মাসে রোজা রাখবে, তার আগের গুনাহগুলো মাফ করে দেওয়া হবে।’ (সহিহ বুখারি : ৩৮) (গ.) ‘সিয়াম পালনকারীর জন্য দুটি বিশেষ আনন্দ মুহূর্ত রয়েছে। একটি হলো ইফতারের সময়, আর দ্বিতীয়টি হলো তার রবের সঙ্গে সাক্ষাতের সময়।’ (বুখারি : ৭৪৯২; মুসলিম : ১১৫১) ঘ. ‘জান্নাতে একটি দরজা আছে, যার নাম রাইয়ান। কিয়ামতের দিন এ দরজা দিয়ে কেবল রোজাদার ব্যক্তিরাই প্রবেশ করবে। অন্য কেউ প্রবেশ করতে পারবে না। ঘোষণা করা হবে- কোথায় সেই সৌভাগ্যবান রোজাদারগণ? তখন তারা উঠে দাঁড়াবে। তারা ব্যতীত কেউ এ দরজা দিয়ে প্রবেশ করতে পারবে না। অতঃপর রোজাদারগণ যখন প্রবেশ করবে, তখন তা বন্ধ করে দেওয়া হবে। ফলে কেউ ওই দরজা দিয়ে প্রবেশ করতে পারবে না।’ (সহিহ বুখারি : ১৮৯৬; সহিহ মুসলিম : ১১৫২) রমজানের মধ্যেই আল্লাহপাক হাজার রাত থেকে শ্রেষ্ঠ লাইলাতুল কদর দান করেছেন। এর শ্রেষ্ঠত্ব ও মাহাত্ম্য বর্ণনা করে শেষ করা যাবে না। এ বিষয়ে মনে রাখি রসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সেই কথা, ‘এই মহিমান্বিত মাস উপস্থিত। তাতে একটি রজনী রয়েছে, যা হাজার মাস অপেক্ষা উত্তম। যে ব্যক্তি এর কল্যাণ ও বরকত থেকে বঞ্চিত থাকল, সে যেন সব কল্যাণ থেকেই বঞ্চিত হলো। আর কেবল অভাগাই এর কল্যাণ থেকে বঞ্চিত থাকে। (সুনানে ইবনে মাজাহ : ১৬৪৪)

সুতরাং সাতাশতম রাত অতিবাহিত হয়েছে, সাধ্যমতো ইবাদত করেছি। আল্লাহর কাছে কবুলের আশা করি। হাদিসের ভাষ্যমতে সামনে ২৯তম রাত আছে। লাইলাতুল কদরের ফজিলত পাওয়ার নিয়তে ইবাদত-বন্দেগি করি। আল্লাহর সন্তুষ্টির আশা করি এবং রমজানের আর যে কয়টা দিন বাকি আছি, তাকে গনিমত মনে করি। মাহাত্ম্যপূর্ণ ও বরকতে ভরপুর রমজান মাস। যার প্রতিটি মুহূর্ত বরকতময়। প্রতিটি নেক কর্মের দ্বিগুণ থেকেও বেশি সওয়াব দেওয়া হয়। ঈদ সামনে রেখে অযথা ঘুরাঘুরি না করে বাকি সময়টাকে কাজে লাগানোর ফিকির করি। কারণ এই ১০ দিন নাজাতের ও জাহান্নাম থেকে মুক্তির পাওয়ার দিন। আল্লাহপাক আমাদেরকে সহিহ বুঝ দান করুন এবং মাহে রমজানকে যথাযথ মূল্যায়ন করে ইবাদত করার তৌফিক দান করুন। আমিন।

 

সর্বশেষ খবর