শুক্রবার, ১৭ মে, ২০২৪ ০০:০০ টা

কেমন ছিল লু হাওয়া

ঢাকা-ওয়াশিংটন সম্পর্কে নতুন মোড় সরকারে স্বস্তি বিএনপি-সমমনাদের অস্বস্তি

জুলকার নাইন

কেমন ছিল লু হাওয়া

মার্কিন পররাষ্ট্র দফতরের দক্ষিণ ও মধ্য এশিয়া বিষয়ক সহকারী পররাষ্ট্রমন্ত্রী ডোনাল্ড লুর সফরের পর ঢাকার রাজনৈতিক অঙ্গনে বইছে ভিন্ন রকমের হাওয়া। তাঁর সফরে ঢাকা-ওয়াশিংটন সম্পর্ক এক নতুন মোড় নিয়েছে বলে মনে করছে কূটনীতিক মহল। কারণ দ্বিপক্ষীয় সহযোগিতা আরও জোরালো করার বার্তা দিয়েই গতকাল হাসিমুখে ঢাকা ছেড়েছেন ডোনাল্ড লু।

যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে সম্পর্ক নিয়ে টানা অস্বস্তির পর এখন স্বস্তিতে সরকার। বিএনপিসহ সরকারবিরোধী অংশের কারও সঙ্গে ডোনাল্ড লুর প্রকাশ্য কোনো বৈঠক বা যোগাযোগ না হওয়ায় স্বস্তি বাড়িয়েছে আরও কয়েক গুণ। নতুন করে সামনে এগিয়ে যেতে যুক্তরাষ্ট্রের আহ্বানকে স্বাগত জানিয়ে সরকারও আর পেছনে তাকাতে চায় না। তবে ডোনাল্ড লুর সফর অস্বস্তি তৈরি করেছে বিএনপিসহ সমমনা দলগুলোর মধ্যে। সব মিলিয়ে সফরের পর ডোনাল্ড লু বা যুক্তরাষ্ট্র সম্পর্কে বাংলাদেশের প্রধান দুই রাজনৈতিক দলের নেতৃত্ব ও সমর্থকদের মনোভাব উল্টে গেছে এক নিমেষেই। তিন দিনের সফরে গত মঙ্গলবার ঢাকা পৌঁছানো ডোনাল্ড লু সেদিনই নিজ দেশের কূটনীতিক, বাংলাদেশের নাগরিক সমাজ, সাংবাদিক, শ্রম অধিকার কর্মী ও পরিবেশ কর্মীদের সঙ্গে বৈঠক করেন। রাতে প্রধানমন্ত্রীর বেসরকারি শিল্প ও বিনিয়োগ উপদেষ্টা সালমান এফ রহমানের বাসভবনে বৈঠক ও নৈশভোজে অংশ নেন তিনি। এদিন স্বাদ নেন বাংলাদেশের ফুচকা ও চটপটির। পরদিন বুধবার ডোনাল্ড লু একে একে বৈঠক করেন মন্ত্রী ও সচিবদের সঙ্গে। পরিবেশমন্ত্রী ও পররাষ্ট্রমন্ত্রীর সঙ্গে সাক্ষাতের ফাঁকে আনুষ্ঠানিক বৈঠক করেন পররাষ্ট্র সচিবের সঙ্গে। টানা বৈঠক শেষে বিকালে বসুন্ধরা আবাসিক এলাকায় বসুন্ধরা স্পোর্টস কমপ্লেক্সে এসে এক অন্যরকম সময় কাটান লু। সেখানে রাষ্ট্রদূত পিটার হাসকে নিয়ে ডোনাল্ড লু ব্যাটবল হাতে দেশের নারী ক্রিকেটারদের সঙ্গে ক্রিকেট খেলায় মেতে ওঠেন। প্রাণোচ্ছল এক ডোনাল্ড লুর দেখা মেলে বসুন্ধরা স্পোর্টস কমপ্লেক্সে। গতকাল ভোর পৌনে ৪টায় তাঁকে বহনকারী বিমান ওয়াশিংটনের উদ্দেশে ঢাকার হযরত শাহজালাল (রহ.) আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর ত্যাগ করে। পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা বলছেন, ৭ জানুয়ারির সংসদ নির্বাচন ঘিরে মানবাধিকার, অংশগ্রহণমূলক নির্বাচনসহ বিভিন্ন ইস্যুতে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে মতপার্থক্য দেখা দেয় আওয়ামী লীগ সরকারের। অবাধ, নিরপেক্ষ ও নির্বিঘ্ন নির্বাচনের স্বার্থে ভিসানীতিতে কড়াকড়ি আরোপের ঘোষণাও দেয় যুক্তরাষ্ট্র। ফলে নির্বাচন শেষ হওয়ার পাঁচ মাসের মাথায় ডোলান্ড লুর এবারের সফর সম্পর্কোন্নয়নের ইঙ্গিত বলেই মনে করা হচ্ছে। তাঁর বক্তব্যেই এর স্পষ্ট আভাস পাওয়া গেছে। বুধবার পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে এক সংক্ষিপ্ত সংবাদ সম্মেলনে ডোনাল্ড লু বলেন, বাংলাদেশ সফরে এসে গত দুই দিনে আমি দুই দেশের জনগণের মধ্যে পুনরায় আস্থা স্থাপনের চেষ্টা করছি। আমরা জানি, গত বছর বাংলাদেশের সঙ্গে আমাদের অনেক টেনশন ছিল। আমরা অবাধ, সুষ্ঠু ও শান্তিপূর্ণ নির্বাচন (বাংলাদেশে) অনুষ্ঠানে যথেষ্ট চেষ্টা করেছিলাম। এতে কিছু টেনশন তৈরি হয়। আমাদের সম্পর্কের ক্ষেত্রে এমন ঘটনা ঘটা স্বাভাবিক। আমরা সামনে তাকাতে চাই, পেছনে নয়। আমরা সম্পর্কোন্নয়নের উপায় খুঁজে বের করতে চাই। ডোনাল্ড লু আরও বলেন, আমাদের সম্পর্কের পথে অনেক কঠিন বিষয় রয়েছে, র?্যাবের ওপর নিষেধাজ্ঞা, মানবাধিকার, শ্রম অধিকার ও ব্যবসার পরিবেশের উন্নয়ন। কিন্তু কঠিন বিষয়গুলো নিয়ে কাজ করার জন্য ইতিবাচক সহযোগিতার ওপর ভর করে এগিয়ে যেতে চাই। বিশ্লেষকরা বলছেন, যুক্তরাষ্ট্র গণতন্ত্র, মানবাধিকার, শ্রম অধিকার কিংবা মতপ্রকাশের স্বাধীনতার মতো বিষয়গুলোয় নিজেদের নীতিতে অটল থেকেই বাংলাদেশ সরকারের সঙ্গে সংযুক্ত থেকে সম্পর্ক এগিয়ে নিয়ে যেতে চাইছে। ডোনাল্ড লুর বক্তব্যে তা-ই উঠে এসেছে।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের অধ্যাপক দেলোয়ার হোসেন বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, ‘ডোনাল্ড লু বাংলাদেশ সফরে অনেক কথা পরিষ্কার করে গেছেন। তিনি অনেক খোলামেলা কথা বলেছেন এ সফরে। বোঝা যায় জাতীয় নির্বাচনের আগে বাংলাদেশের সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের সম্পর্কে কিছুটা অস্বস্তিকর অবস্থা ছিল, আস্থার ঘাটতি ছিল; এ আস্থার সম্পর্ক পুনঃপ্রতিষ্ঠা করতে চায় যুক্তরাষ্ট্র।’

সফর নিয়ে আওয়ামী লীগের প্রেসিডিয়াম সদস্য বস্ত্র ও পাট মন্ত্রী জাহাঙ্গীর কবির নানক বলেন, ‘ডোনাল্ড লুর বক্তব্যই প্রমাণ করে আওয়ামী লীগ সরকার সঠিক পথে আছে। যুক্তরাষ্ট্র গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়া সমর্থন করে। বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনার সরকারকে সমর্থন করে। আমরা সঠিক পথেই রয়েছি সেটিই প্রমাণিত হয়েছে। তাঁরা আমাদের সঙ্গে সম্পর্ক এগিয়ে নেওয়ার কথা বলেছেন, আমরাও তাঁদের সঙ্গে সম্পর্ক আরও সুদৃঢ় করতে চাই।’ তিনি আরও বলেন, ‘এতদিন যুক্তরাষ্ট্রের কথায় বিএনপি খুশি হতো। এখন তারা গণতান্ত্রিক সরকারকে সমর্থন করায় দলটি লাগামহীন পাগলা ঘোড়ার মতো পাগলামি করছে। এটা তাদের রাজনৈতিক দেউলিয়াপনা ছাড়া কিছুই না।’ বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরী বলেন, ‘যে কোনো দেশের সঙ্গে তাদের কূটনৈতিক সম্পর্ক অব্যাহত রাখতে হয়। এমনকি সামরিক শাসকদের সঙ্গেও তাদের সুসম্পর্ক রাখতে হয়। আজ বাংলাদেশের যে অবস্থা, সে পরিপ্রেক্ষিতে তাদের (যুক্তরাষ্ট্র) দেশের যে প্রয়োজনীয়তা মনে করছে, সেটাই তারা করছে। তবে তারা কিন্তু বাংলাদেশের জনগণের বিরুদ্ধে গিয়ে কিছু করছে না।’ তিনি বলেন, ‘যে কোনো সরকারের সঙ্গে সম্পর্কোন্নয়নের কথা বলাটাও একটা কূটনৈতিক শিষ্টাচারের অংশ। তবে গণতন্ত্র ও মানবাধিকারের পক্ষে যুক্তরাষ্ট্রের আগের অবস্থান অব্যাহত রয়েছে বলেও ডোনাল্ড লু তাঁর বক্তব্যে উল্লেখ করেছেন।’

সর্বশেষ খবর