শুক্রবার, ১৭ মে, ২০২৪ ০০:০০ টা

বিএনপিতে বহিষ্কার নিয়ে তোলপাড়

২০০ ছাড়িয়েছে, জেলা-উপজেলার গুরুত্বপূর্ণ নেতাদের গণহারে বহিষ্কারে তীব্র প্রতিক্রিয়া

শফিউল আলম দোলন

দলীয় সিদ্ধান্ত অমান্য করে তিন ধাপের উপজেলা পরিষদ নির্বাচনে বিচ্ছিন্নভাবে অংশ নিচ্ছেন বিএনপির তৃণমূলের নেতারা। এ সাংগঠনিক অপরাধে কেন্দ্র থেকে বহিষ্কার করা হচ্ছে তাদের। ইতোমধ্যে বিএনপির বহিষ্কৃত নেতার সংখ্যা ২০০ ছাড়িয়ে গেছে। সর্বশেষ তৃতীয় ধাপের উপজেলা নির্বাচনে অংশ নেওয়ার দায়ে ৫২ জনকে বহিষ্কার করা হয়েছে। আগের দিন করা হয়েছে আরও পাঁচজনকে। জেলা ও উপজেলা পর্যায়ের গুরুত্বপূর্ণ নেতাদের গণহারে বহিষ্কার নিয়ে দলের ভিতরে ব্যাপক তোলপাড় শুরু হয়েছে। তীব্র প্রতিক্রিয়া দেখা দিয়েছে কর্মী-সমর্থকদের মাঝে। এ বহিষ্কার আদেশকে কেন্দ্র নির্বাচনে অংশ না নেওয়ার দলীয় সিদ্ধান্ত অমান্যের শাস্তি হিসেবে গণ্য করলেও অনেকেই এটাকে ‘আত্মঘাতী’ সিদ্ধান্ত হিসেবে মনে করছেন। দেশব্যাপী দলীয় নেতা-কর্মীদের মধ্যে জোর আলোচনা চলছে- বহিষ্কারের এ তালিকা শেষ পর্যন্ত কোথায় গিয়ে দাঁড়াবে?

সংসদ নির্বাচন বর্জনের চার মাসের মাথায় হওয়া উপজেলা নির্বাচনের ব্যাপারে শুরু থেকেই কঠোর অবস্থান নেন বিএনপির শীর্ষ নেতৃত্ব। দলের একাধিক দায়িত্বশীল নেতা জানান, এর পেছনে দলের নীতিনির্ধারকদের নানা ব্যাখ্যা-যুক্তি আছে। তাঁরা মনে করেন, এ সরকারের অধীনে কোনো নির্বাচনই অবাধ, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ হওয়ার সুযোগ নেই। যেসব কারণে বিএনপিসহ বিরোধী দলগুলো জাতীয় সংসদ নির্বাচনে অংশ নেয়নি, সেসব কারণ এখনো বহাল আছে।

চলমান উপজেলা নির্বাচনের বিষয়ে বিএনপির জাতীয় স্থায়ী কমিটির সদস্য গয়েশ্বর চন্দ্র রায় বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, ‘উপজেলা নির্বাচনের বিষয়ে দলের ৯৯ শতাংশ নেতা-কর্মীর মনোভাবই নেতিবাচক। আমাদের দলের বেশির ভাগ নেতা-কর্মীর নামে ডজনের বেশি মামলা রয়েছে। তারা আদালতে নিয়মিত হাজিরা দেন, তাদের ন্যূনতম উৎসাহ নেই এ নির্বাচনে। বরং গ্রেফতার, মামলা আর আদালতের হাজিরার মধ্যে এ নির্বাচনকে তারা বোঝা মনে করছেন। তা ছাড়া যারা অংশ নিচ্ছেন তাদের অধিকাংশই হয় সাবেক নেতা, না হয় দলে নিষ্ক্রিয়। এ ছাড়া অনেকের “চাচাশ্বশুর”, “মামাশ্বশুর”-এর মতো আত্মীয়স্বজন নির্বাচনে অংশ নিচ্ছেন। এদের জন্য সৌজন্যের খাতিরে হলেও একটু-আধটু বলাবলি করতে হয়।’ ‘উপজেলা নির্বাচন কেন্দ্র করে গণহারে বহিষ্কারের ঘটনায় দলে কোনো নেতিবাচক প্রভাব পড়বে কি না?’ এ প্রশ্নের জবাবে গয়েশ্বর চন্দ্র রায় বলেন, ‘বিএনপি একটি সাগরসম রাজনৈতিক দল। সাগর থেকে কয়েক বালতি পানি ফেলে দিলে সাগরে যেমন কোনো প্রভাব পড়ে না, তেমন এ বহিষ্কারের ফলে বিএনপিতেও কোনো প্রভাব পড়বে না। দেশে বর্তমানে বিএনপির ২ কোটির বেশি নেতা-কর্মী রয়েছেন। যে দলের ৪০ হাজার নেতা-কর্মী জেলে থাকার পরও ব্যাপক আন্দোলন হয়, সে দলে এই দুই-তিন শ নিষ্ক্রিয় নেতা-কর্মী বহিষ্কারে কিছু আসে যায় না।’

উল্লেখ্য, গত এপ্রিলে বিএনপির সর্বোচ্চ নীতিনির্ধারণী ফোরাম জাতীয় স্থায়ী কমিটি দলীয়ভাবে উপজেলা নির্বাচন না করার সিদ্ধান্ত নেয়। এর পরও দলের যাঁরা নির্বাচনে মনোনয়নপত্র জমা দিয়ে অংশ নিয়েছেন, তাঁদের ফেরানোর জন্য সাংগঠনিকভাবে নানা উদ্যোগ-তৎপরতা নেওয়া হয়।

জানা গেছে, দল থেকে তৃণমূলের গুরুত্বপূর্ণ নেতাদের গণহারে এ বহিষ্কারকান্ড স্থানীয় কর্মী-সমর্থকদের মধ্যে কী ধরনের প্রভাব ফেলবে; দলকে আরও দুর্বল করবে কি না-এসব প্রশ্ন এখনো জোরালোভাবেই উঠছে বিএনপিতে। তার পরও কঠোর অবস্থানেই রয়েছেন রাজপথের বিরোধী দলটির হাইকমান্ড। কোনো কোনো নেতার ধারণা, উপজেলা নির্বাচনের শেষ ধাপ পর্যন্ত বহিষ্কারের এ সংখ্যা ২৫০ থেকে ৩০০-তে গিয়ে ঠেকতে পারে।

জানা গেছে, ২৯ মে অনুষ্ঠেয় তৃতীয় ধাপের উপজেলা পরিষদ নির্বাচনে দলীয় সিদ্ধান্ত অমান্য করায় সর্বশেষ বুধবার ৫২ জনকে বহিষ্কার করেছে বিএনপি। দলীয় গঠনতন্ত্র মোতাবেক দলের প্রাথমিক সদস্যসহ সকল পর্যায়ের পদ থেকে তাঁদের বহিষ্কার করা হয়। তৃতীয় ধাপে বহিষ্কৃতদের মধ্যে রংপুর বিভাগে রয়েছেন ১২, রাজশাহী বিভাগে চার, বরিশাল বিভাগে পাঁচ, ঢাকা বিভাগে চার, ময়মনসিংহ বিভাগে নয়, সিলেট বিভাগে সাত, চট্টগ্রাম বিভাগে এক, কুমিল্লা বিভাগে ছয় ও খুলনা বিভাগে চার জন। কেবল ফরিদপুর বিভাগে এ ধাপে কেউ বহিষ্কার হয়নি। বহিষ্কৃত ৫২ জনের মধ্যে চেয়ারম্যান ১৭, ভাইস চেয়ারম্যান ২৬ ও মহিলা ভাইস চেয়ারম্যান প্রার্থী নয় জন। তৃতীয় ধাপে মোট ১১২ উপজেলায় নির্বাচন হবে।

এর আগে প্রথম ধাপের উপজেলা নির্বাচনে চেয়ারম্যান ও ভাইস চেয়ারম্যান পদে ভোট করায় ৮০ নেতাকে দল থেকে বহিষ্কার করে বিএনপি। দ্বিতীয় ধাপে বহিষ্কার করা হয় ৬১ জনকে। প্রথম ধাপে ১৩৯ উপজেলায় বিএনপির ২৮ নেতা চেয়ারম্যান প্রার্থী হয়েছিলেন। তাদের মধ্যে জয়ী হন সাতজন।

উপজেলা নির্বাচনে বহিষ্কারের বিষয়ে বিএনপির সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবির রিজভী আহমেদ বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, ‘এ বহিষ্কার (দলে) কোনো নেতিবাচক প্রভাব ফেলবে না। কারণ বিএনপি দুই-আড়াই শ নেতা-কর্মীর দল নয়। যারা নির্বাচন করছেন, সেখানে একই মাপের একই যোগ্যতার অনেক নেতা আছেন।’ তিনি বলেন, ‘কিছু সুবিধাবাদী মনোবৃত্তির নেতা নির্বাচন করছেন ব্যক্তিগত স্বার্থে। বরং জাতির সামনে তাদের মুখোশ খুলে গেছে।’

নির্বাচন কমিশনের তফসিল অনুযায়ী, এবার কমবেশি ৪৮০ উপজেলায় চার ধাপে ভোট হবে। প্রথম ধাপে ভোট অনুষ্ঠিত হয় ৮ মে। এরপর দ্বিতীয় ধাপে ভোট হবে ২১ মে, ২৯ মে তৃতীয় ও ৫ জুন চতুর্থ ধাপের। ইতোমধ্যে সব ধাপের নির্বাচনের তফসিল ঘোষণা করা হয়েছে।

উপজেলা নির্বাচনে না যাওয়ার যুক্তি : আওয়ামী লীগ ও বিএনপির বাইরে রাজনীতিতে গুরুত্বপূর্ণ দলগুলো উপজেলা নির্বাচন করছে না। বিশেষ করে জামায়াতে ইসলামী ও চরমোনাইয়ের পীরের দল ইসলামী আন্দোলন নির্বাচন না করায় এ নির্বাচনে তেমন কোনো প্রতিদ্বন্দ্বিতাই হচ্ছে না। এ অবস্থায় উপজেলা নির্বাচনে অংশ নিলে বিএনপির সরকারবিরোধী আন্দোলন হালকা ও হাস্যকর হয়ে যাবে। এ ছাড়া গত ২৮ অক্টোবর ঢাকার মহাসমাবেশে সহিংসতার পর প্রায় ২৭ হাজার নেতা-কর্মীকে গ্রেফতার করা হয়। এখনো কয়েক হাজার নেতা-কর্মী কারাবন্দি। অসংখ্য মামলায় সারা দেশে লাখ লাখ নেতা-কর্মী আদালতে ঘুরছেন। এর বিরুদ্ধে বিএনপিসহ সব বিরোধী দল এখনো রাজপথে আন্দোলনে আছে। এ অবস্থায় উপজেলা নির্বাচনে বিএনপির অংশগ্রহণ আন্দোলনের নৈতিক অবস্থান আরও দুর্বল করবে।

বিএনপি নেতাদের মতে, জাতীয় সংসদের মতো উপজেলা নির্বাচনও আওয়ামী লীগের এক দলের নির্বাচনই হচ্ছে। সব উপজেলায় ক্ষমতাসীনদেরই একাধিক প্রার্থী রয়েছে।

সর্বশেষ খবর