শিরোনাম
মঙ্গলবার, ২১ মে, ২০২৪ ০০:০০ টা

ইরানের প্রেসিডেন্টের রহস্যময় মৃত্যু

হেলিকপ্টার বিধ্বস্তে পররাষ্ট্রমন্ত্রীসহ ৯ জন নিহত, দুর্ঘটনা নাকি হত্যা

নিজস্ব প্রতিবেদক

ইরানের প্রেসিডেন্টের রহস্যময় মৃত্যু

ইরানের প্রেসিডেন্ট ইব্রাহিম রাইসি ও পররাষ্ট্রমন্ত্রী আমির আবদুল্লাহিয়ান হেলিকপ্টার বিধ্বস্ত হয়ে মারা গেছেন। দুর্গম পাহাড়ি এলাকা থেকে তাঁদের লাশ উদ্ধার করা হয় ছবি : এএফপি ও ইরনা

ইরানে রহস্যজনক হেলিকপ্টার দুর্ঘটনায় দেশটির প্রেসিডেন্ট ইব্রাহিম রাইসি ও পররাষ্ট্রমন্ত্রী হোসেইন আমির আবদুুল্লাহিয়ানসহ নয় আরোহীই নিহত হয়েছেন। খারাপ আবহাওয়ার কথা বলা হলেও হেলিকপ্টার দুর্ঘটনার সঠিক কারণ জানা যায়নি। ইরান-ইসরায়েল টানটান উত্তেজনার মধ্যে এ দুর্ঘটনা ঘিরে তৈরি হয়েছে রহস্যের জাল।

বেল-২১২ মডেলের হেলিকপ্টারটি ছিল যুক্তরাষ্ট্রের তৈরি। দুর্ঘটনার পেছনে ইসরায়েলি গোয়েন্দা সংস্থা মোসাদের হাত আছে কি না, তা নিয়েও উঠেছে প্রশ্ন। এ দুর্ঘটনার পরিণতিতে আঞ্চলিক রাজনীতি ও সামরিক ক্ষেত্রে কোনো প্রেক্ষাপট তৈরি হয় কি না তা নিয়েও উদ্বেগ দেখা দিয়েছে। পশ্চিমা মহল বিষয়টির দিকে সতর্ক দৃষ্টি রাখছে। প্রেসিডেন্ট রাইসির মৃত্যুর পর দেশটিতে পাঁচ দিনের রাষ্ট্রীয় শোক ঘোষণা করেছেন সর্বোচ্চ ধর্মীয় নেতা আয়াতুল্লাহ আলি খামেনি। পাশাপাশি রাইসির মৃত্যুর পর ইরানের ভাইস প্রেসিডেন্ট মোহাম্মদ মোখবার অন্তর্বর্তীকালীন প্রেসিডেন্ট হিসেবে দায়িত্ব পালন করবেন বলে জানিয়েছেন তিনি। ইরানি গণমাধ্যম তাসনিম জানিয়েছে, হেলিকপ্টার দুর্ঘটনায় নিহত ইরানের প্রেসিডেন্ট ইব্রাহিম রাইসির দাফন আজ মঙ্গলবার তাবরিজে অনুষ্ঠিত হবে। প্রেসিডেন্টের পাশাপাশি তার নিহত সফরসঙ্গীদেরও সেখানেই সমাহিত করা হবে। এর আগে লাশগুলো তাবরিজের ফরেনসিক বিভাগে রাখা হবে। ইরানি সংবাদ মাধ্যম পার্স টুডের খবরে বলা হয়েছে, হেলিকপ্টার দুর্ঘটনায় ইরানের প্রেসিডেন্ট আয়াতুল্লাহ সাইয়্যেদ ইব্রাহিম রাইসি ও পররাষ্ট্রমন্ত্রী হোসেইন আমির আবদুুল্লাহিয়ান, পূর্ব আজারবাইজান প্রদেশের গভর্নর মালেক রাহমাতি এবং ওই প্রদেশে ইরানের সর্বোচ্চ নেতার মুখপাত্র আয়াতুল্লাহ মোহাম্মদ আলি আলে-হাশেম নিহত হয়েছেন। দুর্গম পাহাড়ি এলাকায় চরম দুর্যোগপূর্ণ আবহাওয়ার মধ্যে প্রায় ১৫ ঘণ্টা অনুসন্ধান কাজ চালানোর পর স্থানীয় সময় গতকাল সোমবার সকাল ৭টা নাগাদ ইরানের প্রেসিডেন্টকে বহনকারী হেলিকপ্টারটির ধ্বংসাবশেষের সন্ধান পাওয়া যায়। প্রাপ্ত ছবি ও ভিডিওতে দেখা গেছে, ঘন পাহাড়ি জঙ্গলে হেলিকপ্টারের ধ্বংসাবশেষ পড়ে রয়েছে। হেলিকপ্টারের পেছনের একটি অংশ ছাড়া বাকি পুরো অংশ আগুনে পুড়ে ভস্মীভূত হয়েছে।

ঘটনার আগের দিন রবিবার আজারবাইজানের সীমান্তবর্তী এলাকায় দুই দেশের যৌথভাবে নির্মিত একটি বাঁধ উদ্বোধন করতে গিয়েছিলেন প্রেসিডেন্ট ইব্রাহিম রাইসি। ওই অনুষ্ঠানে আজারবাইজানের প্রেসিডেন্ট ইলহাম আলিয়েভও ছিলেন। সেখান থেকে তিনটি হেলিকপ্টারের বহর নিয়ে ইরানের পূর্ব আজারবাইজান প্রদেশের রাজধানী তাবরিজে ফিরছিলেন রাইসি ও তার সঙ্গে থাকা অন্য কর্মকর্তারা। পথে পূর্ব আজারবাইজানের জোলফা এলাকার কাছে দুর্গম পাহাড়ে প্রেসিডেন্টকে বহনকারী হেলিকপ্টারটি বিধ্বস্ত হয়। অন্য দুটি হেলিকপ্টার নিরাপদে গন্তব্যে পৌঁছায়। প্রেসিডেন্টের হলিকপ্টারটিতে রাইসি ছাড়াও পররাষ্ট্রমন্ত্রী হোসেইন আমির আবদুল্লাহিয়ান, পূর্ব আজারবাইজান প্রদেশের গভর্নর মালেক রাহমাতি এবং এই প্রদেশে ইরানের সর্বোচ্চ নেতার মুখপাত্র আয়াতুল্লাহ মোহাম্মদ আলি আলে-হাশেম ছিলেন। হেলিকপ্টারের মোট নয় আরোহীর বাকি পাঁচ আরোহী হলেন ব্রিগেডিয়ার জেনারেল সাইয়্যেদ মেহদি মুসাভি (প্রেসিডেন্টের দেহরক্ষী), আনসারুল মাহদি বাহিনীর এক সদস্য, পাইলট, কো-পাইলট এবং ক্রু। তাদের সবার লাশ উদ্ধার করা হয়েছে।

ইরানি রেড ক্রিসেন্ট সোসাইটির প্রধান পির হোসেইন কোলিবান্দ জানিয়েছেন, হেলিকপ্টার বিধ্বস্তের ঘটনায় অনুসন্ধান অভিযান সমাপ্ত ঘোষণা করা হয়েছে।

ইরানের রাষ্ট্রীয় সংবাদমাধ্যমসহ অন্যান্য আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমের খবর অনুযায়ী, রাইসিকে বহনকারী হেলিকপ্টার বিধ্বস্তের ঘটনা ব্যাপক জল্পনা-কল্পনার জন্ম দিয়েছে। অনাকাক্সিক্ষত এ দুর্ঘটনা ঘিরে দেখা দিয়েছে নানা প্রশ্ন। প্রেসিডেন্টের মৃত্যুতে ইরানজুড়ে শোকের ছায়া নেমে এসেছে। এ ঘটনায় অনিশ্চয়তার কালো মেঘে ছেয়ে গেছে ইরান, যার প্রভাব মধ্যপ্রাচ্যজুড়ে ছড়িয়ে পড়তে পারে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে। প্রেসিডেন্ট রাইসির মৃত্যু কেবল ইরানের অভ্যন্তরীণ ক্ষমতার দ্বন্দ্বের সূত্রপাতই করবে না, বরং ওই অঞ্চলেও তাৎপর্যপূর্ণ নানা বিষয়ে প্রভাব ফেলতে পারে। চলমান বৈশ্বিক উত্তেজনা আর সংঘাতের মাঝে রাইসির মতো দাপুটে রাজনৈতিক নেতার অনুপস্থিতি ইরানের ভিতরে এবং বাইরে ক্ষমতার ভারসাম্যে ব্যাঘাত ঘটাতে পারে বলে মনে করছেন বিশ্লেষকরা।

ব্রিটিশ প্রভাবশালী সাময়িকী দ্য ইকোনমিস্টের এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ইরান এবং ইসরায়েলের চিরবৈরী সম্পর্কের প্রেক্ষাপটে এই হেলিকপ্টার দুর্ঘটনার পেছনে ইসরায়েল জড়িত থাকতে পারে বলে কিছু ইরানি সন্দেহ করছেন। দামেস্কে ইসরায়েল কর্তৃক একজন ইরানি জেনারেলকে হত্যা ও পরবর্তীতে ইসরায়েলে ইরানের শত শত ক্ষেপণাস্ত্র নিক্ষেপের ঘটনায় সৃষ্ট উত্তেজনার কারণেই এই তত্ত্বটি অনেকের মনোযোগ কেড়েছে। ইরানের স্বার্থের বিরুদ্ধে চোরাগোপ্তা এবং নিখুঁত অভিযান চালানোর জন্য ইসরায়েলের দুর্ধর্ষ গোয়েন্দা সংস্থা মোসাদের ব্যাপক পরিচিতি আছে। যদিও ইসরায়েলি এই গোয়েন্দা সংস্থা কখনোই কোনো রাষ্ট্রের প্রধানকে লক্ষ্যবস্তু বানায়নি।

ইকোনমিস্ট বলছে, রাইসিকে বহনকারী হেলিকপ্টার দুর্ঘটনায় ইসরায়েলের জড়িত থাকার বিষয়ে সন্দেহ করার জোড়ালো কারণ রয়েছে। তাছাড়া ইরানে হেলিকপ্টার বিধ্বস্তের এ ঘটনা এমন এক সময় ঘটেছে; যখন আঞ্চলিক উত্তেজনা আরও বাড়িয়ে তোলার মতো অনেক বিষয় রয়েছে। লেবানন, সিরিয়া, ইরাক এবং ইয়েমেনজুড়ে ইরানের প্রক্সি নেটওয়ার্ক ভূ-রাজনৈতিক পরিস্থিতিকে জটিল করে তুলছে। বিশেষ করে ইসরায়েল এবং হামাসের চলমান যুদ্ধের মাঝে আঞ্চলিক এ পরিস্থিতি অত্যন্ত ভয়াবহ এক প্রান্তে পৌঁছেছে। ইরানের নেতৃত্ব নিয়ে যেকোনো ধরনের অস্থিতিশীলতা তৈরি হলে তা এসব গোষ্ঠীকে সংঘাতের দিকে নিয়ে যেতে পারে।

ইসরায়েলের এক কর্মকর্তার দাবি, ইরানের প্রেসিডেন্ট ইব্রাহিম রাইসির নিহত হওয়ার সঙ্গে ইসরায়েল জড়িত নয়। নাম প্রকাশ না করার শর্তে ওই কর্মকর্তার উদ্ধৃতি, ‘আমরা জড়িত নই’। রবিবার রাতে প্রেসিডেন্ট রাইসিসহ ইরানের জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তাদের বহনকারী হেলিকপ্টার বিধ্বস্ত হওয়ার পর থেকেই সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে রটতে থাকে, এই ঘটনার সঙ্গে মোসাদ জড়িত। এর পরিপ্রেক্ষিতেই ইসরায়েলের ওই কর্মকর্তা এমন দাবি করেন।

ইরানের প্রেসিডেন্ট ও পররাষ্ট্রমন্ত্রীকে নিয়ে বিধ্বস্ত হওয়া যুক্তরাষ্ট্রের তৈরি বেল-২১২ মডেলের হেলিকপ্টারটির বয়স কত ছিল তা স্পষ্ট নয় বলে দাবি করেছে বিবিসি। তবে এই মডেলটি কানাডিয়ান সামরিক বাহিনীর জন্য ১৯৬০-এর দশকে তৈরি করা হয়েছিল। ১৯৭৯ সালের ইরানি বিপ্লবের পর তেহরানের বিরুদ্ধে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও আন্তর্জাতিক নিষেধাজ্ঞার দশক শুরু হয়েছিল। ওই সময়ের পর ইরানের কাছে কোনো সামরিক অস্ত্র বিক্রি করেনি যুক্তরাষ্ট্র।

যুক্তরাষ্ট্রের হেলিকপ্টার প্রস্ততকারক কোম্পানি বেল ওই হেলিকপ্টারটি তৈরি করেছিল। মার্কিন আইন প্রয়োগকারী সংস্থা, থাইল্যান্ডের জাতীয় পুলিশসহ বিশ্বের বিভিন্ন দেশের সরকারি-বেসরকারি অনেক সংস্থা ব্যাপকভাবে এ হেলিকপ্টার ব্যবহার করে। ফ্লাইট গ্লোবালের ২০২৪ সালের ওয়ার্ল্ড এয়ার ফোর্সেস ডিরেক্টরি অনুযায়ী, ইরানের নৌ ও বিমানবাহিনীর বহরে বেল-২১২ মডেলের মোট ১০টি হেলিকপ্টার রয়েছে। তবে ইরান সরকার এসব হেলিকপ্টারের মধ্যে কয়টি পরিচালনা করে আসছে তা পরিষ্কার নয়। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের তৈরি এই হেলিকপ্টার মানুষ ও মালামাল পরিবহনের পাশাপাশি যুদ্ধের সময় অস্ত্র সরঞ্জামও বহন করা যায়।

ইরানের রাষ্ট্রীয় বার্তা সংস্থা আইআরএনএ বলেছে, প্রেসিডেন্টকে বহনকারী এই হেলিকপ্টার ছয়জন যাত্রী ও দুজন ক্রু পরিবহন করতে পারে। বিমান দুর্ঘটনার তথ্য সংগ্রহকারী অলাভজনক সংস্থা ফ্লাইট সেইফটি ফাউন্ডেশন বলছে, গত বছরের সেপ্টেম্বরে বেল-২১২ মডেলের একটি হেলিকপ্টার দুর্ঘটনার কবলে পড়েছিল। ওই সময় সংযুক্ত আরব আমিরাতের উপকূলীয় এলাকায় বেসরকারিভাবে পরিচালিত বেল-২১২ মডেলের একটি হেলিকপ্টার বিধ্বস্ত হয়। এর আগে ইরানে সর্বশেষ বেল-২১২ মডেলের একটি হেলিকপ্টার দুর্ঘটনার কবলে পড়ে ২০১৮ সালের এপ্রিলে। ওই সময় হৃদরোগে আক্রান্ত এক রোগীকে হাসপাতালে নেওয়ার পথে বিধ্বস্ত হয় হেলিকপ্টারটি।

হেলিকপ্টার দুর্ঘটনায় ইরানের প্রেসিডেন্ট ইব্রাহিম রাইসি নিহত হওয়ায় ভাইস প্রেসিডেন্ট মোহাম্মদ মোখবারকে প্রেসিডেন্ট হিসেবে অন্তর্বর্তীকালীন দায়িত্ব পালনের জন্য নিযুক্ত করেছেন দেশটির সর্বোচ্চ নেতা আয়াতুল্লাহ আলি খামেনি। এক বিবৃতিতে তিনি বলেছেন, দেশের সংবিধান অনুযায়ী মোখবারকে নির্বাহী বিভাগের নেতৃত্ব দেওয়ার দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে। এ ছাড়া প্রেসিডেন্ট নির্বাচন আয়োজনে তিনি আইন ও বিচার বিভাগীয় প্রধানদের সঙ্গে কাজ করবেন। ইব্রাহিম রাইসির উত্তরসূরি বেছে নিতে প্রেসিডেন্ট নির্বাচন অনুষ্ঠানের জন্য ইরানের হাতে সর্বোচ্চ ৫০ দিন সময় আছে।

সর্বশেষ খবর