সোমবার, ২২ জুলাই, ২০২৪ ০০:০০ টা

মেধায় নিয়োগ ৯৩ শতাংশ

♦ হাই কোর্টের রায় বাতিল ♦ মুক্তিযোদ্ধার সন্তান ৫, নেই নাতি-নাতনিরা, ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠী ১, প্রতিবন্ধী ও তৃতীয় লিঙ্গ ১ শতাংশ কোটা ♦ সরকার চাইলে পরিবর্তন করতে পারবে ♦ শিক্ষার্থীদের ঘরে ফেরার আহ্বান ♦ মুক্তিযোদ্ধাদের অসম্মান কাম্য নয় মন্তব্য আপিল বিভাগের

নিজস্ব প্রতিবেদক

মেধায় নিয়োগ ৯৩ শতাংশ

সরকারি চাকরিতে ৫৬ শতাংশ কোটার পরিবর্তে মাত্র ৭ শতাংশ কোটা নির্ধারণ করে রায় দিয়েছেন সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগ। রায়ে মেধার ভিত্তিতে ৯৩ শতাংশ; মুক্তিযোদ্ধা, শহীদ মুক্তিযোদ্ধা ও বীরাঙ্গনার সন্তানদের জন্য ৫ শতাংশ; ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠী ১ শতাংশ এবং প্রতিবন্ধী ও তৃতীয় লিঙ্গের জনগোষ্ঠীর জন্য ১ শতাংশ কোটা নির্ধারণ করে দেওয়া হয়েছে। তবে সরকার প্রয়োজন ও সার্বিক বিবেচনায় আদালত নির্ধারিত কোটা বাতিল, সংশোধন বা সংস্কার করতে পারবে বলেও রায়ে উল্লেখ করেছেন আপিল বিভাগ। কোটা নিয়ে হাই কোর্টের দেওয়া রায় বাতিল করে গতকাল প্রধান বিচারপতি ওবায়দুল হাসানের নেতৃত্বে সাত বিচারপতির আপিল বেঞ্চ এ রায় দেন। সারা দেশে চলমান কারফিউর মধ্যেই গতকাল এ রায় দেন আদালত। ঘোষিত সংক্ষিপ্ত রায়ের কার্যকরী অংশের অনুলিপি বিকালে সরকারের মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ, সংস্থাপন মন্ত্রণালয়ে পাঠানো হয়েছে। পাশাপাশি অ্যাটর্নি জেনারেলসহ মামলা সংশ্লিষ্ট আইনজীবীদেরও পৌঁছে দেওয়া হয়েছে রায়ের অনুলিপি।

রায় ও আদেশের পর শিক্ষার্থীরা কোটা সংস্কার সংক্রান্ত চলমান কর্মসূচি প্রত্যাহার করবে বলে দৃঢ়ভাবে প্রত্যাশা করেছেন আদালত। বেঞ্চের অন্য ছয় বিচারপতি হলেন- বিচারপতি এম ইনায়েতুর রহিম, বিচারপতি মো. আশফাকুল ইসলাম, বিচারপতি মো. আবু জাফর সিদ্দিকী, বিচারপতি জাহাঙ্গীর হোসেন, বিচারপতি মো. শাহিনুর ইসলাম ও বিচারপতি কাশেফা হোসেন। সরকারি চাকরিতে কোটার রায় ঘোষণাকে কেন্দ্র করে গতকাল সকাল থেকেই সুপ্রিম কোর্ট এলাকায় কঠোর নিরাপত্তাবলয় গড়ে তোলা হয়। গুলিস্তান, মৎস্য ভবন, দোয়েল চত্বর এলাকা থেকেই সুপ্রিম কোর্টমুখী যানবাহন আটকে দেয় সেনাসদস্যরা। তবে পরিচয় নিশ্চিত হয়েই তাদের সুপ্রিম কোর্ট এলাকায় প্রবেশ করতে দেওয়া হয়েছে। এদিন আইনজীবী ও গণমাধ্যম কর্মীদের প্রবেশের জন্য শুধু সুপ্রিম কোর্টের মাজার গেট খোলা রাখা হয়। এই গেট দিয়ে প্রবেশের সময় সবার পরিচয়পত্র দেখতে চাওয়ার পাশাপাশি তল্লাশিও করা হয়। এদিন সকাল থেকেই সুপ্রিম কোর্টের সবগুলো গেটে সেনাবাহিনীর এপিসির অবস্থান দেখা যায়।

রায় ঘোষণার আগে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে শিক্ষার যথাযথ পরিবেশ সৃষ্টি করে শিক্ষার্থীদের নিজ নিজ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে অবিলম্বে ফিরে গিয়ে পড়াশোনায় মনোনিবেশ করার জন্য আহ্বান জানান আপিল বিভাগ। একই সঙ্গে দেশের সব বিশ্ববিদ্যালয়, স্কুল, কলেজ ও মাদরাসা প্রধানদের প্রতি অনতিবিলম্বে শিক্ষার পরিবেশ তৈরি করে ছাত্রছাত্রীদের স্ব স্ব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ফিরিয়ে নেওয়ার জন্য যথাযথ উদ্যোগ গ্রহণ এবং সন্তানদের ঘরে ফিরিয়ে নিতে অভিভাবকদের প্রতি আহ্বান জানান আদালত। এ ছাড়া শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে অনুকূল পরিবেশ তৈরিতে সাহায্য করতে আদালত সরকারের প্রতিও আহ্বান জানান।

আদালতে রাষ্ট্রপক্ষে অ্যাটর্নি জেনারেল এ এম আমিন উদ্দিন, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের দুই শিক্ষার্থীর পক্ষে আইনজীবী শাহ মঞ্জুরুল হক, রিটকারীদের পক্ষে আইনজীবী মনসুরুল হক চৌধুরী শুনানি করেন। এ ছাড়া আগ্রহের ভিত্তিতে আদালত সুপ্রিম কোর্ট আইনজীবী সমিতির সভাপতি ব্যারিস্টার এ এম মাহবুব উদ্দিন খোকন, সিনিয়র আইনজীবী জয়নুল আবেদীন, সাবেক অ্যাটর্নি জেনারেল এ এফ এম হাসান আরিফ, সিনিয়র আইনজীবী জেড আই খান পান্না, ব্যারিস্টার সারা হোসেন, ব্যারিস্টার তানিয়া আমীর, ব্যারিস্টার তানজীব-উল আলম, ব্যারিস্টার আহসানুল করিমের বক্তব্য শোনেন আপিল বিভাগ। রায় শুনতে আদালতে বীর মুক্তিযোদ্ধা বঙ্গবীর কাদের সিদ্দিকী ও সাবেক মন্ত্রী বীর মুক্তিযোদ্ধা আবদুল লতিফ সিদ্দিকী উপস্থিত ছিলেন।

রায় ঘোষণার আগে সাধারণ ছুটি ও অস্বাভাবিক পরিস্থিতি ও কারফিউর মধ্যে আদালতে উপস্থিত হওয়ার জন্য সবাইকে ধন্যবাদ জানান আপিল বিভাগ। আদালত বলেন, এই উপস্থিতি প্রমাণ করে বিচার বিভাগের প্রতি আপনাদের আস্থা ও সহযোগিতা রয়েছে। পরে আদালত বলেন, পূর্ণাঙ্গ রায় পেতে সময় লাগবে। তবে আমরা রায়ের কার্যকরি অংশ ঘোষণা করছি। তবে রায় ঘোষণার আগে আমাদের কিছু কথা রয়েছে।

এ সময় আপিল বিভাগ বলেন, গত ১০ জুলাই প্রদত্ত এক আদেশে অত্র আদালত হাই কোর্ট বিভাগ কর্তৃক রিট পিটিশন নম্বর- ৬০৬৩/২০২১ এ প্রদত্ত রায়ে স্থিতাবস্থা প্রদান এবং এর কার্যক্রম স্থগিত করে অন্তর্বর্তীকালীন আদেশ প্রদান করেছিল। অর্থাৎ এই অন্তর্বর্তী আদেশের ফলে ২০১৮ সালে সরকার কর্তৃক জারিকৃত কোটা বাতিল সংক্রান্ত পরিপত্রটি স্বয়ংক্রিয়ভাবে কার্যকর হয়ে যায়। কিন্তু এই আদেশটির অর্থ আমাদের শিক্ষার্থী ছেলেমেয়েরা সঠিকভাবে অনুধাবন করতে পারেনি। ফলে অনাকাক্সিক্ষত ঘটনার সৃষ্টি হয়েছে। ঝরে গেছে অনেক প্রাণ, যা মোটেই কাম্য ছিল না।

আদালত বলেন, অত্র আদালত কোটা সংস্কার দাবিতে আন্দোলনকারী ছাত্রদের আদালতে এসে তাদের আইনজীবীর মাধ্যমে বক্তব্য তুলে ধরার আহ্বান জানিয়েছিল। কিন্তু তারা বক্তব্য উপস্থাপনের জন্য আদালতে আসেনি। তবে সাধারণ ছাত্রদের পক্ষ থেকে দুজন ছাত্র আন্দোলনরত ছাত্রদের পক্ষে অত্র আদালতে হাই কোর্ট বিভাগের রিট পিটিশন নম্বর ৬০৬৩/২০২১ এ প্রদত্ত রায়ের সঠিকতা চ্যালেঞ্জ করেছেন। সরকারও হাই কোর্ট বিভাগের ওই রায় ও আদেশ চ্যালেঞ্জ করেছেন। এই দুই আবেদনের বক্তব্য এবং বিভিন্ন প্রচার মাধ্যমে পাওয়া কোটা সংস্কারের দাবিতে আন্দোলনে থাকা শিক্ষার্থীদের বক্তব্য এই আদালতের কাছে সমার্থক বা একই বলে মনে হয়।

রায়ের পর্যবেক্ষণে আদালত বলেন, অত্র আদালত অবগত আছে যে, সরকার ইতোমধ্যে হাই কোর্ট বিভাগের একজন বিচারপতির নেতৃত্বে একটি বিচার বিভাগীয় তদন্ত কমিশন গঠন করেছে, যিনি ইতোমধ্যেই কার্যভার গ্রহণ করেছেন। সরকারের প্রতি আহ্বান থাকবে, তারা যেন এই তদন্ত কমিশনকে সঠিকভাবে দায়িত্ব পালন করার ক্ষেত্রে প্রয়োজনীয় সহযোগিতা প্রদান করেন। আদালত বলেন, আদালত আশা করে, তদন্ত কমিশন প্রত্যেকটি ছাত্রের মৃত্যুর কারণ উদঘাটন করে দায়ী ব্যক্তিদের চিহ্নিত করবে এবং কমিশনের প্রতিবেদনের ভিত্তিতে সরকার দায়ী ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে প্রয়োজনীয় আইনগত ব্যবস্থা গ্রহণ করবে।

রায়ে আদালত বলেন, হাই কোর্ট বিভাগে রিট পিটিশন নম্বর- ৬০৬৩/২০২১ (কোটা সংশ্লিষ্ট রায়) এ প্রদত্ত গত ৫ জুন ২০২৪ তারিখের তর্কিত রায় ও আদেশ সামগ্রিকভাবে রদ (বাতিল) ও রহিত করা হলো। রায়ে বলা হয়, যদিও কোটা নির্ধারণের বিষয়টি রাষ্ট্রের পলিসি ম্যাটার বা নীতি নির্ধারণী বিষয়। এর পরেও সংবিধানের ১০৪ অনুচ্ছেদে প্রদত্ত এখতিয়ার বলে এবং সার্বিক ও যৌক্তিক বিবেচনায় সম্পূর্ণ ন্যায় বিচারের স্বার্থে সংবিধানের ১৯, ২৭, ২৮ (৪), ২৯ (১) ও ২৯ (৩) অনুচ্ছেদে বির্ধৃত সমতার নীতি ও অনগ্রসর জনগোষ্ঠীর প্রজাতন্ত্রের কর্মে প্রতিনিধিত্ব লাভ নিশ্চিতকরণের প্রতি লক্ষ্য রেখে সরকারের বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে অর্থাৎ সরকারি, আধাসরকারি, স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠানের চাকরিতে নিয়োগ পাওয়ার জন্য কোটা প্রথা হিসেবে মেধাভিত্তিক ৯৩ শতাংশ; মুক্তিযোদ্ধা, শহীদ মুক্তিযোদ্ধা ও বীরাঙ্গনার সন্তানগণের জন্য ৫ শতাংশ; ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠী ১ শতাংশ এবং প্রতিবন্ধী ও তৃতীয় লিঙ্গের জন্য ১ শতাংশ নির্ধারণ করিল। তবে নির্ধারিত কোটায় যোগ্য প্রার্থী না পাওয়া গেলে সংশ্লিষ্ট কোটার শূন্য পদসমূহে সাধারণ মেধা তালিকা থেকে পূরণ করতে হবে। এই নির্দেশনার আলোকে সরকারের নির্বাহী বিভাগকে এই মর্মে অনতিবিলম্বে গেজেট বা প্রজ্ঞাপন জারির নির্দেশ দেওয়া হলো। এই আদেশের অনুলিপি অবিলম্বে সংশ্লিষ্ট পক্ষগণের অবগতি ও কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য প্রেরণ করতে বলা হয় রায়ে।

নবম গ্রেড (পূর্বতন প্রথম শ্রেণি) ও ১০ম থেকে ১৩তম গ্রেডের (পূর্বতন দ্বিতীয় শ্রেণি) পদে সরাসরি নিয়োগের ক্ষেত্রে বিদ্যমান কোটা পদ্ধতি বাতিল করে ২০১৮ সালে সরকার পরিপত্র জারি করে। ২০১৮ সালের ৪ অক্টোবর জারি করা এ পরিপত্র চ্যালেঞ্জ করে ২০২১ সালে রিট দায়ের করেন অহিদুল ইসলামসহ সাত শিক্ষার্থী। একই বছরের ৭ ডিসেম্বর হাই কোর্ট রুল জারি করেন। ওই রুলের চূড়ান্ত শুনানি শেষে চলতি বছরের ৫ জুন রায় দেন হাই কোর্ট। হাই কোর্টের রায়ের পর কোটা বাতিল চেয়ে শিক্ষার্থীরা আন্দোলনে নামে।

এরপর ওই রায় স্থগিত চেয়ে রাষ্ট্রপক্ষ আপিল বিভাগে আবেদন করে। পরে গত ৯ জুলাই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের দুই শিক্ষার্থীও আপিল বিভাগে আবেদন করেন। ওইদিনই আপিল বিভাগের পূর্ণাঙ্গ বেঞ্চে সেই আবেদনের শুনানির জন্য ১০ জুলাই দিন ধার্য করেন চেম্বার আদালত। পরে ১০ জুলাই মুক্তিযোদ্ধা কোটা বাতিল করে জারি করা পরিপত্র অবৈধ ঘোষণা করে হাই কোর্টের দেওয়া রায়ের বিষয়ে চার সপ্তাহের স্থিতাবস্থা দেন প্রধান বিচারপতি ওবায়দুল হাসানের নেতৃত্বাধীন সুপ্রিম কোর্টের পাঁচ সদস্যের আপিল বেঞ্চ। ৭ আগস্ট এ বিষয়ে পরবর্তী শুনানি হবে বলে দিন ঠিক করে দেন আপিল বিভাগ। এর মধ্যে গত ১৪ জুলাই হাই কোর্টের রায়ের ২৭ পৃষ্ঠা পূর্ণাঙ্গ অনুলিপি প্রকাশ করেন হাই কোর্ট। এদিকে দেশব্যাপী জোড়ালো হতে থাকে শিক্ষার্থীদের আন্দোলন।

এই আন্দোলনের মধ্যে হাই কোর্টের দেওয়া রায়ের বিরুদ্ধে গত মঙ্গলবার রাষ্ট্রপক্ষ ও বৃহস্পতিবার ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের দুই শিক্ষার্থীর পক্ষে লিভ টু আপিল আবেদন করা হয় আপিল বিভাগে। পরে বৃহস্পতিবার সন্ধ্যায় বিশেষ চেম্বার জজ আদালত বসিয়ে দুই আবেদন পূর্ণাঙ্গ বেঞ্চে শুনানির জন্য রবিবার দিন ঠিক করে দেন আপিল বিভাগের চেম্বার বিচারপতি এম ইনায়েতুর রহিম।

সর্বশেষ খবর