সোমবার, ২২ জুলাই, ২০২৪ ০০:০০ টা

দীর্ঘ শুনানিতে নানা কথা

আরাফাত মুন্না

সরকারি চাকরিতে কোটা বহাল রেখে হাই কোর্টের দেওয়া রায়ের বিরুদ্ধে করা আপিল শুনানিতে বক্তব্য রেখেছেন ১১ জন আইনজীবী। তাদের বক্তব্যে উঠে এসেছে কোটা নিয়ে নানা কথা। আইনজীবীদের প্রায় সবারই শুনানির শেষ কথা ছিল হাই কোর্টের রায় বাতিল। দুই আইনজীবী মত দিয়েছেন কোটা সংস্কারের পক্ষে। কোটা বহালের রায় বাতিল চেয়ে রাষ্ট্রপক্ষ ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের দুই শিক্ষার্থীর পক্ষে করা আবেদনের শুনানিতে তারা এমন মতামত দেন। প্রধান বিচারপতি ওবায়দুল হাসানের নেতৃত্বাধীন সাত বিচারপতির পূর্ণাঙ্গ বেঞ্চে এই দুই আবেদনের শুনানি হয়। সকাল ১০টা ১৭ মিনিট থেকে টানা দুপুর ১২টা ৫৫ মিনিট পর্যন্ত শুনানি চলে এই দুই আবেদনের। বিরতীর পর দুপুর ১টা ২৯ মিনিটে আপিল বিভাগের বিচারপতিরা এজলাসে ফিরে রায় ঘোষণা করেন।

আদালতে রাষ্ট্রপক্ষে শুনানি করেন অ্যাটর্নি জেনারেল এ এম আমিন উদ্দিন। রিটকারী পক্ষে শুনানি করেন আইনজীবী মনসুরুল হক চৌধুরী। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের দুই শিক্ষার্থীর পক্ষে শুনানি করেন আইনজীবী শাহ মঞ্জুরুল হক। এ ছাড়া কোটা এবং কোটা নিয়ে হাই কোর্টের রায়, আদালতের এখতিয়ার নিয়ে মতামত তুলে ধরেন জ্যেষ্ঠ আইনজীবী এ এফ হাসান আরিফ, জেড আই খান পান্না, জয়নুল আবেদীন, সুপ্রিম কোর্ট আইনজীবী সমিতির সভাপতি ব্যারিস্টার এ এম মাহবুব উদ্দিন খোকন, ব্যারিস্টার আহসানুল করিম, ব্যারিস্টার তানিয়া আমীর, ব্যারিস্টার সারা হোসেন ও আইনজীবী তানজীব-উল আলম।

দীর্ঘ প্রায় ১ ঘণ্টা শুনানিতে অ্যাটর্নি জেনারেল এ এম আমিন উদ্দিন বলেন, স্বাধীন বাংলাদেশে ১৯৭২ সালের ৫ আগস্ট প্রথম কোটাপদ্ধতি চালু করা হয়। পরবর্তীতে মুক্তিযোদ্ধাদের সন্তানদের জন্য ৩০ শতাংশ কোটা সংরক্ষণ করে সরকার। ২০১৩ সালে আপিল বিভাগ যখন ৩০ শতাংশ কোটা সংরক্ষণের সিদ্ধান্ত দেন তখন কোটাপদ্ধতি ছিল। ২০১৮ সালে সরকার প্রথম ও দ্বিতীয় শ্রেণির কোটাপদ্ধতিটিই বাতিল করে দেয়। অর্থাৎ সরকারের নীতিগত সিদ্ধান্ত হচ্ছে কোটা থাকবে না। হাই কোর্ট এখন যখন কোটা সংরক্ষণের বিষয়ে রায় দিলেন তখন তো কোটাপদ্ধতিই নেই এবং আপিল বিভাগের সর্বশেষ (২০২২ সালের রায় অনুসারে) সিদ্ধান্ত অনুসারে সরকারের নীতিগত সিদ্ধান্তে আদালত হস্তক্ষেপ করতে পারে না। এমনকি নীতিগত সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষেত্রে আদালত কোনো পরামর্শও দিতে পারে না, যদি না সে সিদ্ধান্ত নাগরিকের মৌলিক অধিকার ক্ষুণœ করে, সংবিধানকে লঙ্ঘন করে। ফলে হাই কোর্টের রায়টি (গত ৫ মে কোটা পুনর্বহালের রায়) বাতিল করা হোক।

আইনজীবী শাহ মঞ্জুরুল হক অ্যাটর্নি জেনারেলের বক্তব্যে সমর্থন জানিয়ে বলেন, হাই কোর্ট রায়ে বলার চেষ্টা করেছেন যে, মুক্তিযোদ্ধারা অনগ্রসর অংশ। কিন্তু মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য কোটা বরাদ্দ করা হয়েছে বিশেষ মর্যাদায়। অনগ্রসর হিসেবে নয়। মুক্তিযোদ্ধারা কখনোই অনগ্রর হতে পারেন না। তারা জাতির শ্রেষ্ঠ সন্তান এবং সবচেয়ে অগ্রগামী অংশ। তাছাড়া সংবিধানের কোথাও মুক্তিযোদ্ধাদের অনগ্রসর হিসেবে বর্ণনা করা হয়নি। বরং বিশেষ মর্যাদা দেওয়া হয়েছে। ফলে আমি কোটা বহাল রেখে হাই কোর্টের দেওয়া রায় বাতিল চাচ্ছি। পাশাপাশি কোটা যৌক্তিক সংস্কার চাচ্ছি। সংবিধানের ১০৪ অনুচ্ছেদ অনুসারে ন্যায়বিচারের স্বার্থে সর্বোচ্চ আদালত সে আদেশ দিতে পারেন।

রিটকারী পক্ষের আইনজীবী মনসুরুল হক চৌধুরী শুনানিতে বলেন, ১৯৭৫ সালে মুক্তিযোদ্ধাদের কোটা সুবিধা দেওয়া হলেও পঁচাত্তরে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে হত্যার পর ১৯৯৬ সাল পর্যন্ত দীর্ঘ ২১ বছর এই কোটার কোনো বাস্তবায়ন ছিল না। বরং মুক্তিযোদ্ধার সন্তান পরিচয় ছিল অযোগ্যতা। মুক্তিযোদ্ধার একজন সন্তানও এই সময়ে চাকরি পায়নি। মুক্তিযুদ্ধ করেছে এ দেশের কৃষক, শ্রমিক মেহনতি মানুষ। তারা জীবন দিয়ে, রক্ত দিয়ে এ দেশের স্বাধীনতা এনেছেন। মুক্তিযুদ্ধে সবচেয়ে ক্ষতি তাদের হয়েছে। তারা কেউ আদরের দুলাল ছিলেন না। সংবিধানে না থাকলেও সে বিবেচনায় তারা জাতির অনগ্রসর অংশ। যাই হোক, ১৯৯৬ সালে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় এসে মুক্তিযোদ্ধার সন্তানদের জন্য ৩০ শতাংশ কোটা সংরক্ষণ করে। মানছি কোটাপদ্ধতি রাখা না রাখা সরকারের নীতিগত সিদ্ধান্তের বিষয়। কিন্তু ২০১৮ সালে সরকার প্রথম ও দ্বিতীয় শ্রেণির চাকরির ক্ষেত্রে কোটা বাতিল করে আর সব শ্রেণির চাকরিতে কোটা বহাল রাখল। এটা হতে পারে না। সরকারের এরকম নীতিগত সিদ্ধান্ত কতটুকু যৌক্তিক? ২০১৮ সালে কোটা বাতিলের ক্ষেত্রে ন্যূনতম কারণ তো থাকা দরকার ছিল।

জ্যেষ্ঠ আইনজীবী এ এফ হাসান আরিফ শুনানিতে বলেন, কোটাপদ্ধতি নিয়ে হাই কোর্ট তার রায়ে সরকারের নীতি-নির্ধারণী বিষয়ে হস্তক্ষেপ করেছেন। কিন্তু এ হস্তক্ষেপের বিষয়ে রায়ে কোনো যৌক্তিক ব্যাখ্যা দেওয়া হয়নি। ফলে রায়টি বাতিল করা হোক।

আইনজীবী আহসানুল করিম তার মতামত তুলে ধরে শুনানিতে বলেন, আমাদের সংবিধান যারা প্রণয়ন করেছেন, তারা কখনোই মুক্তিযোদ্ধাদের অনগ্রসর অংশ হিসেবে বিবেচনা করেননি। সেজন্য তাদের অনগ্রসর অংশ হিসেবে বিবেচনা করার সুযোগ নেই। কোটা ও মেধার মধ্যে দ্বন্দ্ব দেখা দিলে মেধাই প্রাধান্য পাবে। আর কোটা বাতিল সংস্কারেরই অংশ। ১৯৪৭ সালে স্বাধীনতার পর ভারতেও মুক্তিযোদ্ধা কোটা ছিল। কিন্তু সেখানে তাদের অনগ্রসর হিসেবে বিবেচনা করা হয়নি। বরং সবচেয়ে অগ্রগামী হিসেবে বিবেচিত হয়েছিল। তাছাড়া কোনো নাগরিক নীতি-নির্ধারণী বিষয়ে কোনো কিছু নির্ধারণ করে দিতে পারে না। 

মুক্তিযোদ্ধাদের নাতি-নাতনির কোটা সুবিধা দেওয়া নিয়ে আইনজীবী তানিয়া আমীর বলেন, যাদের জন্মই হয়নি তারা কীভাবে অনগ্রসর হয়? তাছাড়া মুক্তিযোদ্ধা কখনোই অনগ্রসর হতে পারেন না। যদি তা না হয় তাহলে মুক্তিযোদ্ধাদের সন্তান বা নাতি-নাতনি কীভাবে অনগ্রসর হন? মুক্তিযোদ্ধারা যদি অনগ্রসর না হন, তাহলে হাই কোর্ট যে রিট আবেদনের ওপর রায় দিয়েছেন সে রিটটিই মেইনেটনেবল না। কারণ যিনি বা যারা রিট করেছেন তাদের এই রিট করেছেন তারা কেউই অনগ্রসর অংশ নন এবং তাদের রিট করারই এখতিয়ার নেই। ফলে রায়টি বাতিল করা হোক।

আইনজীবী সারা হোসেন বলেন, কোটা সরকারের নীতি-নির্ধারণী বিষয় হলেও সামাজিক-অর্থনৈতিক বিষয়টি খেয়াল রাখতে হবে। বৈষম্য না রাখার কথা সংবিধানে উল্লেখ করা হয়েছে। কোটা থাকতে পারে তবে সংস্কারের ক্ষমতা সরকারের হাতে থাকতে হবে। ন্যায়বিচারের ক্ষেত্রে সামাজিক ও অর্থনৈতিক পরিস্থিতি বাস্তবতা বিবেচনায় নিতে হবে। কোটার মতো নীতি নির্ধারণী বিষয়ে সরকারকে সুনির্দিষ্ট পদ্ধতি অবলম্বর করা উচিত।  

আপিলের অনুমতি না দিয়ে (লিভ টু আপিল গ্রহণ না করে) হাই কোর্টের রায়ের ওপর চূড়ান্ত শুনানি করা যায় কিনা সে প্রশ্নে জ্যেষ্ঠ আইনজীবী তানজীব-উল আলম শুনানিতে বলেন, আপিল বিভাগে হাই কোর্টের রায়ের বিরুদ্ধে শুনানি করতে হলে আগে আপিলের অনুমতি পেতে হয়। অনুমতি পাবে কি পাবে না, এই প্রশ্নে আপিল বিভাগে কোনো শুনানিই হয়নি। যেহেতু বিষয়টি জরুরি তাই হাই কোর্টের রায় নিয়ে সরাসরি শুনানি হচ্ছে। ফলে প্রশ্ন উঠতে পারে লিভ টু আপিল গ্রহণ না করেই সর্বোচ্চ আদালত হাই কোর্টের রায়ের ওপর সিদ্ধান্ত দিয়েছে। আমি মনে করি লিভ টু আপিল গ্রহণ না করেই হাই কোর্টের রায় নিয়ে আপিল বিভাগে শুনানি হতে পারে। এমনকি হাই কোর্টের রায় বাতিলও করতে পারে।

তিনি বলেন, কোটা নিয়ে হাই কোর্ট যে বিষয়ে রুল জারি করেছিল তার বাইরে গিয়ে রায় দিয়েছেন হাই কোর্ট। আর নীতি নির্ধারণী বিষয়ে সরকারকে কোনো পরামর্শ দিতে পারে না হাই কোর্ট। সুতরাং রায়টি বাতিল করা উচিত। শুনানিতে জ্যেষ্ঠ জয়নুল আবেদীন ও সুপ্রিম কোর্ট আইনজীবী সমিতির সভাপতি এ এম মাহবুব উদ্দিন খোকন অ্যাটর্নি জেনারেলের বক্তব্যে একমত পোষণ করে মতামত দেন।

এই রকম আরও টপিক

সর্বশেষ খবর