শিরোনাম
মঙ্গলবার, ১৩ আগস্ট, ২০২৪ ০০:০০ টা
প্রধান উপদেষ্টার সঙ্গে বৈঠক

আগে সংস্কার পরে নির্বাচন

ইউনূস সরকারে আস্থা দলগুলোর, সময় দিতে সম্মতি ♦ নির্বাচন নিয়ে কথা হয়নি, পরিবেশ তৈরিতে আগেই সময় দেওয়ার কথা জানিয়েছি : ফখরুল আওয়ামী লীগ শেষ সময়ে অনেক ভুল কাজ করেছে : শফিকুর ♦ ১৫ আগস্ট শোক দিবস পালন বাতিলের দাবি জানিয়েছি : নূর

নিজস্ব প্রতিবেদক

আগে সংস্কার পরে নির্বাচন

প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূসের সঙ্গে গতকাল বৈঠক শেষে সাংবাদিকদের সঙ্গে কথা বলেন বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর, জামায়াতে ইসলামীর আমির ডা. শফিকুর রহমান ও গণ অধিকার পরিষদের নেতা নুরুল হক নূর -বাংলাদেশ প্রতিদিন

এখনই নির্বাচন নয়। আগে রাষ্ট্র ও প্রশাসনের কাঠামোগত সংস্কার চাইছে বিএনপিসহ সমমনা রাজনৈতিক দলগুলো। অন্তর্বর্তী সরকারকে নির্বাচনের উপযুক্ত পরিবেশ তৈরি করতে প্রয়োজনীয় সময় দেওয়া হবে। পরবর্তী জাতীয় সংসদ নির্বাচন অবাধ ও সুষ্ঠু করতে নির্বাচন কমিশনসহ সংশ্লিষ্ট সব প্রতিষ্ঠানের সংস্কার আনতে যে সময়ের প্রয়োজন তা দিতে সম্মত হয়েছে তারা। একে একে সব দলের পক্ষ থেকেই আস্থা প্রকাশ করা হয়েছে ‘ইউনূস সরকারের’ প্রতি। তারা এ সরকারের সাফল্য কামনা করে যত দ্রুত সম্ভব ‘ছাত্র-জনতা হত্যাকারী’ আওয়ামী লীগ সরকারের প্রত্যেককে বিচারের আওতায় আনার দাবি করেছে। এ ছাড়া মিথ্যা, হয়রানিমূলক ও গায়েবি মামলা-মোকদ্দমার নিষ্পত্তি এবং পতিত আওয়ামী লীগ সরকার আমলে গৃহীত গণবিরোধী কার্যক্রমের বিচার দাবি, ১৫ আগস্টসহ বিভিন্ন অপ্রাসঙ্গিক রাষ্ট্রীয় ছুটি বাতিলেরও দাবি জানানো হয়েছে এ সরকারের কাছে। একই সঙ্গে ছাত্র-জনতার আন্দোলনে হত্যাকারী ব্যক্তি ও দল ছাড়া সব রাজনৈতিক দলের সঙ্গে আলাপ-আলোচনা অব্যাহত রাখার পরামর্শ দেওয়া হয়েছে। গতকাল বিকালে অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূসের সঙ্গে বৈঠক শেষে বিএনপির সর্বোচ্চ নীতিনির্ধারণী ফোরামের বৈঠকে জাতীয় নির্বাচনের উপযুক্ত পরিবেশ তৈরির জন্য সংস্কার সাধনে সরকারকে প্রয়োজনীয় সময় দেওয়ার কথা জানানো

অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস ঢাকায় রাষ্ট্রীয় অতিথি ভবন যমুনায় গতকাল বিএনপি নেতাদের সঙ্গে মতবিনিময় করেন           -পিআইডি

হয়। রাষ্ট্রীয় অতিথি ভবন যমুনায় অনুষ্ঠিত এ বৈঠকে বিএনপির পক্ষে নেতৃত্ব দেন দলের মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর। বৈঠকে অন্যদের মধ্যে দলের স্থায়ী কমিটির সদস্য ড. খন্দকার মোশাররফ হোসেন, ব্যারিস্টার জমির উদ্দিন সরকার, মির্জা আব্বাস, ড. আবদুল মঈন খান, নজরুল ইসলাম খান, আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরী, (সদ্যভারত প্রত্যাগত) সালাহউদ্দিন আহমেদ ও বেগম সেলিমা রহমান উপস্থিত ছিলেন। অন্যদিকে প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূসের সঙ্গে অন্তর্বর্তী সরকারের আইন উপদেষ্টা ড. আসিফ নজরুল, শিল্প উপদেষ্টা আদিলুর রহমান খান, মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ উপদেষ্টা ফরিদা আখতার প্রমুখ বৈঠকে অংশ নেন। এ ছাড়া পর্যায়ক্রমে বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামী, গণতন্ত্র মঞ্চ, গণ অধিকার পরিষদ (পৃথক বৈঠকে দুই অংশ), এ বি পার্টি, বাংলাদেশ জাতীয় পার্টি (বিজেপি), গণতন্ত্র মঞ্চ, গণসংহতি আন্দোলন, ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশ, ন্যাশনালিস্ট ডেমোক্রেটিক মুভমেন্টসহ (এনডিএম) বেশ কয়েকটি রাজনৈতিক দলের নেতাদের সঙ্গে বৈঠক করেন ড. মুহাম্মদ ইউনূস। বৈঠক শেষে বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর সাংবাদিকদের সঙ্গে কথা বলেন। তিনি বলেন, অন্তর্বর্তী সরকারকে আগেই আমরা নির্বাচনের জন্য উপযুক্ত পরিবেশ তৈরি করতে সময় দিয়েছি। আমরা তাদের সব বিষয়ে সমর্থন দিচ্ছি। অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূসের সঙ্গে বৈঠকে বিএনপি প্রতিনিধি দল নির্বাচন নিয়ে কোনো কথা বলেনি বলে জানান মহাসচিব। তিনি বলেন, নির্বাচনের যথাযথ পরিবেশ সৃষ্টি ও নির্বাচন অনুষ্ঠানের জন্য আমরা সরকারকে সময় দিচ্ছি। ঘণ্টাব্যাপী বৈঠক শেষে দলের পক্ষ থেকে বিভিন্ন দাবিদাওয়া ও পরামর্শ সংবলিত একটি লিখিত চিঠি হস্তান্তর করা হয়। মির্জা ফখরুল সাংবাদিকদের বলেন, আমরা নির্বাচন নিয়ে কোনো কথা বলিনি। আগেও বলেছি, নির্বাচনের পরিবেশ তৈরি করতে কিছু সময় লাগবে। আমরা তাদের অবশ্যই সেই সময় দিচ্ছি। তিনি আরও বলেন, আমরা একটা কথা খুব পরিষ্কারভাবে বলেছি, বর্তমানে দেশে যে অস্থিরতার চেষ্টা, বিশৃঙ্খলা সৃষ্টির চেষ্টা, সাম্প্রদায়িকতার ধুয়া তোলা হচ্ছে, এগুলোতে জনগণ যাতে বিভ্রান্ত না হয়। জনগণ যাতে আগের মতো ধর্মীয় সম্প্রীতি অক্ষুণ্ণ রেখে, জনগণের নিরাপত্তা অক্ষুণ্ণ রেখে সরকারকে সহায়তা করে। আমরাও এসব ক্ষেত্রে সরকারকে পুরোপুরি সহায়তা করছি। মির্জা ফখরুল জানান, প্রধান উপদেষ্টা তাঁদের মতবিনিময়ের জন্য আমন্ত্রণ জানিয়েছিলেন। গণতন্ত্র হত্যাকারী, ফ্যাসিস্ট আওয়ামী সরকার মানুষের ওপর দীর্ঘদিন অত্যাচার-নির্যাতন চালিয়ে তাদের অধিকার থেকে বঞ্চিত করেছে। ছাত্র-জনতার আন্দোলনের মাধ্যমে তার থেকে মুক্তি পেয়ে মুক্ত পরিবেশে সরকার দায়িত্ব নেওয়ার পর এই প্রথম বসেছেন বিএনপি নেতাদের সঙ্গে। বর্তমান পরিস্থিতিতে কী কী করা যায়, সে বিষয়ে তাঁরা মতামত দিয়েছেন। সরকারও তাদের মতামত জানিয়েছে। এখন আমরা মনে করি এ সরকারকে সহায়তা করা প্রতিটি দেশপ্রেমিক মানুষের একমাত্র কর্তব্য। দলের এই মুখপাত্র বলেন, দুর্ভাগ্যজনকভাবে যারা মানুষের অধিকার হরণ করেছিল, সে মহলটি, আবার বাইরে থেকে, এখান থেকে পালিয়ে গিয়ে ভারতে অবস্থান নিয়ে, সেখান থেকে বাংলাদেশের বিজয় নস্যাৎ করার চক্রান্ত করছে। দেশে অস্থিরতা ও বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি করার জন্যই সাম্প্রদায়িকতার ধুয়া তোলা হচ্ছে। এগুলোয় জনগণ যেন বিভ্রান্ত না হয়। দেশের মানুষ এ ‘ছাত্র-জনতা’ হত্যাকারীদের বিরুদ্ধে আছে। আওয়ামী লীগকে ইঙ্গিত করে বিএনপি মহাসচিব বলেন, এত হত্যা-নির্যাতনের পরও সেই দলটি আবারও বিভিন্ন রকম কথা বলছে। যা বাংলাদেশের মানুষের স্বার্থের বিরুদ্ধে। এটা বাংলাদেশের বদনামের জন্য, এ সরকারকে বদনাম করার জন্য এবং শিক্ষার্থীদের আন্দোলন দুর্বল করার একটি প্রচেষ্টা। তিনি বলেন, যারা ছাত্র, শিশু, রাজনৈতিক নেতাদের হত্যা করেছে, তাদের বিরুদ্ধে জনগণ আছে। আমরা মনে করি, অন্তর্বর্তী সরকারকে এ বিষয়ে জরুরি ভিত্তিতে পদক্ষেপ নিতে হবে। এ ব্যাপারে সরকারকে সর্বাত্মক সহযোগিতা করা হবে। সব দলের সঙ্গে সরকারের কথা বলা প্রয়োজন, কিন্তু হত্যাকারীর সঙ্গে নয়। এক প্রশ্নের জবাবে মির্জা ফখরুল বলেন, নির্বাচন নিয়ে আমরা কোনো কথা বলিনি। আমরা আগেও বলেছি, নির্বাচনের জন্য উপযুক্ত পরিবেশ তৈরি করতে নির্দিষ্ট একটা সময় লাগবে। আমরা তাদের সে সময়টা অবশ্যই দিয়েছি। আমরা তাদের সব বিষয়ে সমর্থন দিয়েছি। তিনি আরও বলেন, আমরা বিভিন্ন বিষয়ে আলোচনা করেছি। দেশের বর্তমান পরিস্থিতিতে কী কী করা যায়, সে বিষয়ে মতামত দিয়েছি। তারাও কী কী করতে যাচ্ছেন তা আমাদের সঙ্গে শেয়ার করেছেন। বৈঠক শেষে একই কথা বলেছেন বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য সালাহউদ্দিন আহমেদ। সাংবাদিকদের তিনি জানান, এ মুহূর্তে তাদের কাছে নির্বাচন অগ্রাধিকার নয়। নির্বাচন কমিশন সংস্কারসহ আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি স্বাভাবিক করার ওপর বিএনপি সবচেয়ে বেশি অগ্রাধিকার দিচ্ছে। বিএনপি প্রতিনিধি দল রাষ্ট্রীয় অতিথি ভবন যমুনায় থাকতেই বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামীর আমির ডা. শফিকুর রহমানের নেতৃত্বে একটি প্রতিনিধি দল সেখানে যায় এবং তারা বাইরে অপেক্ষা করে।

জামায়াতের বৈঠক : অন্তর্বর্তী সরকারের ওপর পূর্ণ আস্থা আছে জানিয়ে বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামীর আমির ডা. শফিকুর রহমান বলেছেন, বিভিন্ন জায়গা থেকে ষড়যন্ত্রের কথা উঠছে। কেউ সে রকম কিছু করতে চাইলেও জনগণের অপ্রতিরোধ্য চাপের মুখে কিছু করতে পারবে না। রাষ্ট্রীয় অতিথি ভবন যমুনায় প্রধান উপদেষ্টার সঙ্গে বৈঠকের পর সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে তিনি এ কথা বলেন। দলকে নিষিদ্ধের বিষয়ে জামায়াতের আমির বলেন, কেউ নিষিদ্ধ করে দিলেই আমরা নিষিদ্ধ হয়ে গেলাম, এটা আমরা মনে করি না। আওয়ামী লীগ সরকার শেষের দিকে অনেক ভুল কাজ করেছে, যেটার মাশুল হয়তো জনগণকে দিতে হবে। আন্দোলন ডাইভার্ট করার জন্য হঠাৎ করে নিষিদ্ধ করে দেওয়ার এ মতলব দেশের মানুষ বোঝে। এটা কেউ গ্রহণ করেনি। গ্রহণ করেনি বলেই এখন রাষ্ট্রের গুরুত্বপূর্ণ জায়গাগুলোয় জামায়াত ইসলামী সহযোগিতা করে যাচ্ছে এবং রাষ্ট্রও আমাদের সহযোগিতার অনুরোধ জানাচ্ছে। এটাকেই আমরা সবচেয়ে বড় বৈধতা বলে মনে করছি। বিকাল সাড়ে ৫টার পর জামায়াত প্রতিনিধি দল যমুনায় প্রবেশ করে। অন্যদিকে প্রধান উপদেষ্টার সঙ্গে বৈঠকে ১৫ আগস্ট জাতীয় শোক দিবসের ছুটি বাতিলের দাবি জানিয়েছেন গণ অধিকার পরিষদের একাংশের রেজা কিবরিয়া, অন্য অংশের নুরুল হক নূর ও এ বি পার্টির সদস্যসচিব মজিবুর রহমান মঞ্জু। নুরুল হক নূর আওয়ামী লীগ সরকারের সব সিদ্ধান্ত বাতিলের পাশাপাশি ছাত্রহত্যার মতো মানবাধিকার লঙ্ঘনের ঘটনায় রাজনৈতিক দল হিসেবে আওয়ামী লীগকে নিষিদ্ধ করার দাবি জানান। আগস্টকে শোকের মাস না বলে বিপ্লবের মাস হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়ার দাবিও জানান তিনি। ড. রেজা কিবরিয়া বলেন, ১৫ আগস্টের সাধারণ (সরকারি) ছুটি বাতিল করতে হবে। স্বৈরাচার শেখ হাসিনাসহ সংশ্লিষ্টদের বিরুদ্ধে অবিলম্বে বিচার কার্যক্রম শুরু করতে হবে। তিনি অবাধ, সুষ্ঠু নির্বাচনের পরিবেশ সৃষ্টি করতে যাবতীয় সংস্কারের জন্য অন্তর্বর্তী সরকারকে সময় দেওয়ার পক্ষে মত ব্যক্ত করেন। এ বি পার্টির সদস্যসচিব মজিবুর রহমান মঞ্জু বলেন, রাষ্ট্রে একটি বিপ্লব ঘটেছে। স্বৈরাচার ফ্যাসিবাদী সরকার যেহেতু দেশটা ধ্বংস করেছে; সে কারণে তাদের প্রতিটি জিনিস এ রাষ্ট্র প্রত্যাখ্যান করেছে। তিনি সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের ওপর হামলার অভিযোগের সত্যতা যাচাই করতে একটি বিচার বিভাগীয় তদন্ত কমিশন গঠনের দাবিও জানান। নাগরিক ঐক্যের সভাপতি ও গণতন্ত্র মঞ্চের সমন্বয়ক মাহমুদুর রহমান মান্না বলেন, ১৫ আগস্ট একটি বিরাট রাজনৈতিক প্রশ্ন। এ বিষয়ে আলোচনায় সময় লাগবে। তবে পটভূমি এখন ভিন্ন। এখন সারা দেশের মানুষ শত শত লোকের মৃত্যুতে শোকাভিভূত। এ সময় এমন কিছু করা ঠিক হবে না, যা মানুষকে আরও বেশি উসকে দেয়। গণসংহতি আন্দোলনের প্রধান সমন্বয়ক জোনায়েদ সাকি বলেন, ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে যে আকাক্সক্ষা তৈরি হয়েছে, সেটা বাস্তবায়ন করা এ সরকারের কর্তব্য। বিশেষ করে সারা দেশে প্রশাসন ভেঙে পড়ার উপক্রম হয়েছে। এতে জানমালের নিরাপত্তা বিঘিœত হচ্ছে। সরকারকে দ্রুত সমস্ত রাষ্ট্রীয় প্রশাসনিক কাঠামো সক্রিয় করে মানুষের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে হবে। বিশেষ করে ধর্মীয় সংখ্যালঘুর ওপর কেউ যাতে হামলা না করতে পারে, কারও বাড়ি ভাঙতে না পারে, যড়যন্ত্রকারীরা যাতে কোনো ধরনের সুযোগ না নিতে না পারে সে বিষয়ে গুরুত্ব দিতে হবে। এনডিএম প্রধান ববি হাজ্জাজ বলেন, প্রধান উপদেষ্টা তাঁদের প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন, কখনোই স্বৈরাচার সরকারকে তাঁরা ক্ষমতায় আনবেন না।

 

সর্বশেষ খবর