রবিবার, ৮ সেপ্টেম্বর, ২০২৪ ০০:০০ টা
ড. ইউনূসের অন্তর্বর্তী সরকার

চ্যালেঞ্জ চাপের ৩০ দিন

দায়িত্ব নিয়েই আইনশৃঙ্খলা বিপর্যয় সামলানো, অর্থনৈতিক সংকট, দ্রব্যমূল্য কমানো, আকস্মিক বন্যা মোকাবিলা, রাজনৈতিক দলসহ বিভিন্ন পক্ষের নানা দাবি দাওয়ার মুখে পড়ে সরকার

রুকনুজ্জামান অঞ্জন

চ্যালেঞ্জ চাপের ৩০ দিন

গত ৮ আগস্ট বঙ্গভবনে শপথ গ্রহণের পর নোবেলজয়ী অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বাধীন অন্তর্বর্তী সরকারের এক মাস পূর্ণ হলো আজ। আলোচ্য সময়ে বেশ কিছু গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত নিয়েছে এই সরকার। রাজনৈতিক ও আর্থিক খাত ছাড়াও রাষ্ট্রীয় পর্যায়ে গ্রহণ করা হয়েছে গুরুত্বপূর্ণ সংস্কার কার্যক্রম। পরিবর্তিত রাষ্ট্র ব্যবস্থার প্রয়োজনীয়তা বিবেচনা করে বিভিন্ন পদক্ষেপ ও পরিকল্পনা বাস্তবায়নের রূপরেখাও ঘোষণা করেছে অন্তর্বর্তী সরকার। গত এক মাসে অন্তর্বর্তী সরকার যেসব সিদ্ধান্ত নিয়েছে তার মধ্যে উল্লেখযোগ্য হচ্ছে- আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে গণহত্যার বিচারের উদ্যোগ, গণহত্যার তদন্ত করতে জাতিসংঘের সহায়তা গ্রহণ, গণভবনকে জাদুঘরে রূপান্তরের সিদ্ধান্ত, সম্পূর্ণ বিচার না হওয়া পর্যন্ত ফ্যাসিবাদীদের পুনর্বাসন না করা, গুম থেকে সব ব্যক্তির সুরক্ষার জন্য আন্তর্জাতিক কনভেনশন সনদে স্বাক্ষর, সংস্কার বিষয়ে রাজনৈতিক দলগুলোর প্রস্তাব গ্রহণ, নিত্যপণ্যের মূল্য সহনীয় রাখতে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ গ্রহণ, আলু-পিঁয়াজের আমদানি শুল্ক কমানো, অগ্নিকান্ডে দুটি স্টেশন ক্ষতির কারণে প্রায় এক মাস বন্ধ থাকার পর মেট্রোরেল চালুকরণ, কালো টাকা সাদা করার বিধি ও রীতি বন্ধ করে দেওয়া; ব্যাংকিং খাতের লুটপাট করা টাকা ফেরত আনতে           পরিচালনা পর্ষদ পুনর্গঠন, পাচারকৃত অর্থ ফেরত আনতে বিভিন্ন দেশের কাছে সহায়তা চাওয়া, দুর্নীতি, পাচার ও লুটপাটের সঙ্গে জড়িত ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানের হিসাব ও সম্পদ জব্দ করার পাশাপাশি বিচারের আওতায় আনার উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে।

একই সঙ্গে আরও কিছু পদক্ষেপ গ্রহণ করেছে সরকার। এর মধ্যে জুলাই-আগস্ট অভ্যুত্থানে গণহত্যার শিকার ব্যক্তিদের পূর্ণাঙ্গ তালিকা প্রকাশ, আর্থিক খাতের দুর্নীতির শ্বেতপত্র প্রকাশ এবং ব্যাংক কমিশন গঠনের সিদ্ধান্ত উল্লেখযোগ্য। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, সরকারের এই পদক্ষেপগুলো চলমান রয়েছে, দ্রুত এগুলো বাস্তবায়ন হবে। প্রধান উপদেষ্টার কার্যালয়ের সূত্রগুলো জানাচ্ছে, মাত্র এক মাসের কার্যক্রম পর্যালোচনা করে এই সরকারের কর্মকান্ডের ব্যাপকতা পরিমাপ করা যাবে না। একটি বিপ্লবের মধ্য দিয়ে দায়িত্বপ্রাপ্ত অন্তর্বর্তী সরকারের কার্যক্রম প্রচলিত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের কার্যক্রমের চেয়ে ভিন্ন। তত্ত্বাবধায়ক সরকার আগে থেকে নির্দ্দিষ্ট করে দেওয়া একটি স্বল্পকালীন মেয়াদে দায়িত্ব নিয়ে একটি সুষ্ঠু নির্বাচন অনুষ্ঠানের জন্য প্রয়োজনীয় কাজগুলো করে থাকে। কিন্তু জুলাই-আগস্ট অভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে বাংলাদেশে ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বাধীন যে অন্তর্বর্তী সরকার দায়িত্ব গ্রহণ করেছে তার কাজ ব্যাপক ও বিশাল। এই সরকারকে গণহত্যায় দায়ীদের বিরুদ্ধে একটি স্বচ্ছ ও আন্তর্জাতিক মানের বিচারের ব্যবস্থা করতে হচ্ছে; অভ্যুত্থানে নিহতদের তালিকা করার পাশাপাশি শহীদ পরিবারগুলোকে পুনর্বাসনের উদ্যোগ নিতে হচ্ছে; আহতদের প্রয়োজনীয় চিকিৎসা নিশ্চিত করতে হচ্ছে; জনগণের আকাক্সক্ষা অনুযায়ী রাষ্ট্রীয় সংস্কার কার্যক্রম পরিচালনা করতে হচ্ছে, সংস্কার, রাষ্ট্র ও সরকারের করণীয় বিষয়ে রাজনৈতিক দলগুলো ছাড়াও বিভিন্ন স্টেক হোল্ডারের সঙ্গে আলোচনা করতে হচ্ছে। এ ছাড়া দুর্নীতি ও লুটপাটের সঙ্গে জড়িতদের বিচারের আওতায় আনতে হচ্ছে। বিচারের আওতায় আনতে হচ্ছে বিগত ফ্যাসিবাদ সরকারের অংশীজন ও অনৈতিক সুবিধাভোগীদের। এমনকি রাজনীতির পাশাপাশি আর্থিক খাতে শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনতেও গ্রহণ করতে হচ্ছে নানা কার্যক্রম।

সরকারের এক মাসের কার্যক্রম সম্পর্কে প্রতিক্রিয়া জানতে চাইলে রাজধানীর একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তা আসাদুজ্জামান বলেন, অভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে একটি দুর্নীতিগ্রস্ত স্বৈরাচার সরকারকে হটিয়ে যে অন্তর্বর্তী সরকারকে ক্ষমতায় বসিয়েছে ছাত্র-জনতা স্বাভাবিকভাবেই তার প্রতি প্রত্যাশা বেশি। আমরা চাই দুর্নীতিমুক্ত সমাজ, সিন্ডিকেটমুক্ত বাজার এবং বৈষম্যমুক্ত রাষ্ট্র। গত এক মাসে তার কিছু বাস্তবায়নের দিশা দেখা যাচ্ছে, কিছু চ্যালেঞ্জও রয়ে গেছে। একজন রিকশাচালক জিন্নাত আলী জানান, স্বৈরাচার আর লুটপাটের সরকার পালিয়েছে তাতেই তিনি খুশি। তবে বাজারে আলু পিঁয়াজের দাম কমলে আরও খুশি হবেন তিনি। সাধারণ মানুষের সঙ্গে কথা বলার পর তারা যেটি বলছেন, তার মূল কথা হচ্ছে: অন্তর্বর্তী সরকারের নানা সিদ্ধান্ত, সংস্কার কার্যক্রম ও উদ্যোগ গ্রহণের পরও কিছু চ্যালেঞ্জ কিছু সমন্বয়হীনতা রয়ে গেছে। যার মধ্যে উল্লেখযোগ্য হচ্ছে দ্রব্যমূল্য নিয়ন্ত্রণ, বাজারকে সিন্ডিকেটমুক্ত করা; পুলিশ বাহিনীকে পুরোপুরি সক্রিয় করে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি স্বাভাবিক করা, যানজট নিরসন, শিল্প-কারখানার নিরাপত্তার নিশ্চয়তা, শ্রম অসন্তোষ দূর করা, যাচাইবাছাই ছাড়া ঢালাওভাবে নিরপরাধ ব্যক্তিকে হত্যামামলায় আসামি না করা এবং বন্যা-পরবর্তী দুর্গত মানুষের পুনর্বাসন কার্যক্রমের মতো বিষয়গুলো। এ বিষয়ে প্রধান উপদেষ্টার কার্যালয় সংশ্লিষ্টরা জানাচ্ছেন, ড. ইউনূসের নেতৃত্বাধীন অন্তর্বর্তী সরকারের কার্যক্রম শুরুর পর পরই অগ্রাধিকারভিত্তিতে আইনশৃঙ্খল পরিস্থিতি স্বাভাবিক করা এবং পুলিশ বাহিনীকে সক্রিয় করা ছিল প্রধান চ্যালেঞ্জ। রাষ্ট্রের অন্যান্য প্রতিষ্ঠানগুলোর সহায়তায় সেই চ্যালেঞ্জ মোকাবিলার কার্যক্রম চলাকালীন উজানের ধেয়ে আসা পানিতে আকস্মিক বন্যার কবলে পড়ে দেশের পূর্বাঞ্চলের জেলাগুলো। একটি অভ্যুত্থান পরবর্তী সরকার কাঠামো কার্যক্রম শুরু করতে না করতেই এ ধরনের চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করা ছিল আরও বেশি চ্যালেঞ্জের। এ অবস্থায় দেশের ছাত্র-জনতার পাশাপাশি দেশি-বিদেশি সহায়তা, সরকারি-বেসরকারি সংস্থাগুলোর সমন্বয় করে এই চ্যালেঞ্জ মোকাবিলার কৌশল গ্রহণ করেছে অন্তর্বর্তী সরকার।

প্রধান উপদেষ্টার কার্যালয় জানায়, জাতীয় ইস্যুর পাশাপাশি বিভিন্ন আন্তর্জাতিক ইস্যুও দক্ষতার সঙ্গে সামাল দিতে হচ্ছে অন্তর্বর্তী সরকারকে। দায়িত্ব গ্রহণের পর আন্তর্জাতিক ইস্যুগুলোর সমাধানে বিভিন্ন রাষ্ট্রের সরকারপ্রধানের পাশাপাশি কূটনীতিকদের সঙ্গে আলোচনা কার্যক্রম চলমান রেখেছে সরকার। 

প্রধান উপদেষ্টার প্রেস সচিব শফিকুল আলম বলেন, অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূসের বড় সাফল্যের একটি হচ্ছে, আন্দোলনের অভিযোগে সংযুক্ত আরব আমিরাতে দন্ডপ্রাপ্ত ৫৭ জন প্রবাসী বাংলাদেশিকে মুক্ত করা। গত ২৮ আগস্ট আরব-আমিরাতের রাষ্ট্রপতি (আমির) মোহাম্মদ বিন জাহেদ আল নাহিয়ানের সঙ্গে ফোনালাপে প্রধান উপদেষ্টা এই ৫৭ জনকে ক্ষমা করে দেওয়ার অনুরোধ করেছিলেন।

তিনি বলেন, সাজাপ্রাপ্ত আসামিদের সাজা মওকুফ করার এমন ঘটনা সংযুক্ত আরব-আমিরাতের ইতিহাসে বিরল। নোবেল বিজয়ী ও বিশ্ববরেণ্য ব্যক্তিত্ব হিসেবে ড. ইউনূসের প্রতি সম্মান দেখিয়ে আমিরাতের আমির এই পদক্ষেপ গ্রহণ করে। এ ছাড়া যৌথ নদীর পানি প্রবাহ ও বন্যানিয়ন্ত্রণে ভারতকে নতুন প্রক্রিয়ায় আলোচনার প্রস্তাব, রোহিঙ্গা ইস্যুতে জাতিসংঘ, জাতিসংঘের শরণার্থী সংস্থা, ইউএনডিপিসহ বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সংস্থা সহায়তার বিষয়গুলোও রয়েছে। ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানের এক মাস পূর্তিতে গণমাধ্যমে পাঠানো বার্তায় প্রধান উপদেষ্টা ড. ইউনূস বলেন, মাত্র এক মাস হলো অন্তর্বর্তী সরকার দায়িত্ব নিয়েছে। তা সত্ত্বেও আমরা বিপ্লবের প্রকৃত লক্ষ্য অর্জনের জন্য গুরুত্বপূর্ণ সংস্কারের কাজ শুরু করেছি। আমাদের প্রথম কাজ জুলাই ও আগস্টের হত্যাকান্ডের বিচার ও জবাবদিহি নিশ্চিত করা। গণহত্যার বিষয়ে জাতিসংঘের নেতৃত্বে স্বাধীন ও নিরপেক্ষ তদন্ত পরিচালনা করার জন্য আমরা জাতিসংঘের মানবাধিকার দপ্তরকে আমন্ত্রণ জানিয়েছি। তারা এ দেশে এসেছেন এবং তাদের কাজ শুরু করে দিয়েছেন। এ ছাড়া আমি জুলাই এবং আগস্ট মাসে মানবতাবিরোধী অপরাধের অভিযোগে অভিযুক্ত ব্যক্তিদের বিচারের জন্য একটি আন্তর্জাতিক মানের ট্রাইব্যুনাল গঠন করার প্রয়াসে শীর্ষ আন্তর্জাতিক আইন বিশেষজ্ঞদের সঙ্গেও কথা বলেছি। আমরা খুনিদের প্রত্যার্পণ এবং স্বৈরাচারের সময় দুর্নীতিবাজ ব্যক্তি, রাজনীতিবিদ ও আমলারা যে পরিমাণ অর্থ আত্মসাৎ করেছে তা দেশে ফিরিয়ে আনতে চাই। এ জন্য বিশেষজ্ঞ প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে আলাপ শুরু করেছি।

সর্বশেষ খবর