মঙ্গলবার, ১০ সেপ্টেম্বর, ২০২৪ ০০:০০ টা
শুল্কমুক্ত বন্ডের কাপড় কালোবাজারে

রাজস্ব চুরিতে বেপরোয়া গার্মেন্ট মালিকরা

♦ অপব্যবহারের কারণে বস্ত্র খাতের ৫ হাজার শিল্প-কারখানা লাইফ সাপোর্টে, হুমকিতে ২ লাখ কোটি টাকার বিনিয়োগ : বিটিএমএ ♦ যেসব গার্মেন্ট মালিক জড়িত তাদের বিরুদ্ধে কাস্টমস ব্যবস্থা নেয় না : বিকেএমইএ

রুহুল আমিন রাসেল

শুল্কমুক্ত বন্ডেড ওয়্যারহাউস সুবিধার কাপড় পোশাকশিল্প মালিকরা অবৈধভাবে প্রকাশ্যে কালোবাজারে বিক্রি করছেন বলে জানা গেছে। সূত্র বলছে, চাহিদার বিপরীতে বাড়তি কাপড় আমদানি করে সরকারের বিপুল পরিমাণ রাজস্ব চুরিতে বেপরোয়া হয়ে উঠেছেন পোশাকশিল্প মালিকরা। এভাবে শুল্কমুক্ত সুবিধার অপব্যবহারের কারণে বস্ত্র খাতের ৫ হাজার শিল্প-কারখানা লাইফ সাপোর্টে রয়েছে। এর সঙ্গে বস্ত্র খাতের প্রায় ২ লাখ কোটি টাকার বিনিয়োগ হুমকিতে পড়েছে বলে জানিয়েছে বিটিএমএ। পোশাকশিল্প মালিকদের সংগঠন বিকেএমইএ বলেছে, যারা বন্ড সুবিধার অপব্যবহার করছে, তাদের বিরুদ্ধে কাস্টমস শক্ত কোনো আইনি ব্যবস্থা নেয় না। পোশাকশিল্পে বছরে গড়ে ৬৪ হাজার কোটি টাকা পাচারের তথ্য পেয়ে ২০২১ সালে অনুসন্ধান ও তদন্ত শুরু করার কথা জানিয়েছিল দুর্নীতি দমন কমিশন-দুদক। সংস্থাটির এই তদন্ত ও অনুসন্ধানে গতি নেই বলে জানা গেছে। সূত্র বলছে, চোরাই কাপড় ব্যবসা থেকে বিভিন্ন সংস্থার উচ্চপর্যায়ের কর্মকর্তাদের পকেটেও ঘুষের টাকা পৌঁছে যায়। এমনকি বিজিএমইএ ও বিকেএমইএর কিছু অসাধু কর্মকর্তা-কর্মচারী পর্যন্ত এই কারবার থেকে ঘুষ আদায় করেন। কারণ, অনেক গার্মেন্ট মালিকের মূল ব্যবসাই হলো এই আন্ডারগ্রাউন্ড চোরাই কাপড়ের ব্যবসা। কোনো মতে ২০-২৫টি মেশিন বসিয়ে তারা ভুয়া উৎপাদন দেখায়। কিন্তু আড়ালে চোরাই কাপড়ের ব্যবসাই হলো তাদের প্রকৃত ধান্ধা। সংশ্লিষ্ট ব্যবসায়ীরা পরিচয় গোপন রাখার শর্তে বলছেন, শুধু ইসলামপুরেই বছরে অন্তত ৫০ হাজার কনটেইনার কাপড় আসে। এ ছাড়া রাজধানীর আরও কয়েকটি জায়গায় চোরাই কাপড়ের গোপন বাজার গজিয়ে উঠেছে। তবে এই দুর্নীতির শুরুটা হয় চট্টগ্রাম কাস্টমস থেকে। এ প্রসঙ্গে বাংলাদেশ টেক্সটাইল মিলস অ্যাসোসিয়েশন-বিটিএমএ সহসভাপতি মো. ফাইজুর রহমান ভূঁইয়া গতকাল বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, বস্ত্র খাতে ছোট-বড় মিলিয়ে প্রায় ৫ হাজার শিল্পকারখানা রয়েছে। এর মধ্যে বিটিএমএ সদস্য প্রতিষ্ঠান প্রায় ১ হাজার ৮০০টি। এসব শিল্পকারখানা বন্ড সুবিধার অপব্যবহারের কারণে এখন লাইফ সাপোর্টে রয়েছে। হুমকিতে পড়েছে বস্ত্র খাতের ২ লাখ কোটি টাকার বিনিয়োগ। আমরা কর দিয়ে ব্যবসা করছি, আর পোশাকশিল্পের কিছু মালিক শুল্ক-কর ফাঁকি দিয়ে বন্ড সুবিধার কাপড় কালোবাজারে বিক্রি করছে। ইসলামপুরে রাতের আঁধারে সারি সারি ট্রাকে করে গার্মেন্টসের অবৈধ কাপড় নামছে। অথচ রপ্তানিকারকদের জন্য বন্ড সুবিধার কাপড় আনার সুবিধা দেওয়া হয়েছে। সেই সুবিধার অপব্যবহার করে শুল্কমুক্ত কাপড়- সুতা কালোবাজারে বিক্রি করে অনেক অসাধু ব্যবসায়ী বস্ত্র খাত ধ্বংস করছে। বাংলাদেশ নিট পোশাক প্রস্তুত ও রপ্তানিকারক সমিতি-বিকেএমইএ সভাপতি মোহাম্মাদ হাতেম গতকাল বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, পোশাকশিল্প মালিকদের মধ্যে একটি অংশ আছেন, যারা বন্ড সুবিধার অপব্যবহার করছেন। তাদের বিরুদ্ধে কাস্টমস কখনোই আইনি ব্যবস্থা নেয় না। কাস্টমস সব সময় প্রকৃত ব্যবসায়ীদের হয়রানি করছে। বন্ড সুবিধার কাপড় কালোবাজারে বিক্রিতে জড়িত কিছু পোশাক কারখানার মালিকের সঙ্গে কাস্টমস কর্মকর্তাদের পার্টনারশিপ থাকতে পারে। একই বিষয়ে পোশাকশিল্প মালিকদের আরেক সংগঠন বাংলাদেশ পোশাক প্রস্তুত ও রপ্তানিকারক সমিতি-বিজিএমইএ সভাপতি খন্দকার রফিকুল ইসলামের সঙ্গে গতকাল কয়েক দফা যোগাযোগের চেষ্টা করেও তার বক্তব্য গ্রহণ করা সম্ভব হয়নি। বাংলাদেশ ট্রেড অ্যান্ড ট্যারিফ কমিশনের ২০২০ সালের প্রতিবেদনের তথ্য বলছে, দেশে প্রতিবছর ৬ দশমিক ৫ বিলিয়ন মিটার ফেব্রিক বা কাপড়ের চাহিদা রয়েছে। বর্তমানে কাপড়ের চাহিদা রয়েছে ৭ বিলিয়ন মিটার। প্রতি মিটার কাপড়ের মূল্য ২ ডলার হিসেবে দেশের মানুষের জন্য বছরে প্রায় ১৪ বিলিয়ন ডলার বা ১ লাখ ৬০ হাজার কোটি টাকার কাপড় প্রয়োজন। বিটিএমএ সদস্যরা ৭ বিলিয়ন মিটার কাপড়ের প্রায় ৯০ শতাংশ সরবরাহ করছে। যা আমদানি পরিপূরক হিসেবে মূল্যবান বৈদেশিক মুদ্রা সাশ্রয় করছে। বিটিএমএ সূত্র বলছে, দেশে প্রাইমারি বস্ত্র খাতে গত অর্থবছরে প্রায় ৭ দশমিক ৫ বিলিয়ন বেল তুলা আমদানি হয়েছে। এতে ৩ দশমিক ৫ থেকে ৪ বিলিয়ন ডলার বৈদেশিক মুদ্রা ব্যয় হয়েছে। আমদানির বিপরীতে ৪৭ বিলিয়ন ডলারের রপ্তানিতে প্রায় ২৭ বিলিয়ন ডলার প্রচ্ছন্ন রপ্তানি এবং ১২ বিলিয়ন ডলার দেশীয় বাজারে সরবরাহসহ মোট ৩৯ বিলিয়ন ডলার অবদান রাখছে।

সূত্র বলছে, বন্ডের কাপড় চট্টগ্রাম কাস্টমস থেকে খালাস হয়ে ঢাকার আশপাশে এসে নামে। রাতের অন্ধকারে নারায়ণগঞ্জের সানারপাড়, কেরানীগঞ্জ এলাকায় গাড়ি আনলোড হয়। এজন্য চট্টগ্রাম রোডে অনেক বাড়িতে অস্থায়ী গোডাউনও গড়ে উঠেছে। এসব গোপন গোডাউন থেকে সুবিধামতো সময়ে কাপড় হাতবদল হয়। একপর্যায়ে মোটা অঙ্কের টাকার বিনিময়ে এগুলো চলে যায় ইসলামপুরসহ রাজধানীর বিভিন্ন পয়েন্টে কালোবাজারিদের হাতে। সেখান থেকে গোপনে ঢুকে পড়ে অসাধু ব্যবসায়ীদের ফ্যাক্টরিতে। আবার প্রতিদিন রাত ১২টার পর অবৈধ কাপড়বোঝাই ট্রাক বিভিন্ন কোম্পানির ওয়্যার হাউস থেকে সরাসরি ইসলামপুর ও সদরঘাটের বিভিন্ন মার্কেটে চলে আসে। এর মধ্যে সদরঘাটের বিক্রমপুর সিটি গার্ডেন মার্কেট অন্যতম। এখানে প্রায় ৬০ শতাংশ কাপড়ই বন্ডেড সুবিধা নিয়ে আমদানি করে খোলাবাজারে বিক্রি করা হচ্ছে। এ ছাড়া ইসলামপুরের নূর ম্যানশন, সাউথ প্লাজা, গুলশান আরা সিটি, মনসুর ক্যাসেল, কে হাবিবুল্লাহ মার্কেট ও ইসলাম প্লাজায় এভাবে আনা ৮০ শতাংশ সুতা ও কাপড় বিক্রি হয়। অভিযোগ রয়েছে, এর সঙ্গে ইপিজেডগুলোর কর্মকর্তাদের সম্পৃক্ততা রয়েছে। এখানকার কতিপয় ব্যবসায়ী চাতুরীর আশ্রয় নিয়ে কিছু পরিমাণ কাপড় শুল্ক দিয়ে আমদানি করেন। তারা এই ভ্যাট চালানের রসিদ ব্যবহার করে বন্ড সুবিধায় আনা বিপুল পরিমাণ কাপড় খোলাবাজারে বিক্রি করে থাকেন।

অনুসন্ধানে দেখা গেছে, ইসলামপুরসহ রাজধানীর কয়েকটি বাজারে প্রতিদিন বানের পানি মতো ঢুকছে বন্ড সুবিধায় আমদানি করা বিদেশি কাপড়। অথচ শুল্কমুক্ত সুবিধায় আনা এসব কাপড় শতভাগ রপ্তানিমুখী গার্মেন্টে ব্যবহার করার কথা। কিন্তু গার্মেন্ট মালিক নামধারী দেশের স্বার্থবিরোধী একটি চক্র এসব কাপড় কালোবাজারে বিক্রি করে দিচ্ছে। সঙ্গে যুক্ত হয়েছে আরও কয়েকটি শক্তিশালী চক্র। যারা অন্যের বন্ড লাইসেন্সে মোটা অঙ্কের কমিশনের বিনিময়ে চুটিয়ে এই চোরাকারবারির ব্যবসা চালিয়ে যাচ্ছে। ফলে শুধু দেশের সম্ভাবনাময় টেক্সটাইল বা বস্ত্র খাতই ধ্বংস হচ্ছে না, সরকারও হারাচ্ছে বিপুল পরিমাণ রাজস্ব। শুধু বন্ডের কাপড় চোরাচালান করেই শূন্য থেকে শত কোটি টাকার মালিক বনে গেছেন অনেকে। যাদের মধ্যে কেউ কেউ এক সময় ছিলেন হকার, সেলসম্যান কিংবা প্রবাসী শ্রমিক। এই সোনার হরিণের পেছনে ছুটে খুব কম সময়ের মধ্যে তারা এখন সমাজের উঁচু তলার মানুষ বনে গেছেন।

অনুসন্ধানে দেখা গেছে, খোদ রাজধানীর ইসলামপুরে চোরাই কাপড়ের বিশাল বাজার গড়ে উঠেছে। কিন্তু প্রকাশ্যে দিনের পর দিন প্রশাসনের নাকের ডগায় এত বড় অপরাধ সংঘটিত হলেও রহস্যজনক কারণে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ যেন চোখ-কান বন্ধ করে বসে আছে। অথচ এর নেতিবাচক প্রভাবে দেশের টেক্সটাইল খাত বিপর্যয়ের মুখে পড়েছে। বন্ডেড সুবিধায় আনা বিভিন্ন শ্রেণির কাপড় রাজধানীর ইসলামপুরের মার্কেটে দেদার ঢুকে পড়ায় দেশীয় টেক্সটাইল শিল্পে উৎপাদিত বিপুল পরিমাণ কাপড় অবিক্রীত থেকে যাচ্ছে। বন্ডেড ওয়্যারহাউস সুবিধাভোগী এই চক্রের ফাঁদে পড়ে দেশের শিল্প বিনিয়োগে বড় ধরনের সংকট দেখা দিয়েছে। তথ্যানুসন্ধানে দেখা গেছে, শুল্ক ও করমুক্ত এবং মিথ্যা ঘোষণার মাধ্যমে আমদানি হওয়া সুতা-কাপড়সহ বিভিন্ন পোশাকপণ্য অবাধে স্থানীয় বাজারে বিক্রি হচ্ছে। যার প্রভাব পড়েছে দেশের রপ্তানিমুখী স্পিনিং ও উইভিং মিলগুলোতেও। শুধু কাপড় নয়, পিপি দানা ও বিভিন্ন ধরনের কেমিক্যাল থেকে শুরু করে সব ধরনের বন্ড সুবিধার পণ্যই এভাবে চলে যাচ্ছে কালোবাজারে। অনেকটা প্রকাশ্যেই এখন চোরাই কাপড় বহন করা হচ্ছে। তবে এজন্য বিশেষ ব্যবস্থা আছে। চোরাই কাপড়ভর্তি যানবাহনকে যাতে কোথাও কোনো তল্লাশির মুখে পড়তে না হয় সেজন্য কোটি টাকায় সরকারি রাস্তা কিনে নেয় চোরাকারবারিরা।

পোশাকশিল্প মালিকদের অর্থ পাচার প্রসঙ্গে ২০২১ সালের ২২ ফেব্রুয়ারি সংবাদ সম্মেলনে দুর্নীতি দমন কমিশন-দুদক বলেছে, পোশাকশিল্প মালিকদের বিরুদ্ধে আমদানি ও রপ্তানির আড়ালে বাংলাদেশ থেকে প্রতি বছর গড়ে ৬৪ হাজার কোটি টাকা পাচারের বিষয়ে অনুসন্ধান শুরু করেছে দুদক। কিছু সংখ্যক সরকারি কর্মকর্তার সহযোগিতায় পোশাক কারখানার মালিকরা এই অর্থ পাচার করেছেন। বর্তমানে দুদকের একটি অনুসন্ধান টিম এসব অভিযোগের বিষয়ে অনুসন্ধান কার্যক্রম পরিচালনা করছে।

কাস্টমস সূত্র জানায়, গ্লোবাল ফিন্যান্সিয়াল ইনটেগ্রিটির (জিএফআই) ২০১৮ সালের তথ্য অনুযায়ী, আন্তর্জাতিক বাণিজ্যের মাধ্যমে বাংলাদেশ থেকে প্রতি বছর গড়ে ৭৫৩ কোটি ৩৭ লাখ ডলার পাচার হয়। টাকার অঙ্কে তা প্রায় ৮০ হাজার কোটি। শুধু মিস-ইনভয়েসিংয়ের মাধ্যমে পাচার হওয়া অর্থের পরিমাণ বছরে কমপক্ষে ১ হাজার কোটি ডলার। অর্থাৎ মিথ্যা ঘোষণা ও আমদানি-রপ্তানি বন্ড সুবিধার অপব্যবহারের মাধ্যমে বাধাগ্রস্ত হচ্ছে শুল্ক আহরণের যাত্রা। সর্বশেষ ২০২২-২৩ অর্থবছরে কাস্টমস বিভাগের ২.৫৬ শতাংশ প্রবৃদ্ধি অর্জিত হয়। রাজস্ব আদায় ১ লাখ ১১ হাজার কোটি টাকা হলেও ঘাটতি ছিল প্রায় ১৯ হাজার ২৮৩ কোটি টাকা। অর্থ পাচারের এমন প্রেক্ষাপটে শুল্ক গোয়েন্দা ও তদন্ত অধিদপ্তর ২০২৩ সালে পোশাক রপ্তানির আড়ালে ৩৩টি গার্মেন্টস প্রতিষ্ঠানের ৮২১ কোটি টাকা পাচারের তথ্য পেয়েছে। শুল্ক গোয়েন্দা সূত্র বলছে, দেশের সবচেয়ে বড় অর্থ পাচার কেলেঙ্কারির অন্যতম এই ঘটনা সম্প্রতি উদ্ঘাটন হলেও এসব পণ্য রপ্তানি হয়েছে ২০১৭ সাল থেকে ২০২৩ সালের মে মাস পর্যন্ত। এসব প্রতিষ্ঠান ১৩ হাজার ৮১৭টি চালানে ৯৩৩ কোটি টাকার পণ্য রপ্তানি করলেও দেশে এনেছে মাত্র ১১১ কোটি টাকা। বাকি টাকা সিঙ্গাপুর, দুবাই, মালয়েশিয়া, কানাডাসহ ২৫টি দেশে পাচার করতে ভুয়া রপ্তানি নথি ব্যবহার করেছে প্রতারকচক্র।

সর্বশেষ খবর