সোমবার, ১৯ ফেব্রুয়ারি, ২০২৪ ০০:০০ টা

ঋতু পরিবর্তনে স্বাস্থ্য সচেতনতা জরুরি

অধ্যাপক ডা. এ বি এম আবদুল্লাহ

ঋতু পরিবর্তনে স্বাস্থ্য সচেতনতা জরুরি

শীত গেল, চলছে বসন্ত, এরপরই আসবে প্রচন্ড গরমের গ্রীষ্মকাল। আবহাওয়ায় শুরু হয়েছে ঋতু পরিবর্তনের খেলা, দিনের বেলা গরম এবং রাতে শীতল হাওয়া। আবহমান কাল থেকেই ঋতুর এই পরিবর্তন চলে আসছে এবং চলতেই থাকবে। ঋতু পরিবর্তনের এই খেলায় তাপমাত্রা, আর্দ্রতা, আর ধুলাবালির তারতম্যে দেখা যায় নানা রকম অসুখ-বিসুখের উৎপাত। এই পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে আমাদের স্বাস্থ্যের পরিবর্তন বা রোগব্যাধি হওয়াটাই স্বাভাবিক। তাই আমাদের সবাইকে হতে হবে সচেতন, নিতে হবে কিছু প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থা। ঋতুভেদে এসব অসুখের বেশির ভাগই ভাইরাসজনিত এবং সাময়িক, কিন্তু অস্বস্তিকর। তবে সুবিধা হলো, একটু সতর্ক হলে প্রায় ক্ষেত্রেই এগুলো প্রতিরোধ করা যায়। ঋতু পরিবর্তনের সময় সবচেয়ে বেশি রোগব্যাধির প্রকোপ যায় শ্বাসতন্ত্রের ওপর। ছোট বাচ্চা থেকে শুরু করে বৃদ্ধ বয়স পর্যন্ত সবার সর্দিকাশি বা কমন কোল্ড। বিশেষ করে শীতের শেষে আর গরমের শুরুতে তাপমাত্রা পরিবর্তনের সময়টাতেই এর প্রাদুর্ভাব বেশি। প্রায়ই দেখা যায় দু তিন দিন নাক বন্ধ থাকে বা নাক দিয়ে পানি ঝরে। গলাব্যথা, শুকনা কাশি আর জ্বরও থাকতে পারে। এগুলো বেশির ভাগই ভাইরাসজনিত, লক্ষণভিত্তিক কিছু চিকিৎসা, এমনকি কোনো চিকিৎসা ছাড়াই ভালো হয়, কোনো অ্যান্টিবায়োটিকের প্রয়োজন হয় না। তবে শুকনা কাশিটা কয়েক সপ্তাহ ভোগাতে পারে। ব্যথার জন্য প্যারাসিটামল জাতীয় ওষুধ, এন্টি হিস্টামিন খেতে হবে। আর গরম পানিতে গড়গড়া করতে হবে। গরম গরম চা বা গরম পানিতে আদা, মধু, লেবুর রস, তুলসী পাতার রস ইত্যাদি পান করলে উপকার পাওয়া যায়। অনেক ক্ষেত্রে ভাইরাসের পরপরই ব্যাকটেরিয়া আক্রমণ করতে পারে। কাশির সঙ্গে হলুদ বা সবুজ রংয়ের কফ বের হলে সঙ্গে জ্বর থাকলে ব্যাকটেরিয়ায় আক্রান্ত হওয়ার আশঙ্কা বেশি থাকে। সেক্ষেত্রে অ্যান্টিবায়োটিকের প্রয়োজন হয়। এই সময়টাতে আরও ভাইরাস রোগের প্রাদুর্ভাব হতে পারে, যেমন ইনফ্লুয়েঞ্জা, সিজনাল ফ্লু। এই রোগের লক্ষণগুলোও কমন কোল্ডের মতোই। আলাদা কোনো চিকিৎসাও প্রয়োজন হয় না, উপরের কমন কোল্ডের মতোই উপসর্গভিত্তিক চিকিৎসা দিলেই ঠিক হয়ে যায়। জলবসন্ত রোগের প্রকোপও এই সময়ে বেশি বেশি হয়। প্রথমে একটু জ্বর-সর্দি, তারপর গায়ে ফোস্কার মতো ছোট ছোট দানা। সঙ্গে থাকে অস্বস্তিকর চুলকানি, ঢোক গিলতে অসুবিধা। গায়ে ব্যথা থাকতে পারে। এটাও কোনো মারাত্মক অসুখ নয়। জ্বরের জন্য প্যারাসিটামল, শরীর চুলকালে অ্যান্টিহিস্টামিন জাতীয় ওষুধ, ক্যালামিন লোশন ইত্যাদি ব্যবহার করলেই রোগের প্রকোপ কমে আসবে। আর সংক্রমণ হলে অবশ্যই চিকিৎসকের পরমার্শ নেওয়া উচিত।

সাইনোসাইটিস এবং টনসিলাইটিস জাতীয় রোগগুলোও এ সময়ে দেখা দিতে পারে। টনসিলের সমস্যা যে কারও হতে পারে, তবে ছোট বাচ্চারাই বেশি আক্রান্ত হয়। হঠাৎ শীত চলে যাওয়ার প্রক্কালে গরমের শুরুতে ঠান্ডা পানীয় বা আইসক্রিম খাওয়ার প্রবণতার কারণে, এমনকি বাচ্চারা স্কুলে বা অন্যান্য জায়গায় ধুলাবালিতে খেলাধুলা করলেও এসব রোগ বাড়ার আশঙ্কা থাকে। যারা হাঁপানি, ব্রংকাইটিস বা শ্বাসজনিত অন্যান্য রোগে ভোগেন, তাদের এ রোগের প্রকোপ শীতের পর বসন্তে এমনকি গরমের শুরুতে বাড়তে পারে। এ ছাড়া নিউমোনিয়া ও এর সঙ্গে জ্বর ও শ্বাসকষ্টও হয়ে থাকে। তাই কালক্ষেপণ না করে যত দ্রুত সম্ভব চিকিৎসকের পরামর্শ নেওয়া উচিত।

এ সময় কিছুটা বৃষ্টির ফলে আবহাওয়াও স্যাঁতসেঁতে হয়ে ওঠে। এই জমে থাকা পানিতে এডিস মশা জন্ম নেয়। এ মশা ডেঙ্গুজ্বরের জীবাণু বহন করে। এডিস মশা সাধারণত দিনের বেলায় কামড়ায়। তাই যেসব স্থানে পানি জমে থাকতে পারে যেমন টব, ডাবের খোসা, প্লাস্টিক কনটেইনার পরিষ্কার ও শুকনো রাখতে হবে। অনেকে ড্রইংরুম গাছ দিয়ে সাজাতে পছন্দ করেন। সেক্ষেত্রে প্রতিদিন টব রাখার স্থান ভালোভাবে মুছে পরিষ্কার রাখতে হবে। ডেঙ্গুজ্বরের প্রকোপ দেখা দিলে যত তাড়াতাড়ি সম্ভব বিশেষজ্ঞের পরামর্শ নিতে হবে। বর্ষায় জমে থাকা বৃষ্টির পানি এবং স্যাঁতসেঁতে আবহাওয়ার কারণে যে রোগটি বেশি সংক্রমিত হয় তা হচ্ছে ফাঙ্গাল ইনফেকশন বা চর্মরোগ। দাদ জাতীয় গোল চাকাচাকা ফাঙ্গাল শরীরের নানা জায়গায় হতে পারে। অসহ্য চুলকানি হয়। এগুলো গোলগাল রিং আকারে শরীরে বাড়তে থাকে। তাই অনেক সময় একে রিংওয়ার্মও বলা হয়ে থাকে। আঙ্গুলের ফাঁকে ঘা বর্ষাকালে একটি অতিপরিচিত সমস্যা এবং এতে মিক্সব্যাকটেরিয়াল ও কেনডিডাল ইনফেকশন হতে পারে। এসব সমস্যা এড়াতে বর্ষায় ত্বকের যত্ন নেওয়া প্রয়োজন। নিয়মিত ত্বক পরিষ্কার রাখা, সাবান দিয়ে গোসল করা, জামা-কাপড় নিয়মিত পাল্টানো বা পরিষ্কার রাখা এসব সমস্যা থেকে দূরে থাকতে সাহায্য করে। ফাঙ্গাল ইনফেকশনে চিকিৎসকের পরামর্শ নেওয়া উচিত। আরও কিছু কিছু রোগ হওয়ার প্রাদুর্ভাব লক্ষ্য করা যায়, যেমন প্রচন্ড গরমে পিপাসার কারণে রাস্তাঘাটে পানি বা শরবত পান করার ফলে পানিবাহিত রোগ বেশি হতে দেখা যায়। দ্রুত নষ্ট হয়ে যাওয়া খাদ্যদ্রব্য, ফলমূল গ্রহণ করার ফলে প্রায়ই ডায়রিয়াজনিত রোগব্যাধি দেখা দেয়। এমনকি টাইফয়েড, জন্ডিস, রক্ত আমাশয়ও হতে পারে।

সতর্কতামূলক ব্যবস্থা :

(১) ধুলাবালি পরিহার করতে হবে, অতিরিক্ত গরমে যাওয়াও এড়িয়ে চলতে হবে এবং ঘাম হলে মুছে ফেলতে হবে। (২) মনে রাখতে হবে জ্বর এবং কাশি যদি দুই সপ্তাহের বেশি হয়, সর্দি একেবারে সারে না, তবে চিকিৎসকের পরামর্শ নিতে হবে। অযথা অবহেলা করলে অসুখ জটিল হয়ে যেতে পারে। ভাইরাসজনিত অসুখে আক্রান্ত রোগীর কাছ থেকে যথাসম্ভব দূরে থাকতে হবে। (৩) যারা হাঁপানিসহ অন্যান্য শ্বাসযন্ত্রের রোগে ভোগেন তারা বাইরে বেরোলে ধুলাবালি পরিহার করুন, প্রয়োজনে মাস্ক ব্যবহার করলে আরো ভালো হয়। বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই ঠান্ডা পানি বা খাবার খাওয়া, ধুলাবালিতে যাওয়া ইত্যাদি পরিহার করলে এসব রোগ থেকে নিরাপদ থাকা সম্ভব। (৪) সব সময় পর্যাপ্ত পরিমাণে বিশুদ্ধ পানি পান করতে হবে। যেখানে-সেখানে দূষিত পানি বা অন্যান্য পানীয় খাওয়া বর্জন করতে হবে। পানি বা অন্য তরল জাতীয় পান করুন অন্য সময়ের চেয়ে একটু বেশি, শুধু যেন হয় বিশুদ্ধ। বিশেষ করে যারা অতিরিক্ত গরম পরিবেশে কাজকর্ম করেন তাদের বেলায় তরল পানীয়ের সঙ্গে লবণ মিশিয়ে নেবেন। ওরস্যালইনও খেতে পারেন। (৫) পুষ্টিকর ও সুষম খাদ্য গ্রহণ, কাঁচাসবজির সালাদ, ভিটামিন ‘এ’ ও ‘সি’যুক্ত ফলমূল গ্রহণ এবং পর্যাপ্ত পানি পান করা।

(৬) নিয়মিত ও পরিমিত কায়িক পরিশ্রম এবং ধূমপান পরিহার করা উচিত। (৭) ঘরবাড়ি তথা ব্যক্তিগত পরিচ্ছন্নতা নিশ্চিত করা। ঘরের দরজা-জানালা খুলে পর্যাপ্ত পরিমাণে আলো-বাতাস প্রবেশের সুযোগ করে দিয়ে একটি নির্মল বসবাসের পরিবেশ নিশ্চিত করা। (৮) হাত ধোয়ার অভ্যাস করা, বিশেষ করে নাক মোছার পর পর, বাইরে থেকে এসে এবং খাদ্যবস্তুর সংস্পর্শে। (৯) প্রতি বছর ইনফ্লুয়েঞ্জার এবং পাঁচ বছর পর পর নিউমোনিয়ার টিকা নেওয়া উচিত। ঋতু পরিবর্তন চিরন্তন। সময়ের সঙ্গে আসবে গ্রীষ্ম, বর্ষা, শরৎ, মেহন্ত। আর এর সঙ্গে একেক সময় একেক রোগব্যাধির প্রকোপ হতে থাকবে। সে অনুযায়ী সবাইকে প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থা নিতে হবে।

মনে রাখতে হবে প্রতিকারের চেয়ে প্রতিরোধই উত্তম।

লেখক : ইমেরিটাস অধ্যাপক ও প্রধানমন্ত্রীর ব্যক্তিগত চিকিৎসক।

সর্বশেষ খবর