মূল্যস্ফীতির আগুনে পুড়ছে সাধারণ মানুষ। দেশের সামষ্টিক অর্থনীতিও চাপের মুখে পড়েছে। সরবরাহ কমে যাওয়ায় ডলারের বাজারে তৈরি হয়েছে এক ধরনের নৈরাজ্য। প্রায় ছয় মাস ধরে অব্যাহতভাবে বাড়ছে ডলারের দর। অবশ্য সর্বশেষ ১২১ টাকায় ওঠার পর গত দুই দিন ধরে ডলারের বাজার কিছুটা নিম্নমুখী। এ ছাড়া আন্তর্জাতিক বাজারে জ্বালানি তেলের দাম ছয় মাসের মধ্যে সর্বনিম্নে নেমেছে কিন্তু দেশের বাজারে কমার ইঙ্গিত আপাতত নেই। জ্বালানি প্রতিমন্ত্রীর ভাষ্য মতে, জ্বালানি তেলের দাম সমন্বয় করা হবে। তবে কবে করা হবে তা তিনি নির্দিষ্ট করে বলেননি। ফলে চলতি মাস শেষেও মূল্যস্ফীতির চাপ বেশিই থাকবে বলে ধারণা করছেন বিশেষজ্ঞরা।
এদিকে টিসিবির হিসাবে এক বছরের ব্যবধানে চালের দাম অন্তত ১২-১৪ শতাংশ বেড়েছে। আটা-ময়দার দাম বেড়েছে ৫৫-৭৫ শতাংশ পর্যন্ত। সয়াবিন তেলের দামও বেড়েছে প্রায় ৩৮-৫০ শতাংশ। ডিমের দাম বেড়েছে ৫৫ শতাশং। এ ছাড়া মাছ, মাংস, সবজি, তরকারি সব পণ্যের দামই বেড়েছে। এখনো বাড়ছে। বাজারে এখন ৫৫ টাকার নিচে কোনো চাল পাওয়া যায় না। সরু চালের কেজি বেড়েছে ১০-১২ টাকা পর্যন্ত। বাজারে খোলা সাদা আটাও ৫০-৫৫ টাকা কেজিতে উঠেছে। আর প্যাকেজের দুই কেজি আটার দাম উঠেছে ১১৫-১২০ টাকায়। যা এক বছর আগে ছিল ৭০-৭৫ টাকা। মসুর ডালের দাম বেড়েছে প্রায় ৪৫ শতাংশ। আলুর বাজারও চড়া। লবণও কেজিতে বেড়েছে ১০ টাকা। কাঁচামরিচ তো ট্রিপল সেঞ্চুরির পথে। ফলে মাছ, মাংস বাদ দিয়ে ডিম-ভাজি, আলু ভর্তা, ডাল-ভাতও যেন এখন বিলাসী খাবার। অথচ মানুষের আয় বাড়েনি মোটেও। ফলে মূল্যস্ফীতির জাঁতাকলে পিষ্ট হচ্ছে নিম্ন আয়ের মানুষ।
বিবিএসের তথ্য মতে, খাদ্যপণ্যের দাম লাগামহীনভাবে বেড়ে যাওয়ায় বাড়ছে মূল্যস্ফীতির চাপ। চলতি অর্থবছরের প্রথম মাস জুলাইয়ে দেশের সার্বিক মূল্যস্ফীতি দাঁড়িয়েছে ৭ দশমিক ৪৮ শতাংশে, যা জুনে ছিল ৭ দশমিক ৫৬ শতাংশ। তবে জ্বালানি তেলের দাম বাড়ার প্রভাবে আগামী মাসেই মূল্যস্ফীতির চাপে আরও বড় উল্লম্ফন দেখা দেবে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে। করোনা মহামারির প্রভাব কাটার আগেইশুরু হওয়া রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ বৈশ্বিক সংকটের মধ্যে ঘি ঢেলেছে। যার ফলে জ্বালানির দাম বেড়েছে দফায় দফায়। অবশ্য গত এক মাস ধরে জ্বালানি তেলের দাম ক্রমাগত কমছে। কিন্তু সরকারের ভাষ্য অনুযায়ী, লোকসান ঠেকাতে বাংলাদেশের বাজারে রেকর্ড দাম বাড়ানো হয়েছে। এতে বেসামাল হয়ে গেছে দেশের পণ্যমূল্য। সব ধরনের পণ্যের বাজারে চলছে রীতিমতো পাগলা ঘোড়ার রেস। এমন কি বাংলাদেশে জিনিসপত্রের দাম বৃদ্ধির প্রভাবটা একটু বেশিই বলে মনে করেন বিশ্লেষকরা
প্রবীণ অর্থনীতিবিদ ও সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা ড. এ বি মির্জ্জা আজিজুল ইসলাম বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, জ্বলানি তেলের মূল্য বৃদ্ধির বহুমুখী প্রভাবের ফলে সব কিছুরই দাম বেড়েছে। বিশেষ করে খাদ্যপণ্যের দাম যে হারে বেড়েছে তাতে মূল্যস্ফীতির চাপে ঊর্ধ্বমুখিতাই থাকবে আরও কিছুদিন। মানুষকে স্বস্তি দিতে হলে এ চাপ কমাতে হবে। অন্যথায় জিনিস পত্রের দাম সহসাই কমবেও না বলে তিনি মনে করেন। এ ছাড়া বৈশ্বিক অবস্থার প্রেক্ষিতে জিনিসপত্রের দাম নিয়ন্ত্রণে এ খাতে সরকারের কঠোর নজরদারিরও অভাব রয়েছে বলে তিনি মনে করেন। এদিকে আবার সরকারের চলতি হিসাবেও বা ব্যালেন্স অব পেমেন্টের ক্ষেত্রে ইতিহাসের সর্বোচ্চ ঘাটতির সৃষ্টি হয়েছে। এরই মধ্যে জ্বালানি তেল ডিজেল, পেট্রোল, কেরোসিন ও অকটেনের দাম বাড়িয়েছে সরকার। সরকারের এই সিদ্ধান্তের কারণে বিভিন্ন ক্ষেত্রে উৎপাদন বাধাগ্রস্ত হচ্ছে, ইতোমধ্যেই বেড়েছে উৎপাদন ব্যয়। যার ফলে বেড়েছে সব জিনিসপত্রের দাম। ফলে মূল্যস্ফীতি আরও বেড়ে যাবে। প্রচ- চাপে পড়বে নিম্নআয়ের মানুষ। ইতোমধ্যেই নিম্ন আয়ের মানুষ আমিষ ছেড়ে সবজির প্রতি নির্ভরতা বাড়িয়েছে। অবশ্য সবজির বাজারও অনেক চড়া। মাছ, মাংস, দুধ, ডিম তো এখন নিম্ন, মধ্যবিত্তের জন্য বিলাসিতায় পরিণত হয়েছে। একই সঙ্গে সব ধরনের খরচ বেড়েছে। পরিবহন ব্যয়, বাসা ভাড়াসহ সব ধরনের খরচ বেড়েছে। যার প্রভাবে জিনিসপত্রের দাম বাড়ছে হু হু করে। মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে জিনিসপত্রের দাম নিয়ন্ত্রণের কোনো বিকল্প নেই বলে মনে করেন বিশ্লেষকরা।