শিরোনাম
সোমবার, ২১ ডিসেম্বর, ২০১৫ ০০:০০ টা

এটাই বাংলাদেশ!

মাহমুদ হোসেন

এটাই বাংলাদেশ!

২০০৪ সালের একটি ঘটনা সারা দেশকে প্রবলভাবে নাড়া দেয়। প্রসববেদনা ওঠায় দহগ্রামের সকিনা বেগমকে তার স্বামী পাটগ্রামে নিয়ে যাওয়ার জন্য রওনা দেয়। তিন বিঘা করিডরের কাছে যেতেই তারা আবিষ্কার করে যে, করিডরটি বন্ধ হয়ে গেছে। কারণ ততক্ষণে সন্ধ্যা ৬টা ৩০ মিনিট বেজে গেছে। আর সেই সময় দহগ্রাম আঙ্গরপোতার করিডরটি খোলা থাকত ভোর ৬টা ৩০ মিনিট থেকে সন্ধ্যা ৬টা ৩০ মিনিট পর্যন্ত। তার স্বামী বিএসএফ সদস্যদের সঙ্গে যোগাযোগ করে তাদের অবস্থা সম্পর্কে জানিয়েছিলেন কিন্তু তাতে কোনো কাজ হলো না। সকিনা বেগম করিডর গেটের সামনে প্রসববেদনায় মৃত্যুবরণ করেন। সেই অসহ্য অবস্থাও এখন পাল্টেছে। দহগ্রামে শুধু এখন একটি হাসপাতালই নয়, টেলিকনফারেন্সিংয়ের মাধ্যমে অত্যাধুনিক চিকিত্সাসেবা গ্রহণের ব্যবস্থাও রয়েছে।

সম্প্রতি গ্রামীণফোনের থ্রিজি সেবা উদ্বোধন উপলক্ষে দহগ্রামে গিয়ে নিজের চোখেই দেখলাম সব। পরিবর্তনটা স্পষ্ট। হঠাত্ বড় হয়ে যাওয়া চোখগুলোতে স্বপ্নগুলো আরও স্পষ্টভাবে দৃশ্যমান। দেশাত্মবোধের আশা, আকাঙ্ক্ষা, ভালোবাসা, আনন্দ-অনুভূতির এক অকল্পনীয় দৃশ্য। স্পষ্টভাবেই গর্বিত হওয়ার ধ্বনিগুলো উচ্চারিত হচ্ছিল চারপাশ থেকে। শুনছিলাম কিভাবে বছরের পর বছর বাংলাদেশকে শক্তভাবে মনের মধ্যে ধরে রেখেছেন প্রতিটি দহগ্রামবাসী। শহুরে লেবাসের আমরা কজন ওদের মধ্যে যেন এক নতুন বাংলাদেশ খুঁজি।  তারপরও জিজ্ঞাসা করি ‘ইন্টারনেট দিয়ে কি হয়?’ উত্তর এলো ‘শুনছি ইন্টারনেট দিয়ে নাকি সব জানা যায়।’ উত্তর দিয়ে একটু লজ্জা পেয়ে দৌড়ে পালিয়ে গেল কম বয়সী মেয়েটি। ওর নামটি জিজ্ঞাসা করার সুযোগ আর পেলাম না। স্কুলড্রেস দেখে বুঝলাম হয়তো পড়াশোনা করছে আশপাশে কোথাও। ক্ষণিকের এই বিনিময়ে যতটা বেশি আবেগি ছিলাম তারচেয়ে অনেক বেশিভাবে আশা সঞ্চারিত হচ্ছিল এই ভেবে যে, এই দহগ্রাম কোনোদিক দিয়েই পিছিয়ে নেই। একটু জায়গায় থ্রিজি পেয়ে এখানে এই তরুণ, প্রৌঢ়, এমনকি বয়স্কদের যে উচ্ছ্বাস দেখলাম তা আমাদের অনেক বুদ্ধিবৃত্তিক ধারণাকে প্রশ্নের সামনে দাঁড় করায়। কোনো সন্দেহ নেই, আমরা যেমন ভাবছি ওরা তারচেয়ে বেশি, অনেক বেশি এগিয়ে। ওদের চোখে বাংলাদেশ আরও বেশি বড় ও শক্তিশালী। দহগ্রামের মতো এমন একটি প্রত্যন্ত অঞ্চলে থ্রিজি সেবা চালু করার পরিকল্পনাটি যখন একেবারে প্রাথমিক পর্যায়ে ছিল আমরা ভেবেছিলাম এ প্রযুক্তি ব্যবহারে এখানে কাউকে খুঁজে পাওয়া যাবে না। অবাক হলাম উদ্বোধনের পরমুহূর্তে যখন অনেকের হাতেই স্মার্টফোন দেখলাম। আর এদের বেশিরভাগই জানে কিভাবে ইন্টারনেট ব্যবহার করতে হয়। থ্রিজি সেবার আওতায় এমন একটি এলাকার মানুষকে নিয়ে আসতে হবে এমন পরিকল্পনায় একবারের জন্যও কেউ ব্যবসায়িক দিক নিয়ে তর্ক করেনি। লালমনিরহাট জেলার শেষ প্রান্তে ভারত সীমান্ত ঘেঁষে তিন বিঘা করিডর পেরিয়ে দহগ্রামে প্রথম ইন্টারনেট সেবা প্রদানকারী প্রতিষ্ঠান হিসেবে গ্রামীণফোনের নাম ইতিহাসের পাতায় স্থান পেয়ে গেছে। প্রযুক্তিগতভাবে এখন আমরা সবাই এক ও সমমর্যাদার। এমন একটি অনুভূতির সঙ্গে রাষ্ট্রের সর্বোচ্চ পর্যায় থেকে যখন একাত্মতা প্রকাশ করা হয় সে উদ্যোগের আর কোনো থেমে থাকার উপায় নেই। গ্রামীণফোন থেকে আমাদের পরিকল্পনা সে রকমই। থ্রিজি নেটওয়ার্ক বিস্তারে আমরা এগিয়ে থাকব, এতে কোনো সন্দেহ নেই। বেশ কয়েক বছর আগেও লালমনিরহাটকে ধরা হতো মঙ্গাপীড়িত এলাকা হিসেবে। তবে সেই দিন অতিক্রান্ত হয়েছে অনেক আগেই। এখন লালমনিরহাট স্বয়ংসম্পূর্ণ। কয়েকদিন আগেই জেলাটিকে ঘোষণা করা হয়েছে বাল্যবিবাহমুক্ত একটি জেলা হিসেবে।  তবে এই  এই অঞ্চলটির অর্থনৈতিক দিক বা যোগাযোগের দিকের গুরুত্ব অনেক আগেই উপলব্ধি করা গেছিল যখন দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় মিত্রবাহিনী এখানেই প্রতিষ্ঠা করেছিল উপমহাদেশের অন্যতম বৃহত্ বিমানবন্দর। দোষ কোথায় যদি এই স্বপ্ন দেখা হয় যে, বাংলাদেশের সর্বশ্রেষ্ঠ ওয়েব ডেভেলপার উঠে আসবে দহগ্রাম থেকে অথবা বিশ্বের সবচেয়ে চমকপ্রদক ইন্টারনেট স্টার্টআপ ব্যবসায়ের পরিকল্পনা তৈরি করবে দহগ্রামের সেই মেয়েটি।

লেখক : চিফ করপোরেট অ্যাফেয়ার্স

অফিসার, গ্রামীণফোন লি.

এই রকম আরও টপিক

সর্বশেষ খবর