রবিবার, ১৬ অক্টোবর, ২০২২ ০০:০০ টা

ইউক্রেনকে ৪০ কোটি ডলার সহায়তা দিচ্ছে সৌদি আরব

ইউক্রেনকে ৪০ কোটি ডলার সহায়তা দিচ্ছে সৌদি আরব

মোহাম্মদ বিন সালমান

মানবিক সহায়তার অংশ হিসেবে ইউক্রেনকে ৪০ কোটি ডলার দেওয়ার ঘোষণা দিয়েছেন সৌদি আরবের যুবরাজ ও প্রধানমন্ত্রী মোহাম্মদ বিন সালমান। গতকাল দেশটির রাষ্ট্রায়ত্ত বার্তাসংস্থা এসপিএ নিউজ এজেন্সি এ তথ্য নিশ্চিত করেছে। এসপিএর প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, শুক্রবার ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট জেলেনস্কির সঙ্গে টেলিফোনে কথা বলেন সৌদি যুবরাজ। সে সময়ই ইউক্রেনে এই আর্থিক সহায়তা পাঠানোর ইচ্ছা প্রকাশ করেন তিনি। সেসঙ্গে বলেন, ‘ইউক্রেনে যুদ্ধের তীব্রতা কমিয়ে আনা এবং কূটনৈতিক আলাপ-আলোচনা, তৎপরতার মাধ্যমে রাশিয়া ও ইউক্রেনের মধ্যকার যাবতীয় মতপার্থক্য দূর করতে নিজের ক্ষমতা ও সামর্থ্য অনুযায়ী প্রচেষ্টা চালিয়ে যাবে সৌদি আরব।’

জবাবে সৌদি যুবরাজকে দেশের প্রধানমন্ত্রীর পদ পাওয়া উপলক্ষে অভিনন্দন জ্ঞাপন করেন জেলেনস্কি। পাশাপাশি, জাতিসংঘে রাশিয়ার বিরুদ্ধে ভোট দেওয়ায় ধন্যবাদও জানান। মোহাম্মদ বিন সালমান অবশ্য বলেছেন, সৌদি আরব বরাবরই জাতিসংঘের সনদ ও আন্তর্জাতিক আইনের প্রতি শ্রদ্ধাশীল এবং এ বিষয়ে দেশটির দৃঢ় অবস্থানের প্রতিফলন ঘটেছে জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদের রেজুলেশনে ভোটদানের সময়। পরে এক টুইটবার্তায় ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট বলেন, ‘সৌদি আরবের যুবরাজ মোহাম্মদ বিন সালমানের সঙ্গে কথা হয়েছে। জাতিসংঘের রেজুলেশনে ইউক্রেনের আঞ্চলিক অখন্ডতা রক্ষার পক্ষে ভোট দেওয়ার জন্য তাকে ধন্যবাদ।’ গত ৯ মাসের সামরিক অভিযানে ইউক্রেনের চার প্রদেশ খেরসন, ঝাপোরিজ্জিয়া, দনেৎস্ক ও লুহানস্ক নিজেদের দখলে আনতে সক্ষম হয় রুশ বাহিনী। এই চার প্রদেশের সম্মিলিত আয়তন ইউক্রেনের মোট ভূখন্ডের ১৫ শতাংশ। গত ৩০ সেপ্টেম্বর খেরসন, ঝাপোরিজ্জিয়া, দনেৎস্ক ও লুহানস্ককে আনুষ্ঠানিকভাবে রুশ ভূখন্ডের অংশ হিসেবে স্বীকৃতি দেন রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভøাদিমির পুতিন। ইউক্রেনে অভিযানরত রুশ বাহিনীকে আর অগ্রসর না হওয়ার আহ্বান জানিয়ে বুধবার রেজুলেশন উত্থাপন করে জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদে। সেই রেজুলেশনের পক্ষে ভোট দিয়েছে সৌদি আরবসহ জাতিসংঘের ১৪২টি সদস্যরাষ্ট্র। প্রসঙ্গত, গত ৯ মাসের অভিযানে এই প্রথম ইউক্রেনকে আর্থিক সহায়তা দিচ্ছে সৌদি আরব।

এদিকে ইউক্রেনে রুশ আগ্রাসনের নয় মাসের মাথায় রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভøাদিমির পুতিন ঘোষণা দিয়ে বলেছেন ইউক্রেনে রুশ বাহিনী আর বড় কোনো হামলা চালাবে না। কারণ হিসেবে তিনি উল্লেখ করেন, রাশিয়া ইউক্রেনকে ধ্বংস করতে চায় না। এ ছাড়া ইউক্রেন যুদ্ধে ‘রিজার্ভ সেনা’ হিসেবে দেশের সক্ষম নাগরিকদের বাধ্যতামূলক যোগদানের যে প্রক্রিয়া চলছে, তা আগামী দুই সপ্তাহের মধ্যে শেষ হয়ে যাবে বলে নিশ্চিত করেছেন রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট। তবে তিনি এও বলেছেন, ইউক্রেনে সামরিক অভিযানের জন্য তিনি অনুতপ্ত নন।

শুক্রবার কাজাখস্তানের রাজধানী আস্তানায় এক সংবাদ সম্মেলনে সাংবাদিকদের প্রশ্নের উত্তরে   পুতিন বলেন, ‘ইউক্রেনকে ধ্বংস করে দেওয়ার কোনো ইচ্ছে বা পরিকল্পনা আমাদের নেই। একটি দেশ ধ্বংস হয়ে যাক, তা আমরা কখনো চাইব না।  এ কারণে সেখানে আর বড় কোনো হামলা হবে    না।’ আল-জাজিরা ও রয়টার্স

‘সেই সঙ্গে আমি আরও একটি তথ্য দিতে চাই, তা হলো- সামরিক অভিযানে রিজার্ভ সেনা হিসেবে রুশ নাগরিকদের নিয়োগের যে প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে, তা আগামী দু’সপ্তাহের মধ্যেই শেষ হয়ে যাবে।’ এশীয় এবং ইউরেশীয় দেশগুলোর জোট কনফারেন্স অন ইন্টার‌্যাকশন অ্যান্ড কনফিডেন্স বিল্ডিং মেজার্স ইন এশিয়ার (সিআইসিএ) সম্মেলনে যোগ দিতে গত ১৩ অক্টোবর কাজাখস্তানের রাজধানী আস্তানায় গিয়েছেন রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট। সেখানেই আয়োজন করা হয়েছিল এই সংবাদ সম্মেলনের। আস্তানার সংবাদ সম্মেলনে উপস্থিত বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সংবাদমাধ্যমের একাধিক সাংবাদিক জানিয়েছেন, শুক্রবারের সংবাদ সম্মেলনে পুতিনের চিরাচরিত গম্ভীর-দৃঢ় চেহারা দেখা যায়নি, বরং এদিন তার চেহারা ও কণ্ঠস্বর ছিল বেশ কোমল। সাবেক সোভিয়েত ইউনিয়নের অন্যতম অঙ্গরাজ্য ইউক্রেন ১৯৯১ সালে সোভিয়েত ভেঙে যাওয়ার পর স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবে আত্মপ্রকাশ করে। দেশটির মোট জনসংখ্যার ৩০ শতাংশ সরাসরি রুশ বংশো™ূ¢ত এবং রুশভাষী। সোভিয়েত আমলে রুশ জনগোষ্ঠীর সঙ্গে ইউক্রেনীয় জনগোষ্ঠীর মোটামুটি সদ্ভাব বজায় থাকলেও ইউক্রেন স্বাধীন হওয়ার পর দ্বন্দ্ব শুরু হয় এই দুই জনগোষ্ঠীর মধ্যে। ইউক্রেনের রুশভাষী লোকজন বরাবরই নিজেদের রাশিয়ার অংশ হিসেবে বিবেচনা করে। অন্যদিকে ইউক্রেনীয়রা সবসময় নিজেদের স্বাধীন ও স্বতন্ত্র জাতি মনে করতে অভ্যস্ত। এটিই মূলত দুই জনগোষ্ঠীর দ্বন্দ্বের মূল কারণ। স্বাধীন হওয়ার পর থেকে ইউক্রেনে এই ইস্যুতে তাদের মধ্যে দ্বন্দ্ব-সংঘাত লেগেই ছিল। ১৯৯১ সালের পর গত ৩ দশকে ইউক্রেনে জাতিগত সংঘাতে নিহত হয়েছেন ১৫ হাজারেরও বেশি মানুষ। ২০১৪ সালে ইউক্রেনের ক্রিমিয়া উপদ্বীপ দখল করে নেয় রাশিয়া। এক্ষেত্রে ক্রিমিয়ার রুশভাষী জনগোষ্ঠী রাশিয়ার সেনাবাহিনী ও সরকারকে সরাসরি সহায়তা করেছিল। এদিকে সোভিয়েত ইউনিয়ন থেকে স্বাধীনতা লাভের পর থেকেই রাশিয়ার প্রধান বৈরীপক্ষ যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপের রাজনৈতিক বলয়ে ঢুকতে দেন-দরবার করছিল ইউক্রেন। রাশিয়ার কাছে ক্রিমিয়া হারানোর পর এই তৎপরতা আরও বৃদ্ধি পায়। ২০১৮ সালে যুক্তরাষ্ট্রের নেতৃত্বাধীন সামরিক জোট ন্যাটোর সদস্যপদের জন্য আবেদন করে ইউক্রেন। ইউক্রেনের এসব কর্মকান্ডে ক্ষুব্ধ হয় মস্কো এবং ইউক্রেনকে ন্যাটোর সদস্যপদের জন্য আবেদন প্রত্যাহার করে নেওয়ার আহ্বান জানায় তারা। কিন্তু কিয়েভ তাতে কান দেয়নি। প্রায় চার বছর এই ইস্যুতে দুই দেশের মধ্যে দ্বন্দ্ব চলার পর অবশেষে এ বছরের (২০২২) ২৬ ফেব্রুয়ারি রুশ বাহিনীকে ইউক্রেনে বিশেষ সামরিক অভিযান শুরুর নির্দেশ দেন ভøাদিমির পুতিন। গত ৯ মাসের অভিযানে ইউক্রেনের চার প্রদেশ খেরসন, ঝাপোরিজ্জিয়া, দনেৎস্ক ও লুহানস্ক দখল করে নিজের সীমানভুক্ত করেছে রাশিয়া। হাজার হাজার সামরিক-বেসামরিক মানুষ নিহত হয়েছেন এ অভিযানে। ইউক্রেনের ছোট-বড় প্রায় সব শহর গোলার আঘাতে বিধ্বস্ত হয়েছে। অভিযানে অবশ্য রাশিয়ারও ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে। রুশ প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ের তথ্য অনুযায়ী, যুদ্ধে এ পর্যন্ত নিহত হয়েছেন ৬ হাজারেরও বেশি রুশ সেনা। এ ছাড়া যুদ্ধ শুরুর পর থেকে যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপ একের পর এক নিষেধাজ্ঞা জারি করেছে রাশিয়ার ওপর। এসব নিষেধাজ্ঞার কারণে বেশ বড় ধাক্কা খেয়েছে রাশিয়ার অর্থনীতি। তবে আস্তানার সংবাদ সম্মেলনে পুতিন বলেছেন, ইউক্রেনে সামরিক অভিযানের জন্য তিনি অনুতপ্ত নন। কারণ তার মতে, এই অভিযান অবশ্যম্ভাবী ছিল। ‘আমি পরিষ্কারভাবে বলতে চাই, (ইউক্রেনে) আজ যা হচ্ছে, তা অপ্রীতিকর ও অনাকাক্সিক্ষত; কিন্তু পরিস্থিতি যেদিকে যাচ্ছিল-তাতে চলতি বছরই, কিংবা তার পরের বছর এই সংঘাত অবশ্যম্ভাবী ছিল এবং সেক্ষেত্রে প্রাণহানি ও ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ হতো আরও অনেক বেশি। আমরা ঠিক সময়ে ঠিক কাজটি করেছি।’

সর্বশেষ খবর