দখল আর দূষণে আপন রূপ হারাতে বসেছে লুসাই কন্যা কর্ণফুলী। পানিপ্রবাহ পরিবর্তনের কারণে জেগে উঠছে নতুন নতুন চর। অবৈধ দখলে ক্রমেই নদীর দুই পাড় সংকুচিত হয়ে পড়ছে। নদীর দুই পাড়ে অবস্থিত ৭৫০ থেকে এক হাজার শিল্পকারখানা থেকে নির্গত বিষাক্ত তরল ও কঠিন বর্জ্যে কর্ণফুলী এখন মূলত ভাগাড়ে পরিণত হয়েছে। কাগজকল, রং কারখানা, বিদ্যুৎকেন্দ্র,সার কারখানা, ট্যানারি, তেল কারখানা, সাবান ফ্যাক্টরি, রেওন মিল, রাসায়নিক পদার্থ উৎপাদন কেন্দ্র এবং টেক্সটাইল মিল থেকে নির্গত বর্জ্য প্রতিনিয়ত দূষণ করছে দেশের অন্যতম প্রধান এই নদীকে। এ ধরনের ১৫০টি কারখানা থেকে ৬২ ধরনের ক্ষতিকর রাসায়নিক পদার্থ কর্ণফুলীর পানির সঙ্গে মিশে পানিকে দূষিত করছে বলে আশঙ্কাজনক তথ্য দিয়েছেন পরিবেশবিদরা। পরিবেশবিদদের মতে, স্বাভাবিক পানির প্রতি লিটারে যেখানে ৪.৫ থেকে ৮.৫ মিলিগ্রাম দ্রবীভূত অক্সিজেন থাকার কথা, সেখানে কর্ণফুলীর পানিতে রয়েছে ০.১ মিলিগ্রাম। অক্সিজেনের অভাবে পানিতে জলজ প্রাণী বাস করতে পারছে না। সাধারণ পানির ক্লোরাইডের মাত্রা লিটার প্রতি ১৫০ থেকে ৬০০ গ্রাম থাকার কথা থাকলেও কর্ণফুলীতে আছে অনেক বেশি। পানির দ্রবীভূত কঠিন পদার্থের মাত্রা যেখানে প্রতি লিটারে ১০০ মিলিগ্রাম হওয়ার কথা, সেখানে কর্ণফুলীর পানিতে রয়েছে ২৪৩ মিলিগ্রাম। কর্ণফুলী নদীর দূষিত বর্জ্য মিশ্রিত পানিতে কাপ্তাই ও রাঙ্গুনিয়ার শত শত একর জমি কৃষকরা চাষাবাদ করছেন। ফলে কস্টিক পানির কারণে মাটির উর্বরতা শক্তি নষ্ট হচ্ছে। এতে ফসলের উৎপাদন কমে এসেছে। অন্যদিকে নদীর দূষিত পানি ব্যবহারের ফলে হাজার হাজার মানুষ স্বাস্থ্যঝুঁকিতে রয়েছেন। এ নদীর পানির ক্রোমিয়ামের মাত্রা ২২০ পিপিএম (PPM-Parts Per Million) যা সাধারণ মাত্রার চেয়ে অনেক বেশি। পানির ক্যাডমিয়াম ও মারকারির মাত্রাও সাধারণ মাত্রার চেয়ে অনেক বেশি। এ ছাড়া, কর্ণফুলীর পানিতে কলিফরমের মাত্রা স্বাভাবিকের চেয়ে প্রায় দশ গুণ বেশি বলে জানান পরিবেশ বিজ্ঞানী মাহাবুব সরওয়ার। দূষণ প্রতিরোধে ইটিপি বসানোর আইন থাকলেও কেউ তা মানছে না। সিটি করপোরেশন এলাকার প্রায় ৫০ লাখ জনসংখ্যার পয়ঃবর্জ্য বর্ষাকালে ধুয়ে দূষিত পদার্থ এ নদীর পানিতে গিয়ে মিশে। এ ছাড়াও, নদীর দুপাড়ের জনবসতি থেকে প্রতিদিন শত শত টন বর্জ্য কর্ণফুলীতে যোগ হচ্ছে। নদীর দুপাড়ের কৃষিজমিতে ব্যবহৃত রাসায়নিক সার বর্ষার পানিতে ধুয়ে কর্ণফুলীতে পড়ে পানি দূষিত করছে। প্রতিদিন হাজার হাজার ছোট-বড় নৌযান থেকে নির্গত তেল পানিতে মিশে নদীকে দূষিত করছে। যা মাছ ও জলজ উদ্ভিদের প্রজনন ও জীবনধারণের জন্য মারাত্দক ক্ষতিকর। পরিবেশ অধিদফতর, পরিবেশ বিষয়ক বেসরকারি সংগঠন, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণিবিদ্যা বিভাগ এবং সামুদ্রিক বিজ্ঞান ইনস্টিটিউটের একাধিক গবেষণায় কর্ণফুলী দূষণের এসব ভয়াবহ চিত্র উঠে এসেছে।
পরিবেশবাদী সংগঠনগুলোর মতে, ২৯২ বর্গমাইল লম্বা কর্ণফুলীর পাড়ে প্রায় দুই হাজার শিল্প প্রতিষ্ঠান রয়েছে। এর কোনোটিতেই বর্জ্য শোধনাগার নেই। পরিবেশবাদী সংগঠনগুলোর জরিপে ২১৭টি প্রতিষ্ঠান ভয়াবহভাবে তাদের বিষাক্ত বর্জ্য সরাসরি কর্ণফুলীতে নিক্ষেপ করছে। দূষণ তালিকার শীর্ষে রয়েছে চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশন, চট্টগ্রাম ওয়াসা, চট্টগ্রাম ইউরিয়া সার কারখানা ও কর্ণফুলী পেপার মিল (কেপিএম)। সরকারি এই প্রতিষ্ঠানগুলোরও কোনো বর্জ্য শোধনাগার নেই। শুধু সিটি করপোরেশনই প্রতিদিন প্রায় ৮০০ টন বর্জ্য কর্ণফুলীতে ফেলছে। কর্ণফুলীর এই ক্ষতিকর প্রভাব ইতোমধ্যে বঙ্গোপসাগরকেও গ্রাস করেছে। গত কয়েক বছরে সামুদ্রিক মৎস্য উৎপাদনের পরিমাণ কমে গেছে আশঙ্কাজনকভাবে। ১৯৭৬ সালে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের সামুদ্রিক বিজ্ঞান বিভাগের এক জরিপে দেখা যায়, কর্ণফুলীতে ৭৬ প্রজাতির মাছ বিচরণ করত। ২০০০ সালে অপর এক জরিপে মাত্র ৫৪ প্রজাতির মাছের অস্তিত্ব মিলেছে। ২৪ বছরের ব্যবধানে ২২ প্রজাতির মাছ হারিয়ে গেছে। আর এ জন্য পরিবেশ দূষণকেই দায়ী করছেন বিষেশজ্ঞরা। বিষাক্ত খাদ্য খেয়ে নানা প্রজাতির সামুদ্রিক প্রাণী ও জলজ উদ্ভিদেরও মৃত্যু হচ্ছে।
এ ব্যাপারে মৎস্য বিশেষজ্ঞ ও চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণিবিদ্যা বিভাগের শিক্ষক মনজুরুল কিবরিয়া জানান, এক সময় কর্ণফুলীতে স্বাদু পানি, মতুরা বা ব্রাকিশ (নোনা ও স্বাদু পানির মিশ্রণ) এবং নোনা এ তিন ধরনের পানির ১৪০ প্রজাতির মাছ বিচরণ করত। কিন্তু ব্যাপক হারে কলকারখানার বর্জ্য নিক্ষেপ, নদীর প্রবাহ কমে যাওয়া এবং নাব্যতা হ্রাস পাওয়ায় শতাধিক মৎস্য প্রজাতির মৃত্যু ঘটেছে। আগে কর্ণর্ফুলীতে বঙ্গোপসাগর থেকে ১৫/২০ প্রজাতির মাছ আসত প্রজনন করতে। বর্তমানে কর্নফুলী দূষিত হওয়ার কারণে হাতে গোনা কয়েক প্রজাতির মাছ আসছে। সরেজমিন দেখা যায়, কর্ণফুলী ও সাগরে চলাচলরত নৌযান এমনকি বহির্নোঙ্গরে অবস্থানরত বিদেশি জাহাজগুলো কোনো নিয়ম-নীতির তোয়াক্কা না করে বিষাক্ত তেলসহ বর্জ্য ফেলে সাগরে। দখল ও দূষণের সঙ্গে সঙ্গে বালু সন্ত্রাসীদের কবলে পড়ে ভয়াবহ বিপর্যয়ের মুখে পড়েছে কর্ণফুলী নদী। সরেজমিন দেখা গেছে, কর্ণফুলী নদীর বিপজ্জনক এলাকা বন্দর চ্যানেল ও সেতুর তলদেশ থেকেও অবৈধভাবে বালি উত্তোলন চলছে। এদিকে দেশের অর্থনীতির প্রাণ কর্ণফুলীর উভয় তীর ও নদীর বুকে জেগে ওঠা চর দখলের প্রতিযোগিতা শুরু হয়েছে। গত ১০ বছর ধরে রাজনৈতিক ছত্রছায়ায় চর দখলের প্রবণতা চলছে। যখন যে দল ক্ষমতায় আসে সে দলের প্রভাবশালী নেতাদের কালো থাবার শিকার হয় কর্ণফুলী। পরিবেশ অধিদফতরের এক গবেষণায় দেখা গেছে, গত ৮ বছরে কর্ণফুলীতে পলি জমা হওয়ার পরিমাণ স্বাভাবিকের চেয়ে ৩ গুণেরও বেশি বেড়ে গেছে। এর ফলে কর্ণফুলীর মোহনা থেকে উজানে ১৫ কিলোমিটার এলাকায় প্রচুর ডুবোচরসহ নদীর দুই পাশে ছোট-বড় প্রায় ২০টি চর গড়ে উঠেছে। শুধু তাই নয়, নাব্যতা হ্রাস পাওয়ায় ভাটির সময় ৩টি গুরুত্বপূর্ণ নৌঘাট পুরোপুরি বন্ধ থাকে। চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের সামুদ্রিক বিজ্ঞান ইনস্টিটিউটের পরিচালক ড. মোহাম্মদ এম. মারুফ হোসেন জানান, কর্ণফুলীর শাখা হালদা নদী, শিকলবাহা খাল, চানখালি খাল, শিলক খাল, ইছামতি খাল, গশ্চি খাল দিয়ে বছরে লক্ষাধিক টন পলি এসে কর্ণফুলীর মোহনায় জমা হচ্ছে। যে কারণে গত কয়েক বছরে কর্ণফুলীর মোহনা এলাকা, শাহ আমানত সেতুর ভাটি ও উজানে, বাংলা বাজার, শিকলবাহা, সদরঘাট, ফিরিঙ্গী বাজার ব্রিজ ঘাট ও বাকলিয়া এলাকায় ধু-ধু চর পড়েছে। শাহ আমানত ব্রিজ থেকে বন্দর মোহনা পর্যন্ত মাত্র ৩ কিলোমিটার এলাকায় নদীর উভয় তীরে ছোট-বড় ১৫টি চর জেগেছে। পরিবেশ অধিদফতরের চট্টগ্রাম বিভাগীয় পরিচালক জাফর আলম জানান, 'দূষণের পাশাপাশি কর্ণফুলী নদীর নাব্যতা হারানোও বড় সমস্যা। চট্টগ্রাম বন্দরের কারণে কর্ণফুলী নদীতে প্রতিবছর গড়ে দুই হাজার বিদেশি জাহাজ সমুদ্রে আসে। এসব দেশি-বিদেশি জাহাজ মেরামতের সময় ধাতব পদার্থ জিংক, সিসা, ক্যাডমিয়াম ও জাহাজে সঞ্চিত আর্বজনা পড়ে নদীর তলদেশ উঁচু হতে থাকে। চট্টগ্রাম মহানগরীতে স্যুয়ারেজ প্যান্ট না থাকায় প্রতিদিন কর্ণফুলীতে ১ হাজার ৪ দশমিক ৩৫ মেট্রিক টন বর্জ্য মেট্রোপলিটন এলাকার ৫টি খাল দিয়ে কর্ণফুলীতে পড়ছে। যা নদী ভরাট হওয়ার ক্ষেত্রে মুখ্য ভূমিকা পালন করছে।