সোমবার, ২৯ জুলাই, ২০১৩ ০০:০০ টা

শাহজালালে চোরাকারবারি ৪০ চক্র বেপরোয়া

প্রতিদিনই চালান হচ্ছে স্বর্ণ ও বৈদেশিক মুদ্রা

শাহজালালে চোরাকারবারি ৪০ চক্র বেপরোয়া

হজরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরকে কেন্দ্র করে গড়ে ওঠা দেশি-বিদেশি চোরাকারবারি ৪০ চক্র বেপরোয়া হয়ে উঠেছে। বিমানবন্দরের বিভিন্ন সংস্থার সদস্যদের সহযোগিতায় প্রায় প্রতিদিনই বিপুল পরিমাণ স্বর্ণ ও বৈদেশিক মুদ্রা চোরাচালান করছে এরা। চক্রের মূল হোতারা সিঙ্গাপুর, দুবাই, পাকিস্তান ও ভারতে বসে চোরাচালান নিয়ন্ত্রণ করছে। প্রতিবারের মতো এবারের ঈদ মৌসুমেও চোরাচালান বেড়ে গেছে। মাত্র দুই সপ্তাহের ব্যবধানে শাহজালাল বিমানবন্দরে বিমানের ফ্লাইট থেকে দুই চালানে ১৫০ কেজি স্বর্ণ উদ্ধার করা হয়। এর মধ্যে গত বুধবার এক চালানেই উদ্ধার করা হয়েছে রেকর্ড ১২৪ কেজি স্বর্ণের বার। তবে কোনো চালানেরই মালিক খুঁজে পাওয়া যায়নি।

সংশ্লিষ্টরা বলছেন, ঈদ মৌসুমে যাত্রীসাধারণের যাতায়াত বেড়ে যাওয়ায় বিমানবন্দরসংশ্লিষ্টরা তাদের নিয়েই ব্যস্ত বেশি থাকেন। এ সুযোগে বিশেষ সময়টি বেছে নেয় চোরাকারবারি চক্রগুলো। কখনো কখনো স্বর্ণের কোনো চালান কোথাও রেখে কাস্টমস বা সংশ্লিষ্টদের তথ্য দিয়ে দেওয়া হয়। সবাই ওই চালান নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়লে, চোখের সামনে দিয়েই পার হয়ে যায় কয়েক গুণ বড় চোরাচালান সামগ্রী। চোরাকারবারি চক্রের মূল হোতারা সবসময় ধরাছোঁয়ার বাইরে থাকায় চোরাচালানের ব্যাপকতা বেড়েই চলেছে।

গোয়েন্দা সংস্থার একটি সূত্র বলেছে, চলতি মাসে স্মরণকালের সর্বোচ্চ পরিমাণ স্বর্ণ ও বৈদেশিক মুদ্রা পাচারের ঘটনা ঘটেছে। এ ক্ষেত্রে গোটা বিমানবন্দরই ছিল চোরাকারবারি চক্রের নিয়ন্ত্রণে। গত ৮ জুলাই কুয়েত থেকে নিয়ে আসা ২৫ কেজি স্বর্ণের একটি বড় চালান আটক হলেও এ ঘটনার সঙ্গে জড়িত কাউকে শনাক্ত করতে পারেননি কাস্টমস ও গোয়েন্দা কর্মকর্তারা। ঘটনাটি ধামাচাপা দেওয়ার প্রক্রিয়া যখন চলছিল, ঠিক তখনই ধরা পড়ল ১২৪ কেজি স্বর্ণ। এর আগে গত সেপ্টেম্বরে ১৩ কেজি স্বর্ণ উদ্ধারের ঘটনায় একটি গোয়েন্দা সংস্থার সদস্যদের জড়িত থাকার বিষয়টি নিশ্চিত হয়েছিলেন তদন্তকারীরা। ওই ঘটনার পর থেকে একজন কর্মকর্তা এখনো পলাতক রয়েছেন। এদিকে ১২৪ কেজি স্বর্ণ পাচারের ঘটনার সঙ্গে বিমানের কিছু কর্মকর্তা-কর্মচারী জড়িত থাকতে পারেন বলে গোয়েন্দাদের ধারণা। বিমানবন্দর সূত্র জানায়, বাংলাদেশ বিমান, পুলিশ ও কাস্টমস গোয়েন্দা বিভাগের যৌথ তদন্তে শাহজালাল বিমানবন্দর দিয়ে চোরাই সোনা খালাসের সম্ভাব্য রুট এবং এর সঙ্গে জড়িত সন্দেহভাজন কর্মকর্তাদের সম্পর্কে খোঁজখবর নেওয়া হচ্ছে। এ জন্য বিশেষভাবে আমলে নেওয়া হচ্ছে এর আগের গোয়েন্দা রিপোর্ট। সেসব রিপোর্টের তথ্যের সঙ্গে বিভিন্ন সময় উদ্ঘাটিত চোরাচালানের বিভিন্ন ঘটনার ক্লোজ সার্কিট (সিসি) ক্যামেরায় ধারণ করা ভিডিও ফুটেজ মিলিয়ে দেখা হচ্ছে। বিমানের নিরাপত্তা বিভাগের মহাব্যবস্থাপক মমিনুল হক জানান, আমাদের পুলিশ ছাড়াও দুবাই পুলিশও এ ঘটনার তদন্ত করছে। পুলিশের একজন কর্মকর্তা জানান, ২৫ কেজি স্বর্ণের চালানের সঙ্গে বাংলাদেশ বিমানের একজন পাইলট, দুজন ক্যাবিন ক্রু ও বিমানবন্দরের কয়েকজন কর্মকর্তা জড়িত রয়েছেন বলে তাদের কাছে খবর আছে। কিন্তু ওই ঘটনায় থানায় কোনো মামলা না হওয়ায় এ রহস্য আড়ালেই রয়ে যাচ্ছে।

এরই মধ্যে সরকারের বেশ কয়েকটি গোয়েন্দা সংস্থা দীর্ঘ তদন্তের পর চোরাকারবারি ৪০টি চক্রের সন্ধান পায়। এদের সঙ্গে নিয়মিত যোগাযোগ রাখছেন এমন ৪৪ জন কর্মকর্তা-কর্মচারীর নামের তালিকাও করা হয়। কিন্তু গোয়েন্দা সংস্থাগুলোর এ তালিকায় যাদের নাম রয়েছে, এরা মূলত মাঠপর্যায়ে কাজ করছেন। সূত্র মতে, এরা সবসময় ধরা পড়েন। কিন্তু আড়ালেই রয়ে যান মূল হোতারা। মূল হোতারা অধিকাংশ সময় নেপথ্যে থেকে চোরাচালান করছেন। সূত্র জানায়, তালিকাভুক্ত এসব ব্যক্তি দুবাই ও করাচির ফ্লাইটগুলো থেকে আসা স্বর্ণ, হেরোইন ও মাদকের বড় বড় চালান বাইরে পাচার করছে। যেদিন চোরাচালান হবে সেদিন তালিকাভুক্ত এসব ব্যক্তি বিভিন্ন বেশে নিরাপত্তা পাস গলায় ঝুলিয়ে শাহজালাল বিমানবন্দরের আগমনী হল এলাকার ডিউটি ফ্রি দোকানের আশপাশে কিংবা ধূমপান কক্ষের ভেতর অপেক্ষা করেন। চোরাকারবারিরা তাদের পণ্য নিয়ে ইমিগ্রেশন কাউন্টারে আসে। বোর্ডিং ব্রিজ থেকে নেমে বর্ণিত এলাকায় পোঁছে ইশারা-ইঙ্গিতে যোগাযোগ স্থাপন করে। এরপর সুবিধামতো নিকটবর্তী কোনো টয়লেটে প্রবেশ করে চোরাচালান পণ্যের হাতবদল করে। সংশ্লিষ্ট সূত্রে আরো জানা গেছে, বিমানবন্দরে প্রবেশে এসব নিরাপত্তা পাসের জন্য মোটা অঙ্কের টাকা পরিশোধ করতে হয় সংশ্লিষ্ট শাখায়। সূত্র আরও জানায়, শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে কর্মরত বিভিন্ন সংস্থার অনেকেই টাকার লোভে পাচারকারী চক্রের হয়ে কাজ করছে। এ জন্যই বিমানবন্দরের অনেকেই নির্দিষ্টভাবে কোনো স্থানে দায়িত্ব পালন করতে চায় না। যদি ডিউটি থাকে রানওয়েতে, কিন্তু সেখানে না গিয়ে চলে আসেন ইমিগ্রেশন বা গ্রিন চ্যানেলে। বিমানবন্দর সূত্র জানায়, গত তিন বছরে শাহজালাল বিমানবন্দরে উদ্ধার হয়েছে প্রায় ৯০ কোটি টাকা মূল্যের স্বর্ণ। পাকিস্তানি, ভারতীয় নাগরিকসহ ১৭ জনকে এ সময়ের মধ্যে গ্রেফতার করা হয়েছে বৈদেশিক মুদ্রার বড় বড় চালানসহ। এ ছাড়া ওষুধ, কাপড়, কসমেটিক্স, ইলেট্রনিক্স সামগ্রী আসছে; যার অধিকাংশই শুল্ক ফাঁকি দিয়ে অবৈধভাবে আমদানি করা হচ্ছে। ২০১০ সালের জুন থেকে ২০১৩ সালের ১০ জুলাই পর্যন্ত বৈদেশিক মুদ্রা উদ্ধার করা হয়েছে ৮৯ কোটি ৭৫ লাখ ৩ হাজার ১২৫ টাকার। এসব ঘটনায় মামলা হয়েছে ২৬টি। কিন্তু সব মামলায় গ্রেফতার আসামিরা এখন জামিনে রয়েছেন।

 

 

সর্বশেষ খবর