সোমবার, ২৯ জুলাই, ২০১৩ ০০:০০ টা

এবার মোদির শরণাপন্ন ঢাকা

স্থলসীমান্ত চুক্তি বাস্তবায়নে ভারতের সংবিধানের সংশোধনী বিল পাস ও তিস্তা নদীর পানি বণ্টন চুক্তি করতে পররাষ্ট্রমন্ত্রী ডা. দীপু মনির নিষ্ফল নয়াদিলি্ল সফরের পরপরই গুজরাটের মুখ্যমন্ত্রী ও 'বিতর্কিত' রাজনীতিক নরেন্দ্র মোদির সঙ্গে সাক্ষাৎ করেছেন দেশটিতে বাংলাদেশের হাইকমিশনার তারিক এ করিম। হাইকমিশনার এ বৈঠককে 'জাহাজভাঙা শিল্পের বিষয়ে আলোচনার জন্য করা' বললেও ভারতীয় রাজনীতিতে শোরগোল ফেলেছে এ বৈঠক। প্রধানমন্ত্রী পদে বিজেপির সম্ভাব্য প্রার্থী হিসেবে দেখা হচ্ছে মুসলিমবিদ্বেষী হিসেবে পরিচিত নরেন্দ্র সিং মোদিকে। 'কংগ্রেসমুক্ত ভারত নির্মাণ'-এর স্লোগান নিয়ে এগিয়ে চলা মোদির সঙ্গে তারিক এ করিমের সাক্ষাৎকে সীমান্ত বিলে বিজেপির সমর্থন আদায়ে বাংলাদেশের চেষ্টা হিসেবেই বর্ণনা করেছে ভারতীয় গণমাধ্যম।

কূটনৈতিক সূত্র জানায়, পররাষ্ট্রমন্ত্রী ডা. দীপু মনির নয়াদিলি্ল সফরের মাধ্যমেই সীমান্ত বিল পাস করতে ভারতের অভ্যন্তরীণ রাজনৈতিক পক্ষগুলোর সঙ্গে প্রথমবারের মতো সরাসরি যোগাযোগ শুরু করেন ঢাকার কূটনীতির দায়িত্বে থাকা ব্যক্তিরা। সফর শেষে দীপু মনি যখন ঢাকার উদ্দেশে রওনা দেন, প্রায় একই সময়ে গুজরাটের পথে যাত্রা শুরু করেন প্রতিমন্ত্রী পদমর্যাদার হাইকমিশনার তারিক এ করিম। গুজরাটের রাজধানী গান্ধীনগরে নরেন্দ্র মোদির বাসভবনে তার সঙ্গে বৈঠকের বিষয়ে সময় প্রার্থনা করা হয়েছিল হাইকমিশনারের পক্ষ থেকেই। মোদির ওয়েবসাইটে সাক্ষাতের তিনটি ছবি প্রকাশ করে বলা হয়েছে, সমান্তরাল সাংস্কৃতিক, অর্থনৈতিক ও সামাজিক প্রেক্ষাপটের নিরিখে বাংলাদেশ ও গুজরাটের মধ্যে সহযোগিতা প্রসার ও শক্তিশালী করার ব্যাপারে ফলপ্রসূ আলোচনা হয়েছে। বৈঠকে উপস্থিত ছিলেন গুজরাটের মুখ্যমন্ত্রীর প্রধান সচিব কে কৈলাসনাথন। গুজরাটের রাজ্য সরকারের পক্ষ থেকে বলা হয়েছে, বৈঠকে বাংলাদেশের অর্থনীতির নানা দিক নিয়ে আলোচনা হয়েছে। আলোচনায় উঠে এসেছিল টেঙ্টাইল, জাহাজ নির্মাণ ও জাহাজভাঙা শিল্পের মতো বিষয়ও। করিম জানিয়েছেন, কটন-টেঙ্টাইল, জাহাজ নির্মাণ ও জাহাজভাঙা শিল্পে বাংলাদেশের যথেষ্ট সম্ভাবনা রয়েছে। গুজরাটও কটন-টেঙ্টাইল ও জাহাজ নির্মাণ শিল্পের ক্ষেত্রে অগ্রগণ্য। তাই দুই অঞ্চলের পারস্পরিক স্বার্থে হাত মেলানোর সুযোগ রয়েছে। জানতে চাইলে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সংশ্লিষ্ট এই কর্মকর্তা বলেন, একটি রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রীর সঙ্গে প্রতিবেশী দেশের হাইকমিশনারের সাক্ষাৎ একটি স্বাভাবিক প্রক্রিয়া। এ নিয়ে আলোচনার তেমন কিছু নেই। অপর একটি কূটনৈতিক সূত্র জানায়, ভারত ও বাংলাদেশের মধ্যে ১৯৭৪ সালে স্বাক্ষরিত স্থলসীমান্ত চুক্তি এবং ২০১১ সালে স্বাক্ষরিত হওয়া এ-সংক্রান্ত প্রটোকল বাস্তবায়ন করতে হলে ভারতের সংবিধান সংশোধন করতে হবে। এ জন্য আগামী ৫ আগস্ট শুরু হতে যাওয়া রাজ্যসভার বর্ষাকালীন অধিবেশনে বিল তুলবে ক্ষমতাসীন কংগ্রেস। বিল পাস করতে হলে দুই-তৃতীয়াংশ সদস্যের সমর্থন দরকার। কিন্তু প্রধান বিরোধী দল বিজেপি বিলের বিরোধিতা করছে। তবে বিজেপির মধ্যেও এ নিয়ে রয়েছে দুটি পক্ষ। এক পক্ষে উদারপন্থি অরুণ জেটলি ও সুষমা স্বরাজের মতো নেতারা 'বৃহত্তর জাতীয় স্বার্থে' স্থলসীমান্ত চুক্তিতে সমর্থন দেওয়ার পক্ষে থাকলেও নরেন্দ্র মোদি নেতৃত্বাধীন কট্টরপন্থিরা করে আসছেন এর বিরোধিতা। একই প্রসঙ্গে কলকাতাভিত্তিক ইংরেজি দৈনিক দ্য টেলিগ্রাফ এক প্রতিবেদনে লিখেছে, বিজেপিকে যদি কেউ রাজি করাতে পারে, সেটি মোদি। এ কারণেই বৈঠক। দ্য টেলিগ্রাফে বলা হয়েছে, বিজেপির সম্ভাব্য প্রধানমন্ত্রী পদপ্রার্থী নরেন্দ্র মোদির সঙ্গে বাংলাদেশের দূত দেখা করে তাকে যুক্তি দেখানোর সুযোগ করে দিয়েছেন যে, মুসলিমপ্রধান প্রতিবেশীর কাছেও বিশ্বের অন্যান্য প্রান্তের মতো মোদির গ্রহণযোগ্যতা বেড়েই চলেছে। টেলিগ্রাফ মন্তব্য করেছে, এ বৈঠক বাংলাদেশ বা আওয়ামী লীগকে কতটা সাহায্য করবে তা বলা না গেলেও অনুমান করা যায়, আগামী দিনে ভারতের নির্বাচনী প্রচারে এ সাক্ষাৎকারের বিষয়টি তুলে ধরা বলা হবে যে, শুধু ভারতের মুসলমানদের কাছেই নয়, বাইরের মুসলমানদের কাছেও সমানভাবে গ্রহণযোগ্য হয়ে উঠেছেন নরেন্দ্র মোদি।

দীপু মনি এখনো আশাবাদী

এদিকে বিজেপির সিনিয়র নেতা তথা ভারতের রাজ্যসভার বিরোধী দলনেতা অরুণ জেটলি তার দলের নেতাদের সঙ্গে আলোচনা করে স্থলসীমান্ত চুক্তিটি সংসদে পাস করানোর ব্যাপারে উদ্যোগী হবেন বলে ফের আশাবাদ প্রকাশ করলেন বাংলাদেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রী দীপু মনি।

গতকাল একটি সর্বভারতীয় ইংরেজি গণমাধ্যম (সিএনএন-আইবিএন)-এ সাক্ষাৎকারে দীপু মনি বলেন, এটা ঠিক, গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র কাঠামোয় কিছু স্থানীয় রাজনৈতিক বাধ্যবাধ্যকতা থাকে, কিন্তু কখনো কখনো বৃহত্তর স্বার্থের কথা চিন্তা করে উদার মানসিকতার পরিচয় দিতে হয়। শুক্রবার দিলি্লতে অরুণ জেটলির সঙ্গে দীর্ঘ বৈঠক করেন তিনি। তার আবেদনে ইতিবাচক সাড়া না দিলেও জেটলি জানিয়ে দেন দলের নেতাদের সঙ্গে আলোচনা করে সিদ্ধান্ত নেবেন। স্বাগতিক দেশটির প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিংও ঢাকাকে আশ্বস্ত করে বলেন, দুই দেশের ভূমি সীমান্ত চিহ্নিত করতে সংশোধনী বিলটিও আসন্ন বর্ষাকালীন অধিবেশেনে পাস করানোর প্রয়াস নেওয়া হবে। জেটলির সঙ্গে বৈঠকের ব্যাপারে প্রশ্ন করা হলে দীপু মনি জানান, জেটলির সঙ্গে বন্ধুত্বপূর্ণ আলোচনা হয়েছে। তার (জেটলি) কাছ থেকে যে প্রত্যুত্তর পেয়েছি তাতে আমি আশাবাদী যে, স্থলচুক্তির ব্যাপারে জেটলি তার দলের সঙ্গে আলোচনা করবেন। স্থলসীমান্ত কিংবা তিস্তা পানি বণ্টন চুক্তি দুটি ফলপ্রসূ না হলে বাংলাদেশের আসন্ন সংসদ নির্বাচনে তার প্রভাব পড়বে কিনা এ প্রশ্নের উত্তরে দীপু মনি জানান, চুক্তিগুলো সম্পন্ন না হলে তা অবশ্যই হতাশাজনক হবে, তার প্রভাবও দেশে পড়তে পারে এবং নিশ্চিতভাবেই এই বিষয়ে ঐকমত্যে পেঁৗছানো দরকার। তবে আমি বিশ্বাস করি, বাংলাদেশের মানুষ এটাও দেখেছে আগের সরকারের আমলে এই ইস্যুগুলো সমাধানে কোনো উদ্যোগই নেয়নি।

প্রসঙ্গত, ১৯৭৪ সালের ১৬ মে দিলি্লতে স্বাধীন বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যে এই দ্বিপক্ষীয় আন্তর্জাতি চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়েছিল। বাংলাদেশের পক্ষে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান এবং ভারতের পক্ষে প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী ওই চুক্তিতে স্বাক্ষর করেন। এরপর ২০১১ সালে ভারত-বাংলাদেশের মধ্যে স্থলসীমান্ত চুক্তির বিষয়ে একটি প্রটোকল স্বাক্ষরিত হয়। তারপর এ চুক্তি অনুমোদনের জন্য চলতি বছরের মে মাসেই সংবিধান সংশোধনের জন্য বিলটি পেশ করা হয় ভারতের সংসদে। কিন্তু বাদ সাধে বিজেপি।

সর্বশেষ খবর