শিরোনাম
শনিবার, ১৯ অক্টোবর, ২০১৩ ০০:০০ টা

লালনে মুখরিত ছেঁউড়িয়া

লালনে মুখরিত ছেঁউড়িয়া

সবার গন্তব্য যেন লালনধাম, কুষ্টিয়ার ছেঁউড়িয়ার আখড়াবাড়ি। যেখানে মিলন ঘটেছে নানা ধর্ম, নানা বর্ণের মানুষের। জাতপাতের ঊর্ধ্বে উঠে তাদের কণ্ঠে প্রতিধ্বনিত হচ্ছে সাঁইজির অমর বাণী- 'মানুষ ছাড়া ক্ষ্যাপারে তুই মূল হারাবি, মানুষ ভজলে সোনার মানুষ হবি'। কুষ্টিয়া শহর থেকে মাত্র ১০ মিনিটের রাস্তা ছেঁউড়িয়া। এখন সে রাস্তায় যেতে লাগছে এক ঘণ্টার উপরে। সাঁইজির টানে এ ধামে বাউল ছাড়াও সাধারণ দর্শনার্থীদের ভিড় লেগেছে। গত বুধবার আখড়াবাড়িতে শুরু হয়েছে বাউল সম্রাট ফকির লালন শাহের ১২৩তম মৃত্যুবার্ষিকীর পাঁচ দিনের উৎসব ও মেলা। তবে ঈদের কারণে আনুষ্ঠানিকভাবে এ উৎসবরে উদ্বোধন করা হয় বৃহস্পতিবার। ওইদিন সন্ধ্যায় এ আয়োজনের উদ্বোধন করেন তথ্যমন্ত্রী হাসানুল হক ইনু।

শুক্রবার উৎসবের দ্বিতীয় দিন বাউলের চারণভূমিতে আসা হাজার হাজার লালন-ভক্ত, সাধু-গুরু কর্তৃপক্ষের দেওয়া সকালের নাশতা, পায়েস ও মুড়ির বাল্যসেবা গ্রহণ করেন। দুপুরে তারা মরা কালী গঙ্গায় গোসল সেরে ইলিশ মাছ-ভাতও ত্রিব্যঞ্জন দিয়ে (তিন ধরনের সবজি দিয়ে তৈরি তরকারি) দুপুরের খাবার পুণ্যসেবা গ্রহণ করেন।

কোন সে উদাসী ডাক? কোনো দাওয়াত নেই, পত্র নেই, তবুও মানুষ ছুটে আসে দলে দলে, হাজারে হাজারে। স্মরণোৎসবে প্রতিবছরের মতো এবারও সাধক লালনের আধ্যাত্দিক দর্শন লাভের আশায় দূরদূরান্ত থেকে মানুষ প্রাণের টানে ছুটে আসেন। একতারা, দোতারা, ঢোল ও বাঁশির সুরে মুখরিত হয়ে উঠেছে লালনভূমি ছেঁউড়িয়া। দূরদূরান্ত থেকে আসা বাউলরা দরদভরা কণ্ঠে গাইছেন 'বাড়ির পাশে আরশিনগর, সত্য বল সুপথে চল, এলাহি আলামিন গো আলা বাদশা আলমপনা তুমি'- এ রকম অসংখ্য গান। লালন মাজারের আশপাশে ও মরা কালী নদীর তীর ধরে বাউলরা ছোট ছোট আস্তানা গেড়ে সাঁইজিকে স্মরণ করেছেন তার গাওয়া গান গেয়ে।

দূরদূরান্ত থেকে বাউল সাধকরা এসেছেন দলে দলে একতারা-দোতারা, ঢোল-খোল, বাঁশি, প্রেমজুড়ি, চাকতি, খমক হাতে। ক্ষণে ক্ষণেই খণ্ড খণ্ড মজমা থেকে নৃত্যসংগীতের তালে তালে ছলকে উঠছে যেন উত্তাল ভাববাদী ঢেউ। কেউ শুধু লুঙ্গি পরে নাচছেন, গাইছেন। কারও উদোম গা। গলায় বিচিত্র বর্ণ ও আকারের পাথরের মালা। হাতে বিশেষ ধরনের লাঠি ও বাদ্যযন্ত্র। লালন ধামের ভেতর ও বাইরে নিজেদের পছন্দমতো জায়গা করে নিয়ে গান-বাজনা করছেন তারা। বিচিত্র সব বাদ্যযন্ত্রে তুলছেন হৃদয় ছুঁয়ে যাওয়া লালনগীতি। আখড়ার একটি দল থামছে তো অন্যটি জমিয়ে রাখছে চারপাশ।

লালনধামের ভেতর পঞ্চাশোর্ধ্ব নারী বাউল কামিরন তার সহযোগীদের নিয়ে একতারা হাতে নেচে-গেয়ে সাঁইজির বন্দনা করছিলেন। কথার পিঠে কথা আর মনের ভেতর আধাত্দ্যবাদ নিয়ে গাইছিলেন তিনি। কামিরন বলেন, লালন নিজেও এভাবে গান করতেন। তার কাছে ধর্ম, বর্ণ, জাত-পাতের বিচার ছিল না। পুরুষের পাশাপাশি আশ্রয়হীন নারীদের তিনি বাঁচার সুযোগ করে দিতেন। তাদের সঙ্গে নিয়ে গাইতেন। নাচতেন।

উৎসবে শামিল হতে মাগুরা থেকে ছুটে এসেছেন একদল তরুণ। তারা সবাই লালনের ভক্ত। প্রতি বছর আসেন। তাদের একজন খায়রুল বাশার বলেন, 'লালনের গানে মানবতাবোধ, অহিংস ভাব ও অসাম্প্রদায়িক চেতনার কারণে দিন দিন তার গানের ভক্ত ও অনুসারীর সংখ্যা বেড়েই চলেছে। লালনের গান কবিতা আকারে পাঠ্যপুস্তকে অন্তর্ভুক্ত করা হোক।' ভক্ত-অনুসারীরা এসেই প্রথমে মূল মাজারের ভেতরে চিরনিদ্রায় শায়িত তাদের ধর্মগুরুর প্রতি শ্রদ্ধা প্রদর্শন করেছেন। তারা জাত, কুল, ধর্ম, গোত্র ভুলে একে অপরের সঙ্গে ভাবের আদান-প্রদান করেছেন।

প্রতিদিন সন্ধ্যায় মেলার মাঠের স্থায়ী মঞ্চে বসে আলোচনা সভা। এর পরপরই শুরু হয় লালন একাডেমির শিল্পীদের গান। বাংলা ১২৯৭ সালের পহেলা কার্তিক লালন শাহ দেহত্যাগ করার পর থেকে তার মাজার চত্বরে মহাধুমধামের সঙ্গে এই স্মরণ উৎসব পালিত হয়ে আসছে।

 

 

সর্বশেষ খবর