এবার কোরবানি ঈদকেন্দ্রিক চামড়ার বাজার চাঙ্গা ছিল, বিক্রেতারাও ছিলেন খুশি। প্রতি বছরের মতো চামড়া কেনাবেচা নিয়ে বেপারিদের মধ্যেও কোনো উদ্বেগ-উৎকণ্ঠা ছিল না। হাপিত্যেশ ছিল না খুচরা বিক্রেতাদের মধ্যেও। প্রশাসনিক তৎপরতার কারণে চামড়া জোরজবরদস্তি কেড়ে নেওয়ার দৌরাত্দ্যও দেখা যায়নি কোথাও। ফলে ঈদ ও ঈদ-পরবর্তী দিনগুলোয় চামড়া বাজার জুড়ে ছিল স্বস্তি। তবে আড়ত আর ট্যানারি মালিক পর্যায়ে চামড়ার দাম নিয়ে ব্যাপক দরকষাকষি হলেও সাধারণ ক্রেতা-বিক্রেতাদের মধ্যে এর কোনো প্রভাব লক্ষ্য করা যায়নি। অনেক ক্ষেত্রে সাধারণ হাটবাজারে চলমান দাম থেকেও চড়া ছিল ঈদের চামড়া বাজার। এসব কারণে মৌসুমি ব্যবসায়ী ও ভিনদেশি মাড়োয়ারীরাও এবার সুবিধা করতে পারেননি। মোটা অঙ্কের পুঁজি নিয়ে রাজধানীতে ছোটাছুটি করে, নানা রকম কৌশল খাটিয়েও তারা চামড়ার বাজার নিয়ন্ত্রণে নিতে পারেননি।
খুচরা চামড়া বিক্রেতারা জানিয়েছেন, সরকারি উদ্যোগে দাম নির্ধারণ করে দেওয়ায় রাজধানীসহ সারা দেশেই এবার চাঙ্গা হয়ে উঠেছে চামড়ার বাজার। খুচরা বিক্রেতারা ভালো দাম পাওয়ায় যেমন খুশি হয়েছেন, তেমনি বেপারিরা আড়তে নিয়েও তা চাহিদামাফিক দামেই বিক্রি করতে পেরেছেন। ঈদকেন্দ্রিক প্রায় ৩ হাজার কোটি টাকা মূল্যের চামড়া বাজারের স্বস্তিদায়ক পরিবেশ এবার ঈদ আনন্দকে কয়েক গুণ বাড়িয়ে দিয়েছে বলেও মনে করছেন অনেকে।
বিভিন্ন পর্যায়ের চামড়া ব্যবসায়ীদের সঙ্গে আলাপ করে জানা যায়, কোরবানির পশুর চামড়ার দাম নির্ধারিত না থাকায় গত কয়েক বছর চামড়া বিক্রি নিয়ে সৃষ্টি হয় নানা জটিলতা। মাঠপর্যায়ের বিক্রেতারা তাই ভালো দামও পেতেন না। চামড়া সংগ্রহের জন্য জোরজবরদস্তি আর সিন্ডিকেট ব্যবসায়ীদের কাছেই জিম্মি থাকতে হতো লাখ লাখ বিক্রেতাকে। গত পাঁচ-সাত বছরের মধ্যে এবারই চামড়ার দাম সরকারিভাবে নির্ধারণ করে দেওয়ায় সিন্ডিকেট আর মৌসুমি ব্যবসায়ীরা হালে পানি পাননি। সুবিধা করে উঠতে পারেনি ট্যানারি মালিকদের মিনি সিন্ডিকেটগুলোও।
গুলশান, বনানী, বাড্ডা, ভাটারা, তেজগাঁও ঘুরে ফিরে চামড়া বেচাকেনা দেখে বাজার বিশ্লেষক এ জেড এইচ পাটোয়ারী জানান, ১৫-২০ বছরের মধ্যে এই প্রথম স্বস্তিদায়ক চামড়ার বাজার দেখতে পাওয়া গেল। তিনি বলেন, মহল্লা পর্যায়ে চামড়া সংগ্রহকারী মাস্তানদের কোনো দৌরাত্দ্য ছিল না, কোনো সিন্ডিকেট এজেন্টের আনাগোনাও দেখা যায়নি। বরং খুচরা বিক্রেতারা সরাসরি বেপারি ও ফড়িয়াদের হাতে চামড়া তুলে দিতে পেরেছেন। নিজেরাই দরদাম করে আবদারের মাধ্যমে কাঙ্ক্ষিত মূল্য আদায় করে নিয়েছেন। গুলশান-২ এলাকার বাসিন্দা নুরুন্নবী খোন্দকার, মেসবাহ চৌধুরী, মাওলানা রেয়াজুল সিদ্দিকীসহ কয়েকজন বলেন, চামড়ার ভালো দাম পাওয়ায় সবচেয়ে বেশি উপকৃত হচ্ছে মসজিদ, মক্তব, এতিমখানাগুলো। বহু মানুষ তাদের কোরবানির পশুর চামড়াগুলো এসব প্রতিষ্ঠানে দান করে থাকেন। অন্যান্য বছর মহল্লা পর্যায়ের মাস্তান-সন্ত্রাসীদের অপতৎপরতায় এতিমখানার অবোধ শিশুরাও তাদের নামে দানকৃত চামড়াটা সংগ্রহ করতে পারত না। আবার অনুনয়-বিনয় করে চামড়া সংগ্রহ করলেও তা বিক্রি করতে হতো পানির দরে।
ঈদের দিন রাত ১০টার মধ্যেই মহল্লা পর্যায়ের চামড়াগুলো জড়ো হতে থাকে এলিফ্যান্ট রোড, পোস্তগোলা, হাজারীবাগ মনেশ্বর রোড, কামরাঙ্গীরচরের বুড়িগঙ্গা তীরের আড়তগুলোয়। সময় যত গড়াচ্ছে ততই চামড়ার বিশাল বিশাল স্তূপ গড়ে উঠছে সেসব স্থানে। চলছে চামড়ার প্রাথমিক প্রক্রিয়াকরণের কাজ। লবণ মাখিয়ে রোদে শুকিয়ে সাজিয়ে রাখা হচ্ছে। আড়ত মালিক আনোয়ার হোসেন ও আবদুল জলিল বেপারী বলেন, 'ন্যায্য দরেই চামড়া কিনেছি। বিক্রি করেও ভালো ব্যবসা হয়েছে। এবার আড়ত মালিকরাও চামড়ার দাম নিয়ে দরকষাকষি কিংবা টাকা বাকি রাখার চেষ্টা করেননি।'
রাজধানীতেও তিনটি ক্যাটাগরিতে চামড়া কেনাবেচা হতে দেখা গেছে। ঈদের দিন বিকাল পর্যন্ত চামড়ার দাম তুলনামূলক কম থাকলেও সন্ধ্যার পর থেকেই দাম ধাপে ধাপে বাড়তে থাকে। গরুর ভালোমানের প্রতিটি চামড়া আড়াই হাজার থেকে সর্বোচ্চ চার হাজার টাকায় বিক্রি হতে দেখা গেছে। এ ছাড়া মাঝারি মানের চামড়া বিক্রি হয়েছে দুই হাজার থেকে তিন হাজার টাকায়। এর পরের ক্যাটাগরির চামড়া বিক্রি হয়েছে এক হাজার ৮০০ টাকা থেকে দুই হাজার ৩০০ টাকায়।
ব্যবসায়ীরা জানান, গত আট বছরের মধ্যে এবারই চামড়ার দাম সবচেয়ে বেশি। এবার ছাগলের চামড়া ১৫০ থেকে ২৫০ টাকায় বিক্রি হয়েছে। গত কোরবানির ঈদে যা বিক্রি হয়েছিল মাত্র ৭০-৮০ টাকা দরে। কারণ, চামড়াসংশ্লিষ্ট তিন সংগঠন এবার আগে থেকেই চামড়ার দাম নির্ধারণ করে দিয়েছে। নির্ধারিত দর অনুযায়ী, লবণযুক্ত প্রতি বর্গফুট গরুর চামড়া রাজধানীতে সর্বনিম্ন ৮৫ থেকে ৯০ টাকা দরে আর ঢাকার বাইরে ৭৫ থেকে ৮০ টাকায় কেনার ঘোষণা দেওয়া হয়। খাসির চামড়ার দর নির্ধারণ হয় প্রতি বর্গফুট ৫০ থেকে ৫৫ এবং বকরির চামড়া ৪০-৪৫ টাকা হিসেবে।
ট্যানারি আর আড়ত পর্যায়ে দরকষাকষি : খুচরা বিক্রেতা ও বেপারি পর্যায়ে চামড়ার বেচাকেনা স্বস্তিদায়ক হলেও চামড়ার দাম নিয়ে ট্যানারি মালিক আর আড়তদারদের মধ্যে চলছে দরকষাকষি। আড়ত মালিকদের কাঙ্ক্ষিত চাহিদা পূরণ করে চামড়া নিতে চাইছেন না ট্যানারি মালিকরা। ট্যানারি মালিক ও আড়তদারদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, এবারের পশু কোরবানির সংখ্যা গত বছরের থেকে বেশি। সব মিলিয়ে এবার সারা দেশে ৬০ লক্ষাধিক পশু কোরবানি হয়েছে বলে ধারণা করা হচ্ছে। এর মধ্যে আশি ভাগই গরু। বেপারিদের কাছ থেকে এসব চামড়া এবার আড়তদাররা চড়া দামেই কিনেছেন। কিন্তু ট্যানারি মালিকরা সিন্ডিকেট করে চামড়ার দাম কমানোর চেষ্টা করছেন বলে আড়তদাররা অভিযোগ করেছেন। ফড়িয়া ব্যবসায়ী সমিতি হাইড অ্যান্ড স্কিন রিটেইল ডিলার মার্চেন্ট অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি আসলাম মিয়া বলেন, ট্যানারি মালিক সমিতির নেতারা সিন্ডিকেট করে চামড়া কম দামে কেনার পাঁয়তারা করছেন। অন্যদিকে, বাংলাদেশ ট্যানার্স অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি শাহীন আহমেদ বলেন, বিশ্বমন্দার কারণে আন্তর্জাতিক বাজারে চামড়ার দাম কমে গেছে। ঈদের আগে আন্তর্জাতিক বাজার দেখে চামড়ার দাম নির্ধারণ করা হয়েছিল। আড়ত মালিকরা হুজুগে বেশি দামে চামড়া কিনেছেন। তিনি বলেন, কেবল রাজধানীর চামড়া দিয়ে তো আর ব্যবসা চলে না। ঢাকার বাইরে নির্ধারিত দামের চেয়ে কম দামেই চামড়া সংগ্রহ করা হয়েছে। রাজধানীর বাইরের চামড়ার সঙ্গে দামের সমন্বয় করলে আড়তদারদের লোকসান হবে না বলেও তিনি মন্তব্য করেন। চামড়া ব্যবসায়ীদের সংশ্লিষ্ট একটি সূত্র জানায়, ট্যানারি মালিকরা চামড়া কেনার ব্যপারে টালবাহানা ও গড়িমসি করলে এর পরিণতি খারাপ হতে বাধ্য। কারণ আড়তদাররা তো আর নিজেদের পুঁজি গচ্চা দেবেন না। এ ক্ষেত্রেই চামড়া পাচারের আশঙ্কা সৃষ্টি হবে। সূত্রটির মতে, ঈদের আগে ভিনদেশি মাড়োয়ারী ব্যবসায়ীরা এ দেশে এলেও তারা এখন পর্যন্ত অবস্থান করছেন। সঙ্গত কারণেই তাদের হাত ঘুরে চামড়া পাচারের আশঙ্কা উড়িয়ে দেওয়া যায় না।
চট্টগ্রামে মৌসুমি ব্যবসায়ীদের দাপটে দিশাহারা আড়তদাররা : চট্টগ্রামে এবার কোরবানির ঈদে রেকর্ড পরিমাণ পশুর চামড়া সংগ্রহ করেছেন কাঁচা চামড়ার আড়তদাররা। তবে মৌসুমি ব্যবসায়ীরা প্রতিযোগিতামূলকভাবে নির্ধারিতের চেয়ে বেশি দামে চামড়া কেনায় অস্থিতিশীল ছিল কাঁচা চামড়ার বাজার। তাই এক প্রকার বাধ্য হয়ে বেশি দামে চামড়া কিনতে হয়েছে আড়তদারদের। বেশি দামে চামড়া কেনায় লোকসানের শঙ্কার মুখে পড়েছেন চট্টগ্রামের আড়তদাররা। চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশন কাঁচা চামড়া আড়তদার সমবায় সমিতির সভাপতি মোসলেম উদ্দিন বলেন, 'মৌসুমি ব্যবসায়ীদের কারণে নির্ধারিত দামে চামড়া কেনা যায়নি। তাদের দাপটে বেশি দামে চামড়া কিনতে বাধ্য হন আড়তদাররা। অতিরিক্ত দামে চামড়া কেনায় লোকসানের মুখে পড়ার সম্ভাবনা রয়েছে আড়তদারদের।' সাধারণ সম্পাদক খোরশেদ আলম বলেন, 'এবার গরু-মহিষ ও ছাগল মিলিয়ে সাড়ে পাঁচ লাখেরও বেশি পশুর চামড়া সংগ্রহ করা হয়েছে; যা কয়েক বছরের মধ্যে রেকর্ড।'
চামড়া নিয়ে বিপাকে রংপুরের আড়তদাররা : বেশি দামে চামড়া কিনে বিপাকে পড়েছেন রংপুরের আড়তদাররা। এ জন্য তারা মৌসুমি ব্যবসায়ীদের দায়ী করছেন। তারা বলছেন, মৌসুমি ব্যবসায়ীরা ট্যানারি মালিকদের বেঁধে দেওয়া দামের চেয়ে বেশি দামে চামড়া কিনেছেন। ফলে আড়তদাররাও তাদের কাছ থেকে বেশি দামে চামড়া কিনতে বাধ্য হয়েছেন। আড়তদাররা বলছেন, ট্যানারি মালিকরা দাম না বাড়ালে মোটা অঙ্কের লোকসান গুনতে হবে। এ বছর চামড়াসংশ্লিষ্ট তিনটি সংগঠন আগে থেকেই চামড়ার দাম নির্ধারণ করে দিয়েছে। সে অনুযায়ী ঢাকার বাইরে লবণযুক্ত গরুর প্রতি বর্গফুট চামড়া ৭৫-৮০, ছাগলের প্রতি বর্গফুট ৫০-৫৫ এবং মহিষের প্রতি বর্গফুট ৪০-৪৫ টাকা। সংগঠন তিনটি হলো ট্যানারি মালিকদের সংগঠন বাংলাদেশ প্রস্তুত চামড়া, চামড়াপণ্য ও জুতা রপ্তানিকারক সমিতি (বিএফএলএলএফইএ) এবং বাংলাদেশ ট্যানার্স অ্যাসোসিয়েশন (বিটিএ) ও কাঁচা চামড়ার আড়তদারদের সংগঠন বাংলাদেশ হাইড অ্যান্ড স্কিন মার্চেন্ট অ্যাসোসিয়েশন।
রংপুর চামড়া ব্যবসায়ী মালিক সমিতি সূত্রে জানা গেছে, জেলায় চামড়া ব্যবসায়ী রয়েছেন ১৫০ জন। এর মধ্যে মহাজনই ৫১ জন। এবার কোরবানি ঈদে তারা ৫০ কোটিরও বেশি টাকার চামড়া কিনেছেন।
নগরীর শাপলা চত্বর এলাকার মৌসুমি ব্যবসায়ী আনোয়ার হোসেন জানান, ট্যানারি মালিকরা আগেই দাম বেঁধে দেওয়ায় কম দামে চামড়া মিলছিল না। ফলে গরুর চামড়া গড়ে ৭০-৮০ ও ছাগলের ৩৫-৪০ টাকায় কিনতে হয়েছে। বিভিন্ন পাড়া-মহল্লায় ঘুরে পশুর চামড়া সংগ্রহ করেছেন তারা। এর সঙ্গে পরিবহন খরচও যোগ হয়েছে। তাই দাম একটু বেশি। তিনি ১০ হাজার পিস চামড়া কিনেছেন বলে জানান।
সমিতির সভাপতি আবদুল লতিফ খান বলেন, তিনি প্রতি বর্গফুট ৯৫-১০০ টাকায় ২ হাজার পিস গরুর চামড়া কিনেছেন। মৌসুমি ব্যবসায়ীরা বেশি দামে কেনার কারণে আড়তদাররা এ বছর সরাসরি চামড়া কিনতে পারেননি। ফলে মৌসুমি ব্যবসায়ীদের কাছ থেকে বেশি দামে চামড়া কিনতে বাধ্য হন। ট্যানারি মালিকরা দাম বাড়িয়ে না দিলে গরুর চামড়ায় প্রতি বর্গফুটে ২০-২৫ টাকা লোকসান গুনতে হবে।