দেশের শান্তি, স্থিতিশীলতা ও কল্যাণ এবং মুসলিম উম্মাহর শান্তি ও সমৃদ্ধি কামনার মধ্য দিয়ে বুধবার সারা দেশে উদযাপিত হয়েছে মুসলমানদেও অন্যতম বৃহৎ ধর্মীয় উৎসব পবিত্র ঈদুল আজহা। দেশের প্রতিটি ঈদগাহে বা মসজিদে ঈদের দুই রাকাত ওয়াজিব নামাজ আদায়ের পর মোনাজাতে আল্লাহ রব্বুল আলামিনের কাছে এই দোয়া করা হয়। এরপর ঈদের শুভেচ্ছা বিনিময়, কোলাকুলি, পশু জবাই, কোরবানির গোশত বিতরণের আনুষ্ঠানিকতায় ব্যস্ত দিন কাটে ধর্মপ্রাণ মুসলমানদের। এ ছাড়া ঈদের দিন রাজধানীর বিভিন্ন ফ্লাইওভারসহ বিনোদন কেন্দ্রেও কম-বেশি ভিড় লক্ষ্য করা গেছে। প্রতিবারের মতো বুধবারও দেশের বৃহত্তম ঈদ জামাত হয় কিশোরগঞ্জের শোলাকিয়া ঈদগাহ ময়দানে। বৃষ্টির কারণে দেশের অনেক স্থানে মাঠে-ময়দানে ঈদের নামাজ আদায় করা সম্ভব হয়নি।
মুসলিম উম্মাহর কাছে ত্যাগের মহিমায় ভাস্বর হয়ে প্রতি বছর পবিত্র ঈদুল আজহা আসে হজরত ইবরাহিম (আ.)-এর আত্মত্যাগ ও শয়তানের ধোঁকা থেকে বেঁচে থাকার শিক্ষা অনুশীলন করার ব্রত নিয়ে। আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জনের জন্য তিনি নিজ পুত্র ইসমাইলকে উৎসর্গ করতে মনস্থির করেছিলেন। আল্লাহ রব্বুল আলামিন হজরত ইবরাহিম (আ.)-এর এই আত্দত্যাগের আকাঙ্ক্ষা কবুল করে নেন। তিনি বেহেশত থেকে দুম্বা পাঠিয়ে তার প্রিয় নবীর কোরবানিকে মুসলিম উম্মাহর জন্য অনুকরণীয় করে দেন।
রাজধানীতে এবার অন্যবারের চেয়ে বেশি পশু কোরবানি হয়েছে। পশুর দাম তুলনামূলক কম হওয়ায় অনেক মানুষ এবার পশু কোরবানি দিয়েছেন। রাজধানীর অলিগলি-পাড়া-মহল্লা জুড়ে ছিল পশু কোরবানির মহোৎসব। অনেকে নিজেরাই কোরবানির পশু জবেহ ও কাটাকুটি করেছেন। অনেককে ঈদের পর দিন বৃহস্পতিবার এবং গতকাল শুক্রবারও কোরবানি করতে দেখা গেছে। রাজধানীতে ঈদের প্রধান জামাত অনুষ্ঠিত হয় জাতীয় ঈদগাহ ময়দানে। রাষ্ট্রপতি মো. আবদুল হামিদ, মন্ত্রী, বিচারপতি মুসলিম দেশগুলোর কূটনীতিক, বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের নেতা, পেশাজীবীসহ বিভিন্ন শ্রেণীর লাখো মানুষ এখানে ঈদের নামাজ আদায় করেন। জাতীয় মসজিদের পেশ ইমাম হাফেজ মুফতি মুহিব্বুল্লাহ হিল বাকী নদভী এখানে ইমামতি করেন। এখানে মোনাজাতে বিশ্ব মুসলিমের শান্তি ও সমৃদ্ধি কামনাসহ দেশের রাজনৈতিক অস্থিরতা নিরসনে আল্লাহর সাহায্য চেয়ে দোয়া করা হয়। জাতীয় ঈদগাহে মহিলাদের আলাদা নামাজের ব্যবস্থা ছিল। এবারও অনেক নারী ঈদগাহে নামাজ আদায় করেন। নামাজ শেষে মুসলি্লরা কোলাকুলি ও শুভেচ্ছা বিনিময় করেন।জাতীয় মসজিদ বায়তুল মোকাররমে ঈদের পাঁচটি জামাত অনুষ্ঠিত হয়। প্রথম জামাত সকাল ৭টায় ও সর্বশেষ জামাত ১১টায় অনুষ্ঠিত হয়। জাতীয় সংসদ ভবনের দক্ষিণ প্লাজায় সকাল সাড়ে ৭টায় ঈদ জামাত অনুষ্ঠিত হয়। এ জামাতে ডেপুটি স্পিকার শওকত আলী, প্রধানমন্ত্রীর উপদেষ্টা ড. আলাউদ্দিন আহমেদ, মন্ত্রী, হুইপ, এমপি, সংসদ সচিবালয়ের কর্মকর্তা-কর্মচারীসহ সর্বস্তরে মুসলি্লরা অংশ নেন। রাজধানীবাসীর ঈদের নামাজ আদায়ের সুবিধার্থে ঢাকা সিটি করপোরেশন উত্তর ও দক্ষিণ প্রতিটি ওয়ার্ডে চারটি করে ঈদ জামাতের আয়োজন করে। ডিএসসিসি ২৩২ ও ডিএনসিসি ১৪৪টি ঈদ জামাতের আয়োজন করে। এ ছাড়া প্রতিটি পাড়ামহল্লার খোলা মাঠ ও মসজিদে ঈদের নামাজ আদায় করেন নগরবাসী।
আহলে হাদিসের বড় ঈদ জামাত অনুষ্ঠিত হয় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় খেলার মাঠে। এ ছাড়া পুরান ঢাকার বংশাল আহলে হাদিস মসজিদসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে আহলে হাদিসদের পৃথক ঈদ জামাত অনুষ্ঠিত হয়। ঈদ উপলক্ষে বুধবার সরকারি ও বেসরকারি গুরুত্বপূর্ণ ভবনগুলোয় জাতীয় পতাকা উত্তোলন করা হয়। বিভিন্ন সড়ক ও গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনা সাজানো হয়েছে ঈদ মোবারক ও কালিমা খচিত পতাকা দিয়ে। রাতে ঈদ উপলক্ষে সরকারি-বেসরকারি অনেক ভবনে আলোকসজ্জাও করা হয়। ঈদের দিন দেশের বিভিন্ন হাসপাতাল, কারাগার, সরকারি শিশুসদন, ছোটমণি নিবাস, সামাজিক প্রতিবন্ধী কেন্দ্র, আশ্রয় কেন্দ্র, ভবঘুরে কল্যাণ কেন্দ্র ও দুস্থ কল্যাণ কেন্দ্রগুলোয় উন্নত খাবার পরিবেশন করা হয়।
পবিত্র ঈদুল আজহা উপলক্ষে রাষ্ট্রপতি মো. আবদুল হামিদ সকালে বঙ্গভবনে কূটনৈতিক কোরের ডিনসহ বাংলাদেশে নিযুক্ত বিভিন্ন দেশের কূটনীতিক, বিচারপতি, মন্ত্রী, এমপি, সচিব, শিক্ষাবিদ, সাংবাদিক, সাহিত্যিক ও সমাজের বিশিষ্টজনদের সঙ্গে ঈদের শুভেচ্ছা বিনিময় করেন। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সকাল ৯টায় গণভবনের লনে মন্ত্রী, রাষ্ট্রের উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা, দলীয় নেতা-কর্মী, পেশাজীবী, সমাজের গণ্যমান্য ব্যক্তিসহ সর্বস্তরের জনগণের সঙ্গে শুভেচ্ছা বিনিময় করেন। বেলা ১১টায় তিনি কূটনীতিক ও সুপ্রিম কোর্টের বিচারকদের সঙ্গে ঈদ শুভেচ্ছা বিনিময় করেন। এ ছাড়া রাজধানীর মোহাম্মদপুরে যুদ্ধাহত মুক্তিযোদ্ধাদের বিশ্রামাগারে শেখ হাসিনার পক্ষ থেকে প্রধানমন্ত্রীর দফতরের কর্মকর্তারা ফুল, ফল, মিষ্টি ও বিভিন্ন খাবার নিয়ে তাদের সঙ্গে দেখা করেন।
বিএনপি চেয়ারপারসন, বিরোধীদলীয় নেতা বেগম খালেদা জিয়া বঙ্গবন্ধু আন্তর্জাতিক সম্মেলন কেন্দ্রে বেলা সাড়ে ১১টায় ৪২টি দেশের কূটনীতিকদের সঙ্গে ঈদের দিন শুভেচ্ছা বিনিময় করেন। সাড়ে ১২টা থেকে দেড়টা পর্যন্ত সমাজের বিশিষ্ট নাগরিকসহ সর্বস্তরের মানুষের সঙ্গে শুভেচ্ছা বিনিময় করেন। জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যান হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ রংপুরের প্রধান ঈদগাহ কালেক্টরেট মাঠে ঈদের নামাজ আদায় করেন। তিনি প্রতি রোজার ঈদ ঢাকায় করলেও কোরবানির ঈদ রংপুরেই উদযাপন করে থাকেন। ঈদ উপলক্ষে সিটি করপোরেশনের আওতাধীন সব শিশু পার্কে সুবিধাবঞ্চিত শিশুদের জন্য বিনা টিকিটে ভ্রমণের ব্যবস্থা থাকায় সকাল থেকেই এসব পার্কে ছিল ওদের সরব উপস্থিতি। এ ছাড়া ঈদ উপলক্ষে বিনা টিকিটে ঢাকা জাদুঘর দেখার ব্যবস্থা করেছিল সংস্কৃতিবিষয়ক মন্ত্রণালয়। ঈদ উপলক্ষে সরকারি-বেসরকারি টেলিভিশন চ্যালেনগুলো কয়েক দিন ধরে প্রচার করছে ঈদের বিশেষ অনুষ্ঠানমালা। এদিকে, সারা বিশ্বের মুসলমানদের ঈদুল আজহার শুভেচ্ছা জানিয়েছেন যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামা। মঙ্গলবার এক শুভেচ্ছা বাণীতে ওবামা ও ফার্স্ট লেডি মিশেল বলেন, আমেরিকার জনগণের পক্ষ থেকে সারা বিশ্বের মুসলিমদের প্রতি রইল ঈদুল আজহার শুভ কামনা। হজ উপলক্ষে সমবেত তীর্থযাত্রীদেরও অভিনন্দন জানান তারা।
'এটি হচ্ছে বিশ্বের অন্যতম একটি বৃহৎ এবং ব্যতিক্রমধর্মী সমাগম। ৩০ লাখ তীর্থযাত্রীর মধ্যে বহু আমেরিকানও রয়েছেন।' হজের ব্যতিক্রমী বৈশিষ্ট্য আবরাহামিক বিশ্বাসের বিস্তৃত ভিত্তির কথাই স্মরণ করিয়ে দেয় বলে মনে করেন যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট। সমস্যা মোকাবিলায় মানুষকে ঐক্যবদ্ধভাবে কাজ করাতে বিশ্বাস কীভাবে ইতিবাচক ভূমিকা রাখে ঈদের কর্মসূচি এর একটি সরল উদাহরণ বলে মনে করেন তিনি। উৎসবের তাৎপর্য বর্ণনা করতে গিয়ে ওবামা বলেন, 'ঈদুল আজহায় ক্ষুধার্ত, রোগাক্রান্ত ও দুর্দশাগ্রস্ত মানুষকে সাহায্য করার মাধ্যমে মুসলিমরা অন্য সম্প্রদায়ের অনুসারীদের সঙ্গে মিলিত হচ্ছে।'
ঈদ উদযাপনে ফ্লাইওভার নতুন মাত্রা : ধর্মীয় ভাবগাম্ভীর্যের মধ্য দিয়ে ঈদ উদযাপনের পাশাপাশি এবার রাজধানীবাসীর ঈদ উৎসবে যোগ হয়েছে নতুন মাত্রা। রাজধানীর চারটি উড়াল সড়ক ও হাতির ঝিল এখন রাজধানীবাসীর ঘুরে বেড়ানোর নতুন জায়গা।
বুধবার রাজধানীর বিভিন্ন স্থান ঘুরে দেখা গেছে, দুপুর গড়াতেই কুড়িল ফ্লাইওভার, বনানী ফ্লাইওভার এবং গুলিস্তান-যাত্রাবাড়ী ফ্লাইওভারে লোকজনের ভিড়। ঈদের দিন বিকালে বৃষ্টির কারণে কুড়িল ফ্লাইওভার, বনানী ফ্লাইওভার ও হাতির ঝিল ছিল প্রায় ফাঁকা। তবে সন্ধ্যার পর যাত্রাবাড়ী ফ্লাইওভার ছিল লোকারণ্য।