শিরোনাম
বুধবার, ২৭ আগস্ট, ২০১৪ ০০:০০ টা

ওয়াসার ব্যর্থতায় জলাবদ্ধ ঢাকা

ওয়াসার ব্যর্থতায় জলাবদ্ধ ঢাকা

মাত্র দু-তিন দিনের থেমে থেমে চলা বৃষ্টিপাতে রাজধানীর নিুাঞ্চলসহ বিরাট এলাকা ভয়াবহ জলাবদ্ধতায় আটকে পড়েছে, সৃষ্টি হয়েছে বিপর্যস্ত পরিস্থিতির। রাস্তাঘাটের অবস্থা লণ্ডভণ্ড। অনেক মহল্লার শাখা রোড, অলিগলি হাঁটুপানিতে নিমজ্জিত হয়েছে। ড্রেন-ডাস্টবিন, নর্দমা, স্যুয়ারেজে একাকার অবস্থায় জিম্মি হয়ে পড়েছেন যাত্রাবাড়ী, ডেমরা, কদমতলী, মুগদা, সবুজবাগ, রামপুরা, বাড্ডা, খিলক্ষেত, দক্ষিণখান, ভাটারা, ভাসানটেক ও পল্লবী-কাফরুলের ২০ লক্ষাধিক মানুষ। চারদিকেই নোংরা আবর্জনার ছড়াছড়ি, উৎকট দুর্গন্ধে বাতাস ভারী, রীতিমতো দম বন্ধ হওয়ার উপক্রম হচ্ছে। এসব বর্জ্য, তরল ময়লা বৃষ্টির পানির সঙ্গে মিশে গলির রাস্তা উপচে বাড়িঘরের ভিতরে ঢুকে অবর্ণনীয় দুর্ভোগে ফেলেছে বাসিন্দাদের। সবচেয়ে ভোগান্তির শিকার হচ্ছেন বিভিন্ন সড়কে চলাচলকারী নগরবাসী। নির্মাণাধীন ফ্লাইওভারের কারণে কাদা-পানি মিলিয়ে বিপজ্জনক পিচ্ছিল সরোবর গড়ে উঠেছে যাত্রাবাড়ী, সায়েদাবাদ, গুলিস্তান ও কুড়িল এলাকায়। রামপুরা থেকে মালিবাগ, মগবাজার থেকে মৌচাক, মিরপুর, শাহআলী, কাফরুলসহ বেশির ভাগ এলাকার রাস্তা সংস্কারের স্থানগুলোয় পারাপারের ক্ষেত্রে কী ধরনের দুর্ভোগ পোহাতে হচ্ছে তা চোখে না দেখলে বোঝার উপায় নেই। শ্যামপুর, ডেমরা, কাজলা, পোস্তগোলা, ফরিদাবাদ, মানিকনগর, মুগদা, মান্ডার নিচু এলাকাগুলোর জলাবদ্ধতা যেন কাটছেই না। স্থানীয়রা নিজেরাই পানি অপসারণে নানা স্থানে খোঁড়াখুঁড়ি করেও কোনো সুফল পাচ্ছেন না। যাত্রাবাড়ী মীরহাজিরবাগ এলাকার বাসিন্দা কাজী আনিসুর রহমান জানান, বৃষ্টি হলেই পায়ে হেঁটে চলাচলের উপায় থাকে না। খানাখন্দ ডিঙিয়ে, নোংরা পানিতে পা চুবিয়ে লাফিয়ে লাফিয়ে পথ চলতে হয়। মান্ডার বাসিন্দা সলিম গাজী, দুলাল আহমেদ, মনিরুজ্জামান মেম্বার, মজিবর রহমানসহ অনেকেই জানান, রাস্তা-গলি ছাড়িয়ে ড্রেন-নর্দমার পানি, ময়লা এখন বাড়ি বাড়ি ঢুকে পড়েছে। সামান্য বৃষ্টিতেই আদাবর, শ্যামলী ও মোহাম্মদপুরের বিভিন্ন সরু গলিতেও পানি জমেছে, পুরান ঢাকার বনগ্রাম, শশীমোহন বসাক লেন, উত্তর মৈশুণ্ডির রাস্তার অবস্থা শোচনীয়। ভাটারা থানা পেরিয়ে পুবদিকে সম্প্রসারিত সৌদি দূতাবাসের চারপাশেই কাদা-পানির বেহাল পরিস্থিতি। সেসব স্থানে খোলা ড্রেনগুলো নিমজ্জিত হওয়ায় পানির মধ্যেই ভেসে বেড়াচ্ছে নানা গলিজ পদার্থ। ফলে স্কুলগামী শিশুদেরও জুতা-মোজা খুলে জামা-প্যান্ট উঁচিয়ে ধরে গলির পানিপথ হেঁটে পেরোতে হচ্ছে। শাহজাদপুরের বাসিন্দা শামীমুল ইসলাম, আলমাস উদ্দিন ও খিলবাড়ীরটেক এলাকার বাসিন্দা মোক্তার হোসেন বলেন, নূরের চালা, খিলবাড়ীরটেক ও শাহজাদপুরের সব রাস্তা, অলিগলি জলাবদ্ধ হয়ে আছে। ক্যামব্রিয়ান কলেজের ছাত্রীরা জানান, নোংরা পানির উৎকট দুর্গন্ধে আশপাশে দাঁড়ানোর উপায় নেই। রবিবার, সোমবার ও গতকালের কয়েক দফা বৃষ্টিতে পুরান ঢাকার কাজলা, শ্যামপুর, পোস্তগোলা, ডেমরা, মানিকনগর ও ফরিদাবাদসহ নিচু এলাকাগুলোয় জলাবদ্ধতার সৃষ্টি হয়েছে। কাজলার বাসিন্দা মামুনুর রশিদ জানান, বৃষ্টিতে শ্যামলী, আদাবর ও মোহাম্মদপুরের বিভিন্ন গলিতে পানি জমে। মানিকনগরের বাসিন্দা শাহনেওয়াজ জানান, মানিকনগর, ধলপুর ও দক্ষিণ মুগদার নিচু এলাকায় টিনশেড বাড়িগুলোয় পানি ঢুকে চরম দুর্ভোগের সৃষ্টি করেছে। পানি সরাতে সিটি করপোরেশনের কোনো সহায়তা মিলছে না।
নগরীর পানি নিষ্কাশন ব্যবস্থার সঙ্গে সম্পৃক্ত প্রকৌশলী ইনামুল কবির ও এস এম খালেদ হোসাইন জানান, ২০ বছর আগেও মহানগরীতে প্রায় অর্ধেক ছিল নিচু জলাভূমি। এখন সেসবের অস্তিত্ব নেই। পুকুর-জলাশয় ভরাট হয়ে গড়ে উঠেছে বাড়িঘর। খাল-বিল ভরাট, জলাশয় দখল করে নানা স্থাপনা নির্মাণ এবং ভগ্নদশাগ্রস্ত ড্রেনেজব্যবস্থার কারণেই নগরবাসীকে জলাবদ্ধতায় হাবুডুবু খেতে হচ্ছে। খোঁজ নিয়ে জানা যায়, পানি নিষ্কাশন সচল রাখা ও স্যুয়ারেজ ব্যবস্থা গড়ে তুলতে ঢাকা ওয়াসা ২৫টিরও বেশি প্রকল্প হাতে নেয়। কিন্তু কোনো প্রকল্পই পূর্ণাঙ্গভাবে সম্পন্ন করা যায়নি। ওয়াসার পদস্থ এক কর্মকর্তা জানান, ‘ঢাকা মহানগরীর জলাবদ্ধতা দূরীকরণ প্রকল্প’ নামে একটি প্রকল্পও অর্থাভাবে মুখ থুবড়ে পড়ে আছে। রাজধানীর জলাবদ্ধতা দূর করতে ওয়াসা ১৮০ কোটি টাকার আরও একটি প্রকল্প হাতে নেয়। এর আওতায় নগরীজুড়ে ৬৪ কিলোমিটার স্ট্রম স্যুয়ারেজ (বড় পাইপের নর্দমা) নির্মাণের পাশাপাশি নগরীর ২৭ স্থানে ১২০টি পানি নিষ্কাশন পাম্প বসানোর কথা ছিল। কিন্তু নানা জটিলতায় প্রকল্পটি সফল হয়নি। অনেক স্থানেই পুরনো ড্রেনেজব্যবস্থা দেখিয়েই প্রকল্পের টাকা লুটপাট হয়েছে বলেও অভিযোগ রয়েছে। রাজধানীর কয়েকটি খাল ধ্বংস করে কোটি কোটি টাকার বক্স কালভার্টগুলো এখন অভিশাপ হয়ে দাঁড়িয়েছে। এসব বক্স কালভার্ট অর্ধনির্মিত অবস্থায় ১৮ বছর ধরে ফেলে রাখা হয়েছে। বক্স কালভার্টের কংক্রিট দেয়ালে ঠেস দিয়েই গড়ে উঠেছে দখলবাজদের বাড়িঘর, স্থাপনা। বক্স কালভার্টের ওপর টিনের চালা আর বাঁশের বেড়া দিয়ে বানানো হয়েছে রিকশা গ্যারেজ, গোয়ালঘর, ঝুপড়ি বস্তি। অবৈধ দখলদাররা খালের বিভিন্ন পয়েন্ট ভরাট করেছে। ফলে পানিপ্রবাহ বাধাপ্রাপ্ত হচ্ছে। জলাবদ্ধতা দূরীকরণ, তরল ময়লা নিষ্কাশন ও খালগুলোকে নানা মাত্রায় ব্যবহারের লক্ষ্যে ওয়াসা ১৯৯৬ সালে বক্স কালভার্ট নির্মাণ প্রকল্প হাতে নেয়। ব্যয় করা হয় ২০০ কোটি টাকা। এ প্রকল্পের আওতায় সেগুনবাগিচা খাল (সেগুনবাগিচা-ফকিরাপুল-মতিঝিল-দক্ষিণ কমলাপুর) ও ধলপুর খাল (উত্তর সায়েদাবাদ-ধলপুর-মানিকনগর-মুগদা-কদমতলা) বক্স কালভার্টে পরিণত করার কাজ চালানো হয়। কিন্তু স্থানে স্থানে নির্মাণকাজ বন্ধ করে রাখায় বক্স কালভার্ট পানিপ্রবাহের ক্ষেত্রে কোনো কাজেই লাগেনি। জলাবদ্ধতায় জিম্মি হয়ে রয়েছেন দক্ষিণখান ও উত্তরখান এলাকার সাত লক্ষাধিক বাসিন্দা। কাদা-পানি, তরল ময়লা, আবর্জনা, কল-কারখানার বিষোদগার মিলিয়ে সৃষ্ট জলাবদ্ধতা থেকে ছড়িয়ে পড়েছে তীব্র দুর্গন্ধ। হজ ক্যাম্প নর্দ্দাপাড়া রোডের কাসেম শেখ ও সুজনসহ কয়েকজন জানান, যত্রতত্র ময়লা-আবর্জনার স্তূপ, কাঁচা টয়লেটের খোলামেলা সংযোগ ও জলাবদ্ধতার বেহাল চিত্র তাকিয়ে দেখলেও শরীর রি রি করে ওঠে। জয়নাল মার্কেট এলাকায় আরও খারাপ অবস্থা। জলাবদ্ধতায় নিমজ্জিত রাস্তাগুলো দেখলে মনে হয় দক্ষিণখান এলাকা যেন যুদ্ধবিধ্বস্ত লণ্ডভণ্ড এক জনপদ। চালাবন চৈতি গার্মেন্ট এলাকার বাসিন্দা আতিকুর রহমান জানান, ভাঙাচোরা, খানাখন্দে ভরপুর রাস্তায় অবর্ণনীয় দুর্ভোগের বিষয়টি ভুক্তভোগীমাত্রই বোঝেন। ‘জলাবদ্ধতা’-কে স্থায়ী অভিশাপ হিসেবে চিহ্নিত করে দক্ষিণখান আদর্শ ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান তোফাজ্জল হোসেন বলেন, সরকারি বিশেষ সহায়তা না থাকায় একটি ড্রেন নির্মাণ করাও অসম্ভব।

সর্বশেষ খবর