বুধবার, ২৭ আগস্ট, ২০১৪ ০০:০০ টা

দীর্ঘমেয়াদি মন্দা চলছে ব্যবসা-বাণিজ্যে

দীর্ঘমেয়াদি মন্দা থেকে বেরিয়ে আসতে পারছে না দেশের ব্যবসা-বাণিজ্য। পুঁজির অভাবে ঝিমিয়ে পড়েছে শিল্পায়ন। গ্যাস, বিদ্যুৎ ও ভৌত অবকাঠামোর কারণে আশানুরূপ বিদেশি বিনিয়োগ হচ্ছে না। বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোতে অলস টাকার পাহাড় জমলেও চড়া সুদের কারণে উদ্যোক্তারা ঋণ নিতে অনাগ্রহী। ফলে আটকে আছে দেশি বিনিয়োগ। বাড়েনি শিল্পের মূলধনী কাঁচামালের আমদানি। অর্থবছরের শুরুতেই হোঁচট খেয়েছে রপ্তানি আয়। ধস নেমেছে তৈরি পোশাক খাতে। রাজনৈতিক অস্থিরতা না থাকলেও ব্যবসায়ীদের মনে শঙ্কা কাটেনি। আবাসন খাতেও বন্ধ্যত্ব চলছে। তবে বাণিজ্যমন্ত্রী তোফায়েল আহমেদ বলেছেন, দেশের ব্যবসা-বাণিজ্য ও অর্থনীতি অতীতের যে কোনো সময়ের চেয়ে এখন ভালো যাচ্ছে। ভালো চলছে।
অবশ্য দেশের অর্থনীতির বিশ্লেষক ও পর্যবেক্ষকরা এ বক্তব্যের সঙ্গে একমত নন। তাদের মতে, সহজ ব্যাংক ঋণ, টেকসই জ্বালানি, অবকাঠামো ইত্যাদি সুবিধার ঘাটতি ব্যবসা-বাণিজ্যের মন্দাকে ত্বরান্বিত করছে। এর সঙ্গে রয়েছে দুর্নীতি ও কমিশন বাণিজ্য। তারা মনে করেন, ব্যবসায় মন্দা থেকে বেরিয়ে আসতে সবকিছুর ঊর্ধ্বে ভালো রাজনৈতিক পরিবেশ নিশ্চিত করতে হবে। একই সঙ্গে প্রশাসনিক দুর্বলতা দূর করতে হবে। শিল্পপতি-উদ্যোক্তা আর ব্যবসায়ীরা বলছেন, বিনিয়োগকারীদের সুবিধার জন্য চালু করা বিনিয়োগ বোর্ডের ওয়ান স্টপ সার্ভিস এখন কার্যত অকেজো। মুদ্রানীতিও বিনিয়োগবান্ধব নয়। ব্যাংক ঋণের সুদও চড়া। মাত্রাতিরিক্ত সার্ভিস চার্জ ও কমিশনও এখন বিনিয়োগের বড় অন্তরায়। রাজস্ব নীতিও বিনিয়োগের অনুকূল নয়। এসব মিলে সরকারি নীতিগুলোই এখন বিনিয়োগের সবচেয়ে বড় বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছে।
জানা গেছে, শিল্প ও ব্যবসা খাতে ঋণ বিতরণের ক্ষেত্রে ব্যাংকগুলো মাত্রাতিরিক্ত সুদ আদায় করছে। হিসাবের মারপ্যাঁচের মাধ্যমে তারা বাজারে ঘোষিত সুদ হারের চেয়ে বেশি আদায় করছেন। ফলে প্রকৃত সুদের হার ২০ থেকে ২১ শতাংশে দাঁড়াচ্ছে। ব্যাংকগুলো বর্তমানে ঋণের বিপরীতে প্রতি তিন মাস পরপর সুদ হিসাব করে তা মূল ঋণের সঙ্গে যোগ করছে। ফলে তিন মাস পর সুদ হয়ে যাচ্ছে মূল ঋণ। এ অবস্থায় বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোতে প্রতিদিনই বাড়ছে অলস অর্থের পাহাড়। বাণিজ্যমন্ত্রী তোফায়েল আহমেদ বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, দেশের ব্যবসা-বাণিজ্য ও অর্থনীতি অতীতের যে কোনো সময়ের চেয়ে এখন ভালো যাচ্ছে। ভালো চলছে। বিদেশি বিনিয়োগ আসছে। তার মতে, বিশ্বের ৫টি দেশ অর্থনৈতিক উন্নয়নে এগিয়ে আছে। এর মধ্যে বাংলাদেশ চার নম্বর অবস্থানে রয়েছে। ঢাকা স্কুল অব ইকোনমিক্সের চেয়ারম্যান ও দেশের প্রখ্যাত অর্থনীতিবিদ ড. কাজী খলীকুজ্জামান আহমদও মনে করেন, বিনিয়োগ বাড়াতে বিদ্যুৎ-জ্বালানির মতো বড় বড় অবকাঠামোতে সরকারের গুরুত্ব আরও বাড়াতে হবে। ব্যবসায়ীদের শীর্ষ সংগঠন বাংলাদেশ শিল্প ও বণিক সমিতি ফেডারেশনের (এফবিসিসিআই) সাবেক সভাপতি আবদুল আউয়াল মিন্টু বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, দেশে রাজনৈতিক অস্থিরতা প্রবলভাবে বিরাজমান। এ কারণে বিনিয়োগ হচ্ছে না। নেই জরুরি ভৌত অবকাঠামো, রাস্তা-ঘাট। বিদ্যুতের একটু উন্নতি হলেও অন্যান্য জ্বালানি সংকট দৃশ্যমান। সব কিছু মিলিয়ে ব্যবসায়িক পরিবেশ নেই বলে সব ধরনের ব্যবসাই খারাপ যাচ্ছে। তবে এফবিসিসিআইর আরেক সাবেক সভাপতি সালমান এফ রহমান মনে করেন, ব্যবসা এখন ভালো যাচ্ছে। সংসদ নির্বাচনের পর রাজনৈতিক পরিস্থিতি স্থিতিশীল রয়েছে। দেশের আর্থ-সামাজিক উন্নয়নে সরকার যে সব বড় বড় প্রকল্প হাতে নিয়েছে, তা বাস্তবায়ন করতে পারলে অর্থনীতির চেহারা পাল্টে যাবে। দেশের জ্বালানি সমস্যার অনেকটা উন্নতি হয়েছে। এই মুহূর্তে ব্যবসায়ীদের বড় সমস্যা হলো ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়ক। এর নির্মাণ কাজ দ্রুত সম্পন্ন করা উচিত। এদিকে চলতি ২০১৪-১৫ অর্থবছরের প্রথম মাসে কমে গেছে রপ্তানি আয়। আগের ২০১৩-১৪ অর্থবছরের একই সময়ের তুলনায় জুলাইয়ে রপ্তানি কমেছে ১ দশমিক ৩৭ শতাংশ। লক্ষ্যমাত্রাও অর্জিত হয়নি অর্থবছরের প্রথম মাসে। অর্থবছরের শুরুতে রপ্তানি কমায় শঙ্কার কথা জানিয়েছেন ব্যবসায়ীরা। রাজনৈতিক অস্থিরতা, পোশাক খাতের নানা সংকট পার করে অনেক দিন ধরেই ইতিবাচক ধারায় আছে রপ্তানি আয়। তবে চলতি অর্থবছরের প্রথম মাসে কমে গেছে রপ্তানির পরিমাণ। বাংলাদেশ এক্সপোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশনের (ইএবি) সভাপতি আবদুস সালাম মুর্শেদীর মতে, রপ্তানি আয়ে এ ধস মূলত তাজরীন ফ্যাশনসে আগুন ও রানা প্লাজা ধসের কারণে। সেই সঙ্গে আছে রাজনীতির নামে নাশকতা। ফলে বিদেশি ক্রেতারা ক্রয় আদেশ কমিয়ে দিয়েছেন। এদিকে কোনো ভাবেই সংকট পিছু ছাড়ছে না দেশের বিকাশমান আবাসনশিল্পের। জমি ও ফ্ল্যাট রেজিস্ট্রেশনে ক্রেতা-বিক্রেতাদের কাছে নতুন বিরক্তির কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে ই-টিআইএন বাধ্যবাধকতা। কিন্তু এই ঝামেলা থেকে মুক্তি চান ক্রেতা-বিক্রেতারা। তাদের আরও দাবি- গ্যাস-বিদ্যুতের সংযোগ, সহজ শর্তে স্বল্প সুদে ব্যাংক ঋণ, ভবন নির্মাণে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের হয়রানি ও ভোগান্তি থেকে রেহাই। আবাসন খাতকে চাঙ্গা করতে অপ্রদর্শিত বা কালোটাকা বিনিয়োগের অবাধ সুযোগ। আবাসন ব্যবসায়ীদের সংগঠন রিয়েল এস্টেট অ্যান্ড হাউজিং অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (রিহ্যাব) তথ্যমতে, দেশে এখন ৩৩৮টি আবাসন প্রতিষ্ঠানের ২২ হাজার ৫৭২টি ফ্ল্যাট অবিক্রীত রয়েছে। এসব ফ্ল্যাটের আনুমানিক বাজার মূল্য ২১ হাজার ৫০৬ কোটি ৩৬ লাখ ৭৫ হাজার টাকা। তবে রিহ্যাবের সদস্য ১ হাজার ২১৬টি প্রতিষ্ঠান হলেও সবগুলো আবাসন প্রতিষ্ঠানের অবিক্রীত ফ্ল্যাটের হিসাব সংগঠনটির কাছে নেই। যদিও রিহ্যাব ধারণা করে বলছে, সব মিলিয়ে এ সংখ্যা আনুমানিক ৪৫ থেকে ৫০ হাজার টাকা। জানতে চাইলে রিহ্যাবের সহসভাপতি মোহাম্মদ লিয়াকত আলী ভূইয়া বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, আমাদের এ সংকট মোকাবিলায় খুব বেশি দাবি নেই। কেবল মাত্র সরকারের কাছে কিছু নীতি সহয়তা চাই। এসব নীতি সহায়তার মধ্যে রয়েছে, ক্রেতাদের জন্য সহজ শর্তে স্বল্প সুদে ১ হাজার ৫০০ কোটি টাকার একটি ঋণ তহবিল। নির্মিত ভবনে সোলার প্যানেলের (সৌর বিদ্যুৎ) বাধ্যবাধকতা বাতিল করতে হবে। এ জন্য প্রয়োজনে আমরা সার চার্জ দেব। এই সার চার্জের অর্থ দিয়ে সরকার গ্রামে সৌর বিদ্যুৎ সরবরাহ করতে পারবে।

সর্বশেষ খবর