বুধবার, ২৭ আগস্ট, ২০১৪ ০০:০০ টা

পদোন্নতি ও বৈষম্যে ক্ষুব্ধ ২৬ ক্যাডার

সরকারি কর্মকর্তাদের সাধারণ ২৮ ক্যাডারের মধ্যে পদোন্নতি ও আচরণ বৈষম্যের অভিযোগে ক্ষুব্ধ হয়ে উঠেছেন ২৬ ক্যাডারের প্রায় ৪৬ হাজার কর্মকর্তা। পেশাগত বৈষম্য দূর করতে প্রশাসন ক্যাডারের প্রায় ৫ হাজার কর্মকর্তাকে বাদ দিয়ে অন্য ক্যাডার সদস্যদের সমন্বয়ে বাংলাদেশ সিভিল সার্ভিস অ্যাসোসিয়েশন নামে একটি সংগঠনও প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে। এ সংগঠনের নেতাদের অভিযোগ, সরকারের যুগ্ম সচিব, অতিরিক্ত সচিব পদে পদোন্নতির ক্ষেত্রে আদালতের রায় লঙ্ঘন করা হচ্ছে।

হাইকোর্টের রায় অনুযায়ী একটি কমন জ্যেষ্ঠতা তালিকা প্রণয়ন না করা পর্যন্ত ২০০৩ সালের সরকারি সিদ্ধান্ত মোতাবেক যুগ্ম সচিব বা তদূর্ধ্ব পদে শুধু প্রশাসন ক্যাডারের জন্য ৭০-৭৫% এবং অন্যান্য ক্যাডারের জন্য ২৫-৩০% কোটা রেখে পদোন্নতি দেওয়ার বিধান থাকলেও তা মানা হচ্ছে না। প্রশাসন ক্যাডারের সদস্যরা অন্য ক্যাডারের সিনিয়র সদস্যের সঙ্গে অনেক সময় সৌজন্যমূলক আচরণও করছে না বলে অভিযোগ উঠেছে। সার্বিক বিষয় নিয়ে সংগঠনটি প্রধানমন্ত্রীর হস্তক্ষেপ কামনা করবে। সূত্র এমন তথ্য নিশ্চিত করেছে। সিভিল সার্ভিস অ্যাসোসিয়েশনের নেতারা বলেন, সাধারণ জ্যেষ্ঠতা তালিকা প্রণয়নের ক্ষেত্রে বাংলাদেশ পাবলিক সার্ভিস কমিশন কর্তৃক সুপারিশকৃত বিসিএস ব্যাচকে জ্যেষ্ঠতা তালিকা প্রণয়নের ভিত্তি হিসেবে গণ্য করা উচিত। জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের কম্পিউটার কেন্দ্র (পিএসিসি) হতে বিসিএস প্রশাসন ক্যাডারের কর্মকর্তাদের পদোন্নতির ক্ষেত্রে এসএসবিতে ব্যাচভিত্তিক তথ্য উপস্থাপন করা হলেও অন্যান্য ক্যাডারের কর্মকর্তাদের ক্ষেত্রে তা করা হয় না। ফলে পদোন্নতির ক্ষেত্রে ব্যাপক বৈষম্য দেখা যায়। বিসিএস প্রশাসন ক্যাডারের মতো অন্যান্য ক্যাডারের ক্ষেত্রে ব্যাচভিত্তিক তথ্য এসএসবিতে উপস্থাপন করা জরুরি। অ্যাসোসিয়েশনের নেতারা অভিযোগ করেন, যুগ্ম সচিব থেকে ওপরের পদগুলোতে পদোন্নতির ক্ষেত্রে অন্যান্য ক্যাডারের জন্য ২৫-৩০ শতাংশ রাখার বিধান থাকলেও তা মানা হচ্ছে না। বর্তমানে সচিব ও সমমর্যাদার কর্মকর্তার সংখ্যা হলো ৭৪। এর মধ্যে অন্য ক্যাডারের ১১ জন। শতকরা হিসাবে ১৪.৮৬ ভাগ, অতিরিক্ত সচিব পদমর্যাদার কর্মকর্তার সংখ্যা হলো ২৭৪। এর মধ্যে অন্য ক্যাডারের ৫০ জন। শতকরা হিসাবে ১৮.২৪ ভাগ, যুগ্ম সচিব পদমর্যাদার কর্মকর্তার সংখ্যা হলো ৯১৪। এর মধ্যে অন্য ক্যাডারের ১৩১ জন। শতকরা হিসাবে ১৪.৩৩ এবং উপসচিব পদমর্যাদার কর্মকর্তার সংখ্যা হলো ১২৯৪। এর মধ্যে অন্য ক্যাডারের ২৪০ জন। শতকরা হিসাবে ১৮.৫৪ ভাগ।

জানা গেছে, ২০০৯ সালে উপসচিব পদোন্নতি দেওয়া হয়েছে ২৭১ জনকে। এর মধ্যে ২৬ ক্যাডার থেকে পদোন্নতি দেওয়া হয়েছে ৬৯ জনকে। যুগ্ম সচিব পদে পদোন্নতি দেওয়া হয়েছে ২৪৯। ২৬ ক্যাডার থেকে পদোন্নতি ৫৬ জনকে। অতিরিক্ত সচিব পদোন্নতি দেওয়া হয়েছে ১৩২, ২৬ ক্যাডার থেকে দেওয়া হয়েছে ২৫। ২০১০ সালে উপসচিব পদোন্নতি দেওয়া হয়েছে ২৯৪ জনকে। এর মধ্যে ২৬ ক্যাডার থেকে পদোন্নতি দেওয়া হয়েছে ৭৭ জনকে। যুগ্ম সচিব পদে পদোন্নতি দেওয়া হয়েছে ১৫৮। ২৬ ক্যাডার থেকে পদোন্নতি ৪৬ জনকে। ২০১২ সালে উপসচিব পদোন্নতি দেওয়া হয়েছে ২৫৮ জনকে। এর মধ্যে ২৬ ক্যাডার থেকে পদোন্নতি দেওয়া হয়েছে ৬৭ জনকে। যুগ্ম সচিব পদে পদোন্নতি দেওয়া হয়েছে ২৬৪। ২৬ ক্যাডার থেকে পদোন্নতি ২২ জনকে। অতিরিক্ত সচিব পদোন্নতি দেওয়া হয়েছে ১২৭ এবং ২৬ ক্যাডার থেকে দেওয়া হয়েছে ১৬ জনকে। ২০১৩ সালে যুগ্ম সচিব পদে পদোন্নতি দেওয়া হয়েছে ৩২৬। ২৬ ক্যাডার থেকে পদোন্নতি দেওয়া হয় ৩৯ জনকে এবং ২০১৪ সালে অতিরিক্ত সচিব পদে পদোন্নতি দেওয়া হয়েছে ৮০, ২৬ ক্যাডার থেকে দেওয়া হয়েছে ২১ জনকে। এ ছাড়া পদোন্নতি বঞ্চনার উদাহরণ তুলে ধরে অ্যাসোসিয়েশনের দায়িত্বশীল একজন বলেন, ১৩তম বিসিএসে সাধারণ ক্যাডারের ৩৭৪ জনকে নিয়োগ দেওয়া হয়েছে। এর মধ্যে প্রশাসন ক্যাডারের সর্বশেষ কর্মকর্তাকেও পদোন্নতি দিয়ে উপসচিব করা হয়েছে। প্রশাসন ক্যাডারের ২০তম ব্যাচও এখন উপসচিব হিসেবে পদোন্নতির অপেক্ষায় আছে। কিন্তু অন্য ক্যাডারের ১৩তম ব্যাচের কর্মকর্তারা এখনো পদোন্নতি পাননি। কবে তাদের পদোন্নতি হবে সে সম্পর্কেও সুস্পষ্ট কোনো বক্তব্য কারও কাছ থেকে পাওয়া যাচ্ছে না। এভাবে ওপরের সব পদেই একই অবস্থা। আচরণগত বৈষম্যের বিষয়টি উল্লেখ করে অ্যাসোসিয়েশনের একটি সূত্র জানিয়েছে, প্রশাসন ক্যাডারের এক ব্যাচ সিনিয়র কর্মকর্তাকেও তারা স্যার বলে সম্বোধন করেন কিন্তু অন্য ব্যাচের কর্মকর্তা পাঁচ ব্যাচ সিনিয়র হলেও তারা স্যার বলেন না। কখনো ভাই বলে, আবার কখনো সাহেব বলে সম্বোধন করা হয়। সুযোগ-সুবিধার ক্ষেত্রেও বৈষম্য করা হয়। প্রশাসনের সব কর্মকর্তাকেই গুরুত্বপূর্ণ পদে পদোন্নতি দেওয়া হয়। কিন্তু অন্য ক্যাডারের কর্মকর্তাদের ডাম্পিং পোস্টিং দেওয়া হয় বলে অভিযোগ করা হয়। নাম প্রকাশ না করে সংগঠনের একজন যুগ্ম আহ্বায়ক বলেন, সব বৈষম্য তালিকাভুক্ত করে খুব শীঘ্রই প্রধানমন্ত্রীর দৃষ্টিতে আনা হবে। অ্যাসোসিয়েশনের যুগ্ম আহ্বায়ক ও বাংলাদেশ বেতারের মহাপরিচালক কাজী আকতার উদ্দিন আহমেদ বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, আমরা আমাদের ন্যায্য দাবি আদায়ের জন্যই প্রশাসন ক্যাডারকে বাইরে রেখে সংগঠনটি প্রতিষ্ঠা করেছি। আমরা প্রজাতন্ত্রের কর্মচারী হয়ে প্রজাতন্ত্রের সেবা করার জন্যই সব বৈষম্যমুক্ত থাকতে চাই।

 

 

প্রশাসন ক্যাডারের দায়িত্বশীল একটি সূত্র জানিয়েছে, প্রশাসন চালানোর জন্যই প্রশাসন ক্যাডারের জন্ম। প্রশাসন ক্যাডারের একজন কর্মকর্তাকে তার লাইন পোস্ট সচিব পর্যন্ত পেঁৗছতে তিলে তিলে নিজেকে গড়ে তুলতে হয়। প্রশাসনের উচ্চ পর্যায়ে সব ক্যাডারের কর্মকর্তা যেন তাদের মেধা ও যোগ্যতাকে কাজে লাগাতে পারে সে জন্যই ক্যাডার পরিবর্তনের সুযোগ রাখা হয়েছে।

জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সচিব ড. কামাল আবদুল নাসের চৌধুরী বলেন, সরকারের প্রশাসনে সিনিয়র সার্ভিস পুল নেই। সে কারণে বিদ্যমান নিয়ম-নীতি অনুসরণ করেই পদোন্নতি দেওয়া হচ্ছে। একই সঙ্গে মেধা এবং যোগ্যতাকেও পদোন্নতির ক্ষেত্রে বিবেচনায় আনা হয়। লাইন পোস্টে সংশ্লিষ্ট ক্যাডারের কর্মকর্তাদেরই পদায়ন করা হয়। ক্যাডার পরিবর্তন করে যেসব কর্মকর্তা উপসচিব হয়েছেন তারা তাদের নিজেদের আগ্রহেই হয়েছেন। সবাইকে নিয়েই প্রশাসন। সচিব পদে পদায়নের বিষয়টি একটু ভিন্ন। আমরা সবাই প্রজাতন্ত্রের কর্মচারী কিন্তু সচিব হলেন সরকারের। সরকার কোন কর্মকর্তাকে সচিব পদে যোগ্য মনে করবে সে সিদ্ধান্ত সরকারের। আর অন্য ক্যাডার কর্মকর্তাদের সঙ্গে প্রশাসন ক্যাডারের বৈষম্য সৃষ্টির কোনো কারণ নেই। ক্ষুব্ধ হওয়ার মতোও কিছু হয়নি। তবে দীর্ঘদিন এক পদে থাকার পরও পদোন্নতি না হওয়ার মতো বিষয় বিদ্যমান আছে বলে তিনি স্বীকার করেন এবং সেই সঙ্গে এসব সমস্যা শীঘ্রই সমাধানেরও চেষ্টা চলছে বলে তিনি জানান।

 

 

সর্বশেষ খবর