পেটের সমস্যা নিয়ে ময়মনসিংহ মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের মেডিসিন ওয়ার্ডে ভর্তি হয়েছেন সিদ্দিকুর রহমান। চিকিৎসক তাকে করনস্কোপি করতে বলেছেন। পরামর্শ দিয়েছেন শহরের পপুলার ডায়াগনস্টিক সেন্টারে করনস্কোপি করতে। এ জন্য তাকে গুনতে হয়েছে চার হাজার টাকা। শুধু সিদ্দিকুর রহমান একাই নন, এ হাসপাতালের চিকিৎসাধীন রোগীদের পরীক্ষা-নিরীক্ষার জন্য হাসপাতালের বাইরে নিজেদের পছন্দমতো ডায়াগনস্টিক সেন্টারে পাঠান চিকিৎসকরা। আর এ থেকে চিকিৎসকরা পান নির্দিষ্ট কমিশন। সিদ্দিকুরের ছেলে নয়ন জানান, চিকিৎসার প্রয়োজনে রোগীর বেশির ভাগ পরীক্ষা-নিরীক্ষা চিকিৎসকদের মর্জি মতো বাইরের ল্যাব থেকেই করতে হয়। এটা এখন নিয়মে পরিণত হয়েছে। গত রবিবার দুপুরে হাসপাতালে সরেজমিন গিয়ে এ কথা জানা যায়।
হাসপাতাল সূত্র জানায়, রোগীদের বাইরে থেকে ওষুধ কেনার কারণে মেয়াদোত্তীর্ণ হয়ে প্রতিবছর বিপুল পরিমাণ ওষুধ নষ্ট হয় হাসপাতালের গুদামে। কিন্তু চিকিৎসকদের কমিশনের মনোবৃত্তির কারণে রোগীরা সরকারি হাসপাতাল থেকে পাচ্ছেন না চিকিৎসাসেবা ও সরকারি ওষুধ। জানা গেছে, বৃহত্তর ময়মনসিংহের ময়মনসিংহ, শেরপুর, জামালপুর, নেত্রকোনা, টাঙ্গাইল ও কিশোরগঞ্জ জেলার প্রায় তিন কোটি মানুষের চিকিৎসাসেবার প্রধান আশ্রয়স্থল ময়মনসিংহ মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল।
সূত্র জানায়, স্থানীয় দালালচক্র আর ওষুধ কোম্পানির প্রতিনিধিদের নিয়ন্ত্রণে রয়েছে ময়মনসিংহের এই হাসপাতাল। হাসপাতাল জুড়ে দালালদের অবাধে বিচরণ। নিজেদের খেয়ালখুশিমতো তারা হাসপাতালের রোগী পাশের ডায়াগনস্টিক সেন্টার ও ক্লিনিকগুলোতে ভাগিয়ে নেন। গত রবিবার হাসপাতালের ১২ নম্বর ওয়ার্ডে গিয়ে দেখা যায়, হাসপাতালের মেঝেতে শুয়ে আছেন শাহিদা খাতুন (৩৫)। বাড়ি ময়মনসিংহের গফরগাঁও। কালাজ্বরে আক্রান্ত হয়ে সাত দিন ধরে ভর্তি আছেন। তার ঠিক পাশ দিয়েই খাবারের সন্ধানে ঘুরে বেড়াতে দেখা গেল একটি বিড়ালকে। শাহিদার সঙ্গে থাকা স্বজনরা সেই বিড়ালটি তাড়াতে ছোটাছুটি করছেন। এ সময় হাসপাতালে চিকিৎসাধীন রোগীরা অভিযোগ করেন, এ হাসপাতালে রোগীদের বড় যন্ত্রণা দুটি। শয্যা সংকট ও বিড়াল যন্ত্রণা। কিন্তু এসব নিয়ে হাসপাতাল কর্তৃপক্ষের কোনো মাথাব্যথা নেই। ময়মনসিংহের ফুলপুর এলাকা থেকে আসা ফেলাল উদ্দিন নামের এক বৃদ্ধ রোগী বলেন, ‘ভাইয়ো এইহানে আইছুলাম চিকিৎসা নিবার, কিন্তু এইহানের ডাক্তারগণ পরীক্ষার লাইগ্যা আমায় বাইরে প্যাটাইছেন, আমায় বইল্লো এইহানে কোনো পরীক্ষা অয়না।’ ১৯৬২ সালে প্রতিষ্ঠিত এ হাসপাতালটি ৫০০ শয্যার হলেও এখানে প্রতিদিন গড়ে দুই থেকে আড়াই হাজার রোগী ভর্তি থাকে। ধারণ ক্ষমতার তিনগুণ রোগীর কারণে অনেককেই বাধ্য হয়ে হাসপাতালের মেঝেতে কিংবা বারান্দায় থাকতে হয়। হাসপাতালটির শয্যা সংকটের কথা মাথায় রেখে ৫০০ শয্যার আরেকটি নতুন ভবন নির্মাণ করা হয়। এ নতুন ভবনে আছে ১০৮টি ক্যাবিন। চিকিৎসাসেবার ক্ষেত্রে নতুন ও আধুনিক সুবিধাসম্মত এ ভবনটি এখনো পুরোপুরি চালু হয়নি। ২০১৩ সালের ৩ জানুয়ারি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা নতুন এ ভবন উদ্বোধনের পর এখন সেখানে সিসিইউ, চর্মসহ কয়েকটি বিভাগ চালু রয়েছে। বাদ বাকি সব কার্যক্রমের জন্য এখনো ভরসা হাসপাতালের পুরনো ভবনই। এ হাসপাতালের নতুন ভবন পুরোদমে চালু না হওয়ায় হাসপাতালের চিকিৎসাধীন রোগীদের অসহনীয় দুর্ভোগের মুখে পড়তে হচ্ছে। চিকিৎসাধীন রোগীদের অভিযোগ, হাসপাতালের প্রায় সব ওয়ার্ডের টয়লেট বা বাথরুম ব্যবহারের অযোগ্য। নোংরা ও গন্ধের কারণে সেখানে প্রবেশ করাই কঠিন। রাশিদা খাতুন নামে এক রোগীর স্বজন জানান, হাসপাতালের প্রধান ফটক থেকে গোটা হাসপাতালের ভেতরেই অপরিষ্কার-অপরিচ্ছন্ন পরিবেশ। দুর্গন্ধে বাথরুমে টেকা দায়। ফলে রোগীর সঙ্গে থাকতে গিয়ে স্বজনরাও অসুস্থ হয়ে পড়ছেন। খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, হাসপাতালের নিজস্ব অ্যাম্বুলেন্স থাকলেও রোগীরা নিজেদের প্রয়োজনে অ্যাম্বুলেন্স ব্যবহার করতে পারেন না। অ্যাম্বুলেন্স ব্যবহার করতে চাইলে চালকদের দিতে হয় বাড়তি টাকা। তবে এ অভিযোগ অস্বীকার করে অ্যাম্বুলেন্স চালক জামাল উদ্দিন জানান, হাসপাতালের তিনটি অ্যাম্বুলেন্স রয়েছে। এর মধ্যে দুটি সচল ও একটি বড় অ্যাম্বুলেন্স সাত থেকে আট বছর ধরে অচল। বড় ওই অ্যাম্বুলেন্সে একসঙ্গে দুজন রোগী পরিবহন করা যায়। এ অ্যাম্বুলেন্সটি মেরামত করতে হাসপাতালের পরিচালকের কাছে আবেদন করা হয়েছে। এ প্রতিবেদকের কাছ থেকে এসব অভিযোগ শুনে ময়মনসিংহ মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের পরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল ফসিউর রহমান মোবাইল ফোনে কোনো কথা বলতে চাননি।