রবিবার, ১৮ জানুয়ারি, ২০১৫ ০০:০০ টা

সাড়ে ৩ কোটি টাকার কাগজ সাড়ে ৫ কোটি টাকায় ক্রয়

সাড়ে ৩ কোটি টাকার কাগজ ৫ কোটি ৬৭ লাখ ৬৪ হাজার ৭৪৪ টাকায় কিনে চাঞ্চল্যের সৃষ্টি করেছেন সরকারের মুদ্রণ ও প্রকাশনা অধিদফতরের অধীনে থাকা বাংলাদেশ স্টেশনারি অফিসের কিছু কর্মকর্তা ও টেন্ডারবাজ। তারা এই অনিয়মের মধ্য দিয়ে অতিরিক্ত ২ কোটি ১৭ লাখ ৬৪ হাজার ৭৪৪ টাকা ভাগাভাগি করে নিয়েছেন। সরকারি অর্থের এই লুটপাটে ক্ষুব্ধ সংশ্লিষ্টরা।
স্টেশনারি অফিস সূত্রে জানা গেছে, প্রায় বছরজুড়েই তাদের কাগজ কেনার টেন্ডার দিতে হয়। চলমান প্রক্রিয়ার অংশ হিসেবেই অধিদফতরের নির্দেশে তারা ২৩ ডিসেম্বর টেন্ডারের মাধ্যমে ইন্দোনেশিয়ায় উৎপাদিত ১ লাখ ৪ হাজার ৭৩২ রিম এ-ফোর সাইজ অফসেট কাগজ কেনেন। বাজারে এই কাগজের খুচরা মূল্য প্রতি রিম ৩৫০ টাকা; অথচ কেনা হয়েছে ৪৪২ টাকা দরে।
স্টেশনারি অফিসের উপ-পরিচালক মীর নজরুল ইসলাম বলেন, ক্রয় ও বাজারদর কমিটির নির্ধারিত মূল্য অনুযায়ীই টেন্ডার সম্পন্ন হয়েছে। প্রাক্কলিত মূল্য বেশি ধরা হয়ে থাকলে সে দায় কমিটির।
টেন্ডারবাজির কৌশল : স্টেশনারি অফিসের এক কর্মকর্তা বলেন, টেন্ডারবাজির মাধ্যমে কোটি কোটি টাকা লুটপাটের পথ মুদ্রণ ও প্রকাশনা অধিদফতর থেকেই সৃষ্টি করা হয়েছে। এখানকার টেন্ডারের ক্ষেত্রে এমন সব উদ্ভট নীতি রয়েছে, যার কারণে নির্দিষ্ট কয়েক ব্যক্তিই টেন্ডারে অংশ নিতে পারেন। টেন্ডারে শর্ত জুড়ে দেওয়া হয়েছে, সরবরাহকৃত কাগজ বিদেশি ও নির্দিষ্ট ব্র্যান্ডের হতে হবে। খোঁজ নিলে বোঝা যায়, যে ব্র্যান্ডের কাগজের কথা বলা হয়েছে তা হাতে গোনা ব্যক্তি আমদানি করেন। ফলে তাদের কাছ থেকে কাগজ কেনা ছাড়া উপায় থাকে না। কাগজ উৎপাদনকারী একাধিক মিল মালিক জানান, প্রতি মাসে বাংলাদেশ থেকে কোটি কোটি টাকার উন্নতমানের কাগজ রপ্তানি হচ্ছে। অনেক দেশ বাংলাদেশে উৎপাদিত কাগজের ওপর নির্ভরশীল। অথচ সরকারি স্টেশনারি অফিসের টেন্ডারে বিদেশি কাগজের শর্ত জুড়ে দেওয়া হচ্ছে। এসব শর্ত শিথিল করা জরুরি হয়ে পড়েছে। পারটেক্স পেপার মিলসের চেয়ারম্যান আবুল হাশেম বলেন, দেশে অনেক উন্নতমানের কাগজ উৎপাদন হচ্ছে। অথচ সেসব বাদ দিয়ে সরকারি কাজে বিদেশি নিুমানের কাগজ ব্যবহার করা হচ্ছে। এই প্রবণতা দেশীয় শিল্পের উন্নয়নের জন্য বাধা। অন্যদিকে কষ্টার্জিত ডলার-পাউন্ড বিদেশে চলে যাচ্ছে। স্টেশনারি অফিসের একটি সূত্র জানায়, আগে তারা বাংলাদেশি কাগজ টেন্ডারের মাধ্যমে কিনত। কিন্তু রহস্যজনক কারণে সে প্রক্রিয়া বন্ধ করে দেওয়া হয়। এর জন্য সংস্থাপন মন্ত্রণালয়ের দুর্নীতিবাজ কিছু কর্মকর্তাকে ব্যবহার করা হয়। তাদের মাধ্যমে দেশি কাগজের পরিবর্তে বিদেশি কাগজ কেনার জন্য একটি দাফতরিক চিঠি ইস্যু করা হয়। স্টেশনারি অফিসের উপ-পরিচালক মীর নজরুল ইসলাম এ কথা স্বীকার করে বলেন, এমনকি অধিদফতরের তিনটি ছাপাখানার দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তারাও দেশি কাগজের পরিবর্তে বিদেশি কাগজের চাহিদাপত্র দেন।
নাটের গুরু বাজারদর কমিটির সদস্যসচিব সাদেক : স্টেশনারি অফিসের বিরুদ্ধে ৫ টাকার জিনিস ১০ টাকায়, ২০ টাকার জিনিস ৫০ টাকায় কেনার অভিযোগ রয়েছে অনেক। বাজারে যে কাগজ রিমপ্রতি সর্বোচ্চ ৩০০ থেকে ৩৫০ টাকা খুচরা দরে পাওয়া যায়, তারা তা টেন্ডার দিয়ে কেনেন ৫৫০ থেকে ৬০০ টাকা দরে। বিগত দিনের টেন্ডার পর্যালোচনা করলে বেশি দরে কেনার ভূরি ভূরি উদাহরণ পাওয়া যাবে। দুর্নীতিতে আকণ্ঠ নিমজ্জিত প্রতিষ্ঠানটি। আর এসবের নাটের গুরু প্রতিষ্ঠানটির ব্যবস্থাপক মো. সাদেক হাসান। ব্যবস্থাপক হয়েও তিনি সহকারী পরিচালকের দায়িত্ব পালন করছেন। স্টেশনারি অফিসের বাজারদর কমিটিরও প্রধান তিনি। তার নির্ধারিত দরের ভিত্তিতেই টেন্ডার বিবেচনা করা হয়।
ব্যবস্থাপক হিসেবে তিনি ব্যাপক ক্ষমতাধর। দেশের বাঘা বাঘা ঠিকাদার ব্যবসায়ী তার কাছে ধরনা দেন। কারণ তার ঠিক করা বাজারদরের ওপর ঠিকাদার-ব্যবসায়ীদের বাঁচামরা নির্ভর করে। গত ২৩ ডিসেম্বর ৫ কোটি ৬৭ লাখ ৬৪ হাজার ৭৪৪ টাকা মূল্যের কাগজের যে টেন্ডার হয়, তার বাজারদরও সাদেক হাসানের নেতৃত্বে ঠিক করা হয়েছিল। ফলে প্রায় ৩০ শতাংশ বেশি দামে ১ লাখ ৪ হাজার ৭৩২ রিম কাগজ কিনতে হয়েছে। এতে সরকারের ২ কোটি টাকার বেশি ক্ষতি হয়েছে। স্টেশনারি অফিসের একাধিক ঠিকাদার অভিযোগ করেন, দুটি ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান ঘুরেফিরে বিপুল পরিমাণ কাগজ সরবরাহের টেন্ডার পায়। ২৩ ডিসেম্বর কাগজের টেন্ডারে এফএফ এন্টারপ্রাইজ ২৫ ও এসএএস এন্টারপ্রাইজ ৭৫ শতাংশ কাগজ সরবরাহের কার্যাদেশ পায়। এসএএস এন্টারপ্রাইজের ঠিকাদারি লাইসেন্সটি করা হয়েছে আমলা কামালউদ্দিন তালুকদারের স্ত্রী শারমিন সুলতানার নামে। তার তদবিরেই কাগজ সরবরাহ ছাড়াও মুদ্রণ ও প্রকাশনা অধিদফতরের অনেক গুরুত্বপূর্ণ সরবরাহের কাজ পাচ্ছে ওই প্রতিষ্ঠান। সাদেক হাসান এসব টেন্ডারবাজকে পৃষ্ঠপোষকতা করছেন।
এফএফ এন্টারপ্রাইজের মালিক ফরহাদ হোসেন দীর্ঘদিন ধরে স্টেশনারি অফিসের টেন্ডারবাজির সঙ্গে জড়িত। তিনি সন্ত্রাসী দিয়ে টেন্ডার নিয়ন্ত্রণ করেন। তাকে সহযোগিতা করছে সাদেক সিন্ডিকেট। দুজনকে একই গাড়িতে চলাফেরা করতেও দেখা যায়। শুধু গাড়িতেই নয়, অনেক টেন্ডার-সন্ত্রাসীর মোটরসাইকেলের পেছনে বসে তাকে ঘুরতে দেখা যায়। বাজারদর কমিটির প্রধান মো. সাদেক হাসান তার বিরুদ্ধে উত্থাপিত অভিযোগ অস্বীকার করে বলেন, ‘কোনো অভিযোগের জবাব আপনাকে দেব না। আপনি স্টেশনারি অফিসের ওয়েবসাইট থেকে সবকিছু জেনে নেবেন।’
ইচ্ছামতো ব্যয়-প্রাক্কলন ও ব্র্যান্ড নির্ধারণ : নাম প্রকাশ না করে একজন অবসরপ্রাপ্ত কর্মকর্তা বলেন, স্টেশনারি অফিস এবং মুদ্রণ ও প্রকাশনা অধিদফতরের ক্রমবর্ধমান দুর্নীতির সূত্র ধরেই টেন্ডারবাজদের উত্থান হয়েছে। দেশি কাগজ কেনা বাধ্যতামূলক করা হলে সেখানে টেন্ডারবাজি চিরদিনের জন্য বন্ধ হয়ে যাবে। তিনি জানান, বিদেশি কাগজ হলে ইচ্ছামতো ব্যয় নির্ধারণ করা যায়। দেশি কাগজ হলে তা সম্ভব নয়।
ওই কর্মকর্তা বলেন, কাগজ কেনার প্রতিটি টেন্ডারে উদ্দেশ্যমূলকভাবে কাগজের ব্র্যান্ড উল্লেখ করা হয়। কাগজের মতো একটি সহজলভ্য পণ্যের ক্ষেত্রে কোনো ব্র্যান্ড উল্লেখ করা উচিত নয়। কারণ কাগজের টেকনিক্যাল স্পেসিফিকেশন খুব সহজলভ্য ব্যাপার হয়ে গেছে। মূলত উন্নতমানের কাগজ উৎপাদনকারীদের টেন্ডারে অংশগ্রহণ থেকে বিরত রাখার জন্যই এ ধরনের অনৈতিক বিষয় অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। মূলত বাজারদর কমিটির মাধ্যমে কোটি কোটি টাকা লুটপাটের জন্যই নিুমানের ব্র্যান্ড উল্লেখ করা হয়।
কর্মকর্তা-টেন্ডারবাজ ভাই-ভাই : স্টেশনারি অফিসে কিছু কর্মকর্তা ও টেন্ডারবাজ সমন্বয়ে সক্রিয় সিন্ডিকেটের বাইরে কেউ টেন্ডারে অংশ নিতে পারেন না বলে অভিযোগ রয়েছে। ২৩ ডিসেম্বর সিলিকোন ট্রেড ইন্টারন্যাশনালের স্বত্বাধিকারী মো. আনোয়ার হোসেন অভিযোগ করেন, তিনি ঢাকা বিভাগীয় কমিশনার অফিসে নির্দিষ্ট সময়ে টেন্ডার ড্রপ করেন। স্টেশনারি অফিসের কর্মকর্তা রুকনুজ্জামান তা গ্রহণ করেন। কিন্তু দরপত্র খোলার সময় তার দরপত্রটি না খুলে ফেরত দেওয়া হয়। তাকে কোনো কারণও জানানো হয়নি। বিজ্ঞপ্তিতে টেন্ডার জমা দেওয়ার সময় দুপুর ১২টা এবং খোলার সময় বিকাল ৩টা নির্ধারণ করা হয়েছিল। তবে তা লঙ্ঘন করে ২৩ ডিসেম্বর বেলা ২টায় একজন সহকারী পরিচালক ও ঠিকাদার কাজল দুটি টেন্ডার জমা দেন। মূলত তারাই স্টেশনারি অফিসের টেন্ডার নিয়ন্ত্রণ করেন। কেউ প্রতিবাদ করলে তাকে হুমকি দেওয়া হয়। ঠিকাদার কাজল তার বিরুদ্ধে উত্থাপিত অভিযোগ অস্বীকার করে বলেন, ‘আমি একজন তালিকাভুক্ত ঠিকাদার। এর বাইরে কোনো কর্মকাণ্ডের সঙ্গে জড়িত নই।’ নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক কয়েকজন ঠিকাদার জানান, এসব নিয়ন্ত্রণ করার কথা স্টেশনারি অফিসের নিয়ন্ত্রক সংস্থা মুদ্রণ ও প্রকাশনা অধিদফতরের মহাপরিচালকের। কিন্তু তার কোনো ভূমিকা চোখে পড়ে না। এ ব্যাপারে মহাপরিচালক বলেন, টেন্ডার করার জন্য বিভিন্ন কমিটি করে দেওয়া হয়েছে। এজন্য আলাদা করে স্টেশনারি অফিস রয়েছে। ওই অফিসেরই এসব দেখার দায়িত্ব।

সর্বশেষ খবর