শনিবার, ৩১ জানুয়ারি, ২০১৫ ০০:০০ টা

পদ্মা পাড়ে তুমুল কর্মযজ্ঞ

* চীনের ৫০০ ও তিন হাজার বাংলাদেশি শ্রমিক * নিরাপত্তায় সেনাবাহিনী * দ্রুতগতিতে চলছে সেতু নির্মাণ কাজ

পদ্মা পাড়ে তুমুল কর্মযজ্ঞ

দেশবাসীর বহুল প্রত্যাশিত ও স্বপ্নের ‘পদ্মা সেতু’ দ্রুতগতিতে ছুটে চলেছে বাস্তবায়নের দিকে। এই সেতুর নির্মাণকাজে প্রতিদিন কাজ করবেন প্রায় সাড়ে তিন হাজার শ্রমিক। পদ্মা সেতুর ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান চায়না মেজর ব্রিজের বাংলাদেশি কান্ট্রিপ্রধান মি. রেম বাংলাদেশ প্রতিদিনকে জানিয়েছেন, পদ্মা সেতুর নির্মাণকাজে প্রায় সাড়ে তিন হাজার দেশি-বিদেশি লোকবল কাজ করবে। এদের মধ্যে ৫০০ চীনা নাগরিক ও তিন হাজার বাংলাদেশি শ্রমিক-কর্মকর্তা কাজ করবেন এই বিশাল নির্মাণযজ্ঞে। ইতিমধ্যে দুই শতাধিক চীনা প্রকৌশলী, কর্মকর্তা ও শ্রমিক বাংলাদেশে পদ্মা সেতুর বিভিন্ন প্রকল্পে কাজ শুরু করে দিয়েছেন। এক প্রশ্নের জবাবে মি. রেম জানান, পদ্মা সেতুর লোহার প্লেট বা অ্যাঙ্গেল ভারত ও চীন থেকে কেনার সম্ভাবনা রয়েছে। আর ইট, সিমেন্ট, পাথর, বালুসহ অন্যান্য সামগ্রী কেনা হবে বাংলাদেশ থেকেই। তবে পদ্মা সেতু বাস্তবায়নে নিয়োজিত এক বাংলাদেশি প্রকৌশলী জানিয়েছেন, মালামাল যেখান থেকেই আনা হোক না কেন, মানসম্মত না হলে তা কর্তৃপক্ষ ব্যবহার করবে না। এসব মালামালের গুণগত মান আন্তর্জাতিক মানসম্পন্ন হতে হবে। অন্যদিকে সেনাবাহিনীর ৯৯ কম্পোজিট ব্রিগেড কমান্ডার ব্রিগেডিয়ার জেনারেল শাহ নূর জিলানী (পিএসসি) জানান, সেনাবাহিনীর ৯৯ কম্পোজিট ব্রিগেড ২০ বেঙ্গল ব্যাটালিয়ন পদ্মা সেতুর সব ধরনের নিরাপত্তার কাজ করছে। ২০০১ সালের ৪ জুলাই তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা মাওয়া ফেরিঘাট সংলগ্ন মৎস্য আড়তের কাছে দেশবাসীর বহুল প্রত্যাশিত পদ্মা বহুমুখী সেতু প্রকল্পের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করেন। এরপর রাজনৈতিক পট-পরিবর্তনে সরকার বদলের পাশাপাশি থেমে যায় পদ্মা বহুমুখী সেতু প্রকল্পের কাজ। চারদলীয় জোট সরকার ও সেনাশাসিত ফখরুদ্দীন সরকার এ নিয়ে আর তেমন এগোয়নি। ২০০৯ সালে আওয়ামী লীগ সরকার গঠনের পর আবারও পদ্মা সেতু নিয়ে তোড়জোড় শুরু করে। শুরু হয় জমি অধিগ্রহণ, ক্ষতিগ্রস্তদের ক্ষতিপূরণ ও পুনর্বাসনের কাজ। চুক্তি হয় বিশ্বব্যাংক, এডিবি, জাইকাসহ কয়েকটি আর্থিক প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে। কিন্তু মাঝপথে থেমে যায় পদ্মা সেতুর কাজ। পদ্মা সেতু থেকে মুখ ফিরিয়ে নেয় বিশ্বব্যাংক। অনেকে ধরে নিয়েছিল আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন সরকারের পক্ষে এই সেতু বাস্তবায়ন আর সম্ভব হবে না। কিন্তু ২০১৪ সালে এসে দেখা গেল পদ্মা সেতু বাস্তবায়নের কাজ আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন সরকার দেশীয় অর্থায়নে শুরু করেছে পুরোদমে। মুন্সীগঞ্জের মাওয়া এলাকা, শরীয়তপুরের জাজিরা-কাঁঠালবাড়ী এবং মাদারীপুরের কাওড়াকান্দি ঘাটসহ পদ্মার বুকে তাকালেই চোখে পড়বে পদ্মা সেতু বাস্তবায়নের বিশাল কর্মযজ্ঞ। চোখের সামনে ভেসে উঠবে স্বপ্নের পদ্মা সেতুর বাস্তব চেহারা। মুন্সীগঞ্জ-বিক্রমপুরের লৌহজংয়ের মাওয়া ও এর আশপাশে সরেজমিন ঘুরে দেখা যায়, পদ্মা সেতু নিয়ে এ এলাকায় চলছে বিশাল পরিসরে কাজ। কোথাও রাস্তা নির্মাণ, কোথাও মাটি পরীক্ষার কাজ, কোথাও নদীর ওপর প্লাটফর্ম নির্মাণ, কোথাও পাইল নির্মাণ, কোথাও ওয়ার্কশপ নির্মাণ, আবার কোথাওবা তীর থেকে ক্রেনের সাহায্যে জাহাজে মালামাল ওঠানোর কাজ। দেখলেই বোঝা যায় পদ্মা সেতুর কাজ চলছে পুরোদমে। মাওয়ায় পদ্মা সেতু নিয়ে চলছে বিশাল তৎপরতা। এ এলাকায় সেতুর নির্মাণকাজের জন্য প্রায় এক কিলোমিটার দীর্ঘ পাইল ফেব্রিকেশন ওয়ার্কশপ নির্মাণ করা হচ্ছে। মাওয়ার পাশে কুমারভোগে সেতুর কনস্ট্রাকশন ইয়ার্ডে বিশাল এই ওয়ার্কশপ নির্মাণকাজ প্রায় শেষের দিকে। এই ওয়ার্কশপে তৈরি হবে সেতুর পাইল। এই পাইলের স্টিলের প্লেট আনা হবে চীন থেকে। চীনে পরীক্ষামূলকভাবে ইতিমধ্যে শুরু হয়েছে পাইল ফেব্রিকেশন ওয়ার্কশপ। এটি পুরোটাই স্থানান্তর হবে কুমারভোগে। বিভিন্ন ওয়ার্কশপের পাশে মাল নিয়ে বড় বড় জাহাজ ভেড়ানোর সুবিধার্থে নির্মাণ করা হচ্ছে জেটি। এই জেটির জন্য চলছে কংক্রিটের পাইল তৈরির কাজ। পদ্মা সেতুর অ্যালাইনমেন্ট ইতিমধ্যে শেষ হয়েছে। এখন পুরোদমে চলছে মাটি পরীক্ষার কাজ। মাওয়া প্রান্তে মাটি পরীক্ষার কাজ শেষ হয়েছে। শুরু হয়েছে জাজিরা প্রান্তে। নদীর মাঝখানে মুন্সীগঞ্জ, শরীয়তপুর ও মাদারীপুর জেলার একটি চরের বেশ কিছু বাড়িঘর সরিয়ে ফেলা হয়েছে। এ কাজে সহযোগিতা করছেন সংশ্লিষ্ট জেলা প্রশাসকরা। এ চরের মাঝ খান দিয়ে তৈরি করা হচ্ছে একটি ক্যানেল। কয়েক দিনের মধ্যেই শেষ হবে ক্যানেল তৈরির কাজ। কারণ পানির নাব্যতা কম থাকায় ক্যানেল তৈরি না করে এখানে মাটি পরীক্ষা করা সম্ভব হচ্ছে না। তাই নদীর এই চরে ক্যানেল কেটে নদীতে ভাসমান প্লাটফর্ম থেকে এখানে পাইল নির্মাণের কাজ চলবে বলে জানিয়েছে সংশ্লিষ্ট প্রকৌশলী। এ ছাড়া ইতিমধ্যে জাজিরা প্রান্তে মাওয়ার কুমারভোগের মতো আরও একটি কনস্ট্রাকশন ইয়ার্ড নির্মাণের কাজ শুরু হয়েছে। সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা যায়, মূল সেতুর নির্মাণকাজ শুরুর জন্য এখন চলছে বিশাল কর্মতৎপরতা। সেতুর পিলারের জন্য মাটি পরীক্ষা শুরু হয়ে গেছে। ৬৬টি পিলার ধরে রাখবে ৬ দশমিক ১৫ কিলোমিটার দীর্ঘ দেশের সর্ববৃহৎ এই সেতু। প্রতি ১৫০ মিটার পর থাকবে পিলার। এর মধ্যে পানির অংশে থাকবে ৪২টি পিলার। আর দেড় কিলোমিটার করে উভয় পারে তিন কিলোমিটার সংযোগ সেতুর জন্য থাকবে ২৪টি পিলার। ৬৬ পিলারের জন্য ৬৬টি পয়েন্টে মাটি পরীক্ষার কাজ চলছে। এর মধ্যে মূল সেতুর ৪২টি পিলারের ডিজাইন করার সময় ১৩টি পয়েন্টে মাটি পরীক্ষা হয়েছে। তাই বাকি ২৯ পয়েন্টে এখন মাটি পরীক্ষা করতে হচ্ছে। মূল সেতুর ৪০টি পিলারে ছয়টি করে ২৪০টি এবং দুই পারের স্থল অংশে ১২টি করে ২৪টি, অর্থাৎ ২৬৪টি পাইল করতে হবে। এদিকে চীনের নানটংয়ের স্টিল কাটার ফেব্রিকেশন ওয়ার্কশপে ৯০ মিটার করে ১০টি পাইল নির্মিত হচ্ছে। এগুলো নির্মাণ করা হচ্ছে টেস্টিং পাইল হিসেবে। পাইলগুলো সঠিক ওজন ধারণ করতে পারে কিনা তা দেখা হবে। সঠিক ওজন ধারণ করতে পারলে চাহিদামতো আরও পাইল নির্মাণ করা হবে। শীঘ্রই এসব পাইল দেশে নিয়ে আসা হবে। প্রি-ফ্রেকেটেট স্থাপনার মালামাল মাওয়া ঘাটে পৌঁছাতে শুরু করেছে। স্থাপনাগুলো তৈরি করা হয়েছে চীনে। এখন এগুলো এনে সেতুস্থলের দুই পারে স্থাপন করা হবে। পদ্মা এখন অনেকটা শান্ত। তাই নদীতে ভাসমান বড় বড় ক্রেন কাজ করে চলেছে নির্বির্ঘ্নে। বড় আকারের ড্রেজারগুলোও তৈরি করছে কাজের ক্ষেত্র। তাই মাওয়ার যেদিকে তাকানো যায়, সেদিকেই চোখে পড়ে পদ্মা সেতু নির্মাণের দৃশ্য। ফলে স্বপ্নের এই সেতুর বাস্তবায়নের গতি দেখে মুন্সীগঞ্জসহ দক্ষিণ বঙ্গের ২৩ জেলার মানুষ বেশ খুশি। এদিকে মাওয়া ঘাটকে শিমুলিয়ায় স্থানান্তরের রাস্তা নির্মাণের প্রায় দুই কিমি. কাজ সেনাবাহিনী ইতিমধ্যে শেষ করেছে। এ ছাড়া দোগাছি সার্ভিস এরিয়া-১-এ সিমেন্ট, বালু, রড, ইট, পাথরের মান নির্ণয়ের জন্য একটি আধুনিক পরীক্ষাগারও স্থাপন করেছে সেনাবাহিনী। মূলত সেনাবাহিনীর ৯৯ কম্পোজিট ব্রিগেড ২০ বেঙ্গল ব্যাটালিয়ন পদ্মা সেতুর সব ধরনের নিরাপত্তার কাজ করছে। আর ২০ ইঞ্জিনিয়ার কনস্ট্রাকশন ব্যাটালিয়নের কর্নেল সারোয়ারের নেতৃত্বে এগিয়ে চলেছে পদ্মা সেতুর প্রায় দুই কিমি. অ্যাপ্রোচ সড়কের কাজ। পদ্মা সেতু প্রকল্পের নির্বাহী প্রকৌশলী (নদীশাসন) শারফুল ইসলাম জনান, চীনের সিনো হাইড্রো করপোরেশন লিমিটেড নামে একটি কোম্পানি পদ্মা সেতুর নদীশাসনের কাজের জন্য চুক্তিবদ্ধ হয়েছে। এখন শুধু তাদের কার্যাদেশ দেওয়া হবে। প্রায় ৮ হাজার ৭০৭ কোটি ৮১ লাখ টাকা ব্যয়ের নদীশাসনের এ প্রকল্পে মাওয়া প্রান্তে প্রায় দুই কিমি. ও জাজিরা প্রান্তে প্রায় ১২ কিলোমিটার নদীশাসনের কাজ চলছে। তবে পানি উন্নয়ন বোর্ড (পাউবো) মাওয়া প্রান্তে আরও চার থেকে ছয় কিমি. নদীশাসনের কাজ করবে। ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান চায়না মেজর ব্রিজের নিয়োগকৃত পদ্মা সেতুর মালামালের লজিস্টিক ক্লিয়ারিং অ্যান্ড ফরোয়ার্ডিং এজেন্ট এসআই চৌধুরী অ্যান্ড কোম্পানি লিমিটেডের (সিকো গ্রুপ) নির্বাহী পরিচালক আলী আহমেদ জানান, চীন থেকে এ পর্যন্ত পদ্মা সেতুর চারটি শিপমেন্টে মালামাল দেশে এসেছে। বড় আকারের দুটি ফ্লোটিং ক্রেন, দুটি টাক বোট, একটি অ্যাংকর বোট এবং তিনটি বিশাল আকারের কাটিং ড্রেজারসহ ভারী যন্ত্রপাতির সঙ্গে প্রয়োজনীয় ড্রেজিং পাইপসহ আনুষঙ্গিক যন্ত্রপাতিও মাওয়ায় পৌঁছে কাজ শুরু করেছে। এ ছাড়া মাটি পরীক্ষার ছোট আকারের চার সেট গুরুত্বপূর্ণ যন্ত্রপাতি ও কেমিক্যাল বিমানে চীন থেকে হজরত শাহজালাল (রহ.) বিমানবন্দর হয়ে মাওয়ায় এসেছে। এখন মূল সেতুর কাজ শুরু হওয়া শুধু সময়ের ব্যাপার।
বিশাল এ সেতু প্রকল্পের নির্বাহী প্রকৌশলী (পুনর্বাসন প্রকল্প) মো. তোফাজ্জেল হোসেন বাংলাদেশ প্রতিদিনকে জানান, পদ্মা সেতু প্রকল্পের জন্য ১১০০ হেক্টরেরও বেশি জমি অধিগ্রহণ করা হয়েছে। এর মধ্যে মাওয়া প্রান্তের যশলদিয়া ও কুমারভোগ পুনর্বাসন প্রকল্পসহ দুটি অতিরিক্ত পুনর্বাসন কেন্দ্রের জন্য অধিগ্রহণ করা হয়েছে ৩০.০৮ হেক্টর জমি। এসব পুনর্বাসন কেন্দ্রে ৯৯৮টি প্লট তৈরি করা হয়েছে। এর মধ্যে ৪৫০টি প্লট ইতিমধ্যে বিলি করা হয়েছে ক্ষতিগ্রস্ত ভূমির মালিকদের মধ্যে। বাকিগুলো বিলির প্রক্রিয়াধীন। সব মিলিয়ে স্বপ্নের এই সেতুকে নিয়ে পদ্মায় ও এর পারে চলছে মহোৎসব। সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের ও নৌপরিবহনমন্ত্রী মো. শাজাহান খান পদ্মা সেতু নিয়ে তৎপর রয়েছেন। প্রায়ই তারা পরিদর্শনে এসে পদ্মা পারের এই বিশাল কর্মযজ্ঞের খোঁজ নিচ্ছেন। এরই মধ্যে মাওয়ার সার্কিট হাউসে সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের স্থানীয় সাংবাদিকদের কাছে তার প্রতিক্রিয়া জানাতে গিয়ে বলেন, ‘পদ্মা সেতু বাস্তবায়নের জন্য প্রয়োজনে পদ্মা পারে পাটি বিছিয়ে বসে থাকব। এর পরও পদ্মা সেতু বাস্তবায়ন দেখতে চাই।’ এ সময় মন্ত্রী ঘোষণা দেন, ২০১৮ সালেই চালু হবে স্বপ্নের পদ্মা সেতু। যানবাহনের পাশাপাশি চলবে ট্রেন।

সর্বশেষ খবর