শনিবার, ৩১ জানুয়ারি, ২০১৫ ০০:০০ টা

এ কেমন বিদেশ যাত্রা!

ধরাছোঁয়ার বাইরে মানব পাচার চক্র

এ কেমন বিদেশ যাত্রা!

কুতুবদিয়ায় ডুবে যাওয়া ট্রলার গতকাল উদ্ধার করা হয়- বাংলাদেশ প্রতিদন

বেশ কিছু দিন ধরে দালালচক্র অবৈধভাবে মালয়েশিয়া যাওয়ার অঘোষিত আন্তর্জাতিক বন্দর হিসেবে ব্যবহার করছে টেকনাফের নাফ নদী ও বঙ্গোপসাগরের বিভিন্ন পয়েন্টকে। প্রতি বছর শীত মৌসুমে দালালরা মানব পাচার শুরু করে। চক্রটি ফিশিং ট্রলারে ধারণ ক্ষমতার বেশি যাত্রী, অপর্যাপ্ত খাদ্য ও অদক্ষ মাঝি দিয়ে অসংখ্য মানুষের জীবন ঠেলে দিচ্ছে চরম ঝুঁকিতে। রাজনৈতিকভাবে প্রভাবশালী একটি চক্র উঠতি বয়সী সহজ-সরল যুবকদের চোখে রঙিন স্বপ্ন এঁকে দিয়ে সোনার হরিণ ধরার প্রলোভন দেখিয়ে স্বপ্নের দেশ মালয়েশিয়ায় পৌঁছানোর নাম করে সর্বস্বান্ত করে আখের গুছিয়ে নিচ্ছে। বছরের পর বছর ধরে চলছে এ অবস্থা। বছর খানেক আগেও দালালদের টার্গেট ছিল রোহিঙ্গা ও কক্সবাজার জেলার বিভিন্ন মানুষ। বর্তমানে তাদের নেটওয়ার্ক দেশের উত্তরবঙ্গ থেকে শুরু করে আনাচে-কানাচে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে রয়েছে। পুলিশ, বিজিবি, কোস্টগার্ড, নৌবাহিনীর পৃথক অভিযানে গত এক বছরে ১৮৩৫ মালয়েশিয়াগামী আটক হয়েছে, এদের অধিকাংশই উত্তরবঙ্গের। এদিকে, বঙ্গোপসাগরের কুতুবদিয়ার দক্ষিণে খুদিয়ার টেক চ্যানেলে বুধবার মধ্যরাতে ৭০-৮০ জন যাত্রী নিয়ে অবৈধভাবে মালয়েশিয়া যাওয়ার পথে ডুবে যায় এমভি ইদ্রিস নামের একটি ট্রলার। এ ট্রলারডুবির ঘটনায় গতকাল বিকাল পর্যন্ত নয় জনের মৃতদেহ উদ্ধার হয়েছে। এ ঘটনায় ১১ জনের বিরুদ্ধে মামলা করেছে পুলিশ। ট্রলার ডুবিতে ৪৩ জন উদ্ধার হলেও অনেক যাত্রী নিখোঁজ রয়েছেন। এরপরও জীবনের ঝুঁকি নিয়ে মালয়েশিয়া যাত্রা থামছে না। উদ্ধারকৃত যাত্রীদের অভিযোগ, ট্রলারে অতিরিক্ত যাত্রীবোঝাই করা হয়েছিল। অনুসন্ধানে জানা যায়, অনিশ্চিত জীবিকার জন্য কত মানুষ মালয়েশিয়া যেতে সাগরে নেমেছিল, কতজন মানুষ মালয়েশিয়ায় পৌঁছেছে, আর কত মানুষ সাগরে মৃত বা জীবিত ভাসছে- এ তথ্য কারও জানা নেই। ওদের খবর এখনো কেউ জানে না। ধারণা করা হচ্ছে, বিশাল ঢেউয়ের আছড়ে কূল-কিনারাহীন হয়ে তারা অনেকটা মৃত্যুর মুখোমুখি দাঁড়িয়ে আছে। অভাব-অনটনের বোঝা সইতে না পেরে বহু অসহায় মানুষ, স্বপ্নের সোনার হরিণের খোঁজে এখন উত্তাল সাগরে। প্রবাসে গিয়ে পরিবারের অভাব গোছাবে বলে তারা এ পথকে বেঁচে নেয়। কিন্তু পাচারচক্রের বিশাল সিন্ডিকেট চক্রের চতুর্মুখী প্রতারণায় বন্দী এসব মানুষ এখন সাগরে বিশাল ঢেউয়ের ভয়ঙ্কর আঘাতে নিজের প্রাণটি হারাতে বসেছে। এদিকে পরিবারের একমাত্র রোজগারের লোকটিকে হারিয়ে নিঃস্ব হয়ে পড়েছে অনেকে। বাবাকে অনেকদিন না দেখায় কাঁদছে ছোট্ট আদরের মেয়েটি। একদিকে স্বজন হারানোর বেদনা, ঘরের চুলায় আগুন নেই, অন্যদিকে অবৈধভাবে যাওয়ার চেষ্টার অপরাধে আইনি লোকজনের তল্লাশি। অবৈধভাবে মালয়েশিয়া যাত্রা বন্ধ হবে কী? মানব পাচারকারীরা কি ধরাছোঁয়ার বাইরে থেকে যাবে। প্রতিনিয়ত আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর হাতে আটক হচ্ছে দালালের খপ্পরেপড়া সহজ-সরল ও নিরীহ যুবকরা। আইন প্রয়োগকারী বিভিন্ন সংস্থার অভিযান চলে এবং ধরা পড়ে মাঠপর্যায়ের কর্মচারী কিংবা দালাল গোছের কেউ, কিন্তু নেপথ্যের গডফাদাররা আড়ালেই রয়ে যায়। দালালদের বিরুদ্ধে মামলা হলেও প্রকৃতপক্ষে কোনো চিহ্নিত দালালকে এ পর্যন্ত আটক করতে পারেনি পুলিশ। পুলিশের দাবি মালয়েশিয়াগামী যাত্রীরা প্রতারণার শিকার! স্থানীয় সচেতন মহল অবৈধপথে মালয়েশিয়াগামী যাত্রীরা প্রতারণার শিকার তা মানতে নারাজ। সচেতন মহল মনে করে, এসব যাত্রী অবৈধ উপায়ে সমুদ্রপথে মালয়েশিয়া যাওয়ার জন্য টাকার বিনিময়ে চুক্তিবদ্ধ হয়ে কাঠের বোটে করে মালয়েশিয়া গমন করে। কিন্তু পথিমধ্যে প্রশাসনের হাতে আটক হলে তাদের প্রতারণার শিকার হিসেবে গণ্য করা হয়। মালয়েশিয়াগামী যাত্রীদের স্বীকারোক্তি মতে, যেসব দালালের বিরুদ্ধে মামলা হচ্ছে, তারা কি দেশে বসবাস করছে না, নাকি তাদের হাত প্রশাসনের চেয়ে লম্বা? দালালরা প্রশাসনকে মাসোহারা দিয়েই বীরদর্পে চালিয়ে যাচ্ছে তাদের এই পেশা। প্রশাসনের গাফিলতির কারণে প্রতিনিয়ত মানুষ অসাধু উপায় অবলম্বন করছে। এতে বহির্বিশ্বে বাংলাদেশের শ্রমবাজার হাতছাড়া হওয়ারও আশঙ্কা রয়েছে। টেকনাফ ৪২ বিজিবির অধিনায়ক লে. কর্নেল আবুু জার আল জাহিদ বলেন, অবৈধভাবে মালয়েশিয়াগামীদের আটক করে থানা-পুলিশে সোপর্দ করে জড়িত দালালের বিরুদ্ধে মামলা করছি। এরপর দোষীদের আইনের কাঠগড়ায় দাঁড় করানো থানা-পুলিশের দায়িত্ব।

সর্বশেষ খবর