শুক্রবার, ৮ মে, ২০১৫ ০০:০০ টা
ঐতিহ্য

জগদল বিহারে প্রাচীন সভ্যতার নিদর্শন

জগদল বিহারে প্রাচীন সভ্যতার নিদর্শন

নওগাঁর সীমান্তবর্তী ধামইরহাট উপজেলার জগদল মৌজায় খননকাজ চলছে। এরই মধ্যে এ বিহারভূমি থেকে বেরিয়ে এসেছে প্রাচীন সভ্যতার নানা নিদর্শন। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, খনন চালিয়ে যেতে পারলে বেরিয়ে আসতে পারে ইতিহাসের আরও অনেক সম্ভার। প্রত্নতত্ত্ব অধিদফতরের তত্ত্বাবধানে গত ডিসেম্বর থেকে খননকাজ চলছে। তবে তা অব্যাহতভাবে চালিয়ে যাওয়া হচ্ছে না। থেমে থেমে কাজ চলছে। তবে এ চার মাসে বিহারের মাটির ঢিবির নিচ থেকে বেরিয়ে এসেছে আদিম সভ্যতার ঐতিহাসিক নানা নিদর্শন। পাওয়া গেছে বুদ্ধমূর্তি, বিভিন্ন প্রাচীন মূর্তি ও বিশাল আকারের কালো পাথর, গ্রানাইট পাথর, বিভিন্ন ধরনের মৃৎপাত্রের ভগ্নাংশ।
নির্ভরযোগ্য তথ্যসূত্র ও ইতিহাসবিদ আবুল ফজলের লেখা ‘আইন-ই-আকবরী’ গ্রন্থ থেকে জগদল বিহার সম্পর্কে জানা যায়, একাদশ খ্রিস্টাব্দের শেষের দিকে এ জনপদে বসবাস করতেন প্রভাবশালী হিন্দু জমিদাররা। রামপালের গৌড় রাজা বিহারটি অন্য এক রাজার কাছ থেকে পুনরুদ্ধার করেন। রামাবতী নগর নামে রাজধানী স্থাপন করেন। এ রামাবতীর উপকণ্ঠেই তিনি জগদল বিহারটি স্থাপন করেন। সূত্র জানায়, কালের পরিক্রমায় এ বিহারটি ধ্বংস হয়ে যায়। এরপর ১৯৯৬ থেকে ২০১৪ সাল পর্যন্ত মোট চার দফা খনন করা হয়েছে, যার ভিতর দিয়ে দেখা যায়, মাঝখানে রয়েছে ছাদবিহীন চাতাল এবং চারটি বাহুতে সারি সারি অপরিসর প্রকোষ্ঠ। উত্তর বাহু এখনো অন্তরিত অবস্থায় রয়েছে। দক্ষিণ ও পশ্চিম বাহুতে প্রকোষ্ঠের সংখ্যা আটটি এবং পূর্ব বাহুতে নয়টি অনুমিত রয়েছে। পশ্চিমের বাহুতে প্রকোষ্ঠ ছাড়াও ঠিক মাঝামাঝি অংশে চত্বর ও পেছন দিকে প্রসারিতভাবে একটি প্রধান মূর্তি কোঠা রয়েছে। আর এ বৈশিষ্ট্যের ওপর নির্ভর করে এ স্থাপনাকে বাংলাদেশের সবচেয়ে প্রাচীন পঞ্চায়তন মন্দির নিদর্শন বলে গণ্য করা হয়। পঞ্চায়তন মন্দিরটির গবরাট, সরদল, দরজার বাজুবন্ধ প্রভৃতি অংশে প্রচুর পালিশকৃত কালো পাথর ব্যবহৃত হয়েছে। এগুলোয় নানা ধরনের রূপচিহ্ন ও দেবদেবীর (দ্বারপাল, অপ্সরা, বোধিসত্ত্ব ও তথাগত) উৎকীর্ণ রয়েছে। অন্যান্য পুরাবস্তুর মধ্যে রয়েছে পোড়ামাটির ফলক, মৃৎপাত্র, পোড়ামাটির গোলক, কারুকাজ করা ইট প্রভৃতি। এ মহাবিহারের প্রধান উপাস্য দেবতা ছিলেন অলোকিতেশ্বর।
এ ছাড়া এ প্রত্নস্থলে মাত্র ৩০০ মিটার পুব দিক দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে কাট্টা নামের একটি মৃতপ্রায় নদী এবং আড়াই কিলোমিটার ব্যাসার্ধের মধ্যে ছড়িয়ে আছে বিভিন্ন মাপের প্রচুর দিঘি ও ঢিবি। দিঘিগুলোর মধ্যে কয়েকটির নাম হলো টোককামারি, গচতার, লালগর, দিগুরদিঘি ও ঐতিহাসিক আলতাদিঘি। পার্শ^বর্তী দক্ষিণের গ্রাম চান্দর এবং আড়ানগরেও অনুরূপ বৈশিষ্ট্য লক্ষ্য করা যায়। এসব গ্রাম থেকে সংগৃহীত প্রচুর পুরাবস্তু রাজশাহীর বরেন্দ্র জাদুঘরে সংরক্ষিত রয়েছে। জগদল বিহারের নাম বাংলাদেশ তথা বিশ্বের সপ্তাশ্চর্যে ছড়িয়ে পড়লেও দ্বিতীয়টি নানা কারণে পরিচিতি পায়নি। তৎকালীন রামপালের গৌড় রাজা রামাবতী নগরে একটি মন্দির তৈরি করেন, যা বাঙালির শিক্ষা গ্রহণের অন্যতম কেন্দ্রবিন্দু ছিল। সূত্র জানায়, তথ্যবিভ্রাটের কারণে অনেকে জগদল বিহারটি দিনাজপুর জেলায় উল্লেখ করলেও প্রকৃতপক্ষে এটি নওগাঁয় অবস্থিত। জগদল বিহারের আর একটি নাম রামৌতি। এ বিষয়ে প্রত্নতত্ত্ব অধিদফতরের দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তা ও ঐতিহাসিক পাহাড়পুর বৌদ্ধ বিহারের কাস্টডিয়ান মাহবুব-উল-আলম বলেন, জগদল বিহারের চারপাশ ও আশপাশে বড় বড় অনেক মাটির ঢিবি রয়েছে। এগুলোয় অব্যাহতভাবে খননকাজ চালিয়ে যেতে পারলে বৌদ্ধদের আরও অনেক নিদর্শন আবিষ্কার হতে পারে। দেশে এখন পর্যন্ত এ ধরনের যত নিদর্শন পাওয়া গেছে তার মধ্যে জগদল বিহারেই সর্বাধিক কালো ও গ্রানাইট পাথর মিলেছে।

সর্বশেষ খবর