রবিবার, ৬ সেপ্টেম্বর, ২০১৫ ০০:০০ টা

ঢাকায় সৌমিত্রের আড্ডা

বাংলা ভাষা ভুলে যাচ্ছে তরুণরা

নিজস্ব প্রতিবেদক

ঢাকায় সৌমিত্রের আড্ডা

কলকাতার প্রখ্যাত অভিনেতা সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায় বলেছেন, কলকাতার তরুণরা বাংলা ভুলে যেতে বসেছে। তারা অদ্ভুত এক মিশ্র ভাষায় কথা বলছে। তিনি বাংলাদেশের তরুণদের বাংলা ভাষাকে বাঁচিয়ে রাখার আহ্বান জানান।
দুই বাংলার ‘গঙ্গা-যমুনা’ শীর্ষক নাট্য ও সাংস্কৃতিক উৎসবের উদ্বোধন করতে ঢাকায় আসেন ৮০ বছরের এই অভিনেতা ও আবৃত্তিকার। গতকাল উদ্বোধন পর্ব শেষে তিনি তার নাটকের দল সংস্তব-এর প্রযোজনায় ‘ছাড়িগঙ্গা’ নাটকে অভিনয় করেন। এর আগে তিনি ৪ সেপ্টেম্বর সকালে ভারত থেকে ঢাকা আসেন এবং ওই দিন সন্ধ্যায় শিল্পকলা একাডেমিতে নয় দিনব্যাপী গঙ্গা-যমুনা নাট্য উৎসবের উদ্বোধন করেন। উৎসবের দ্বিতীয় দিন গতকাল সকালে গণমাধ্যমকর্মীদের সঙ্গে আলাপচারিতায় কলকাতা ও বাংলাদেশের সাংস্কৃতিক কার্যক্রম ও সংস্কৃতি বিনিময়ের বিভিন্ন বিষয় তুলে ধরেন তিনি। এ আলাপচারিতার আয়োজন করে গঙ্গা-যমুনা নাট্য ও সাংস্কৃতিক উৎসব পর্ষদ। সকাল সাড়ে ১০টায় শিল্পকলা একাডেমির সেমিনার কক্ষে এ আলাপচারিতা শুরু হওয়ার কথা থাকলেও নির্ধারিত সময়ের কিছুক্ষণ আগেই সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায় অনুষ্ঠানস্থলে এসে সবাইকে তাক লাগিয়ে দেন। সেমিনার কক্ষে প্রবেশ করা মাত্রই সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায় বললেন, ‘সুপ্রভাত! আপনাদের এখানে এলেই মনটা ভালো হয়ে যায়। এ লোভেই হয়তো বার বার আসি।’ এ সময় উপস্থিত সবাই দাঁড়িয়ে করতালির মাধ্যমে তাকে স্বাগত জানান। নিজের সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ড সম্পর্কে সৌমিত্র বলেন, শৈশব থেকে কলকাতায় বিখ্যাতদের অভিনয় দেখতাম। শিশিরকুমার ভাদুড়ির অভিনয় দেখে বিদ্যুৎস্পৃষ্ট হয়েছিলাম একবার। এরপর তার সংস্পর্শে তিন বছর আসার সুযোগ হয়েছিল। থিয়েটার নিয়ে আমার চিন্তা-ভাবনার ভিত তৈরি হয়েছিল এখান থেকেই। সত্যজিৎ রায় তখন ‘পথের পাঁচালি’ তৈরি করেছেন। এর সিকুয়াল ‘অপরাজিতা’ তৈরি করবেন তিনি। তার এক সহকারীর কাছে শুনেছিলাম এসব। তিনি একদিন সত্যজিৎ রায়ের বাসায় নিয়ে যান। উনি দেখামাত্র আমাকে বলেন, তুমি তো বড় হয়ে গেছ। আমি তখন অল ইন্ডিয়া রেডিওতে কাজ করি। সত্যজিৎ রায় তৃতীয় সিকুয়াল ‘অপুর সংসার’ বানাবেন। আমার সঙ্গে যোগাযোগ করলেন। ‘জলসাঘর’ ও ‘পরশপাথর’ ছবির শুটিং দেখতে বললেন। একদিন সত্যজিৎ রায় আমাকে নামকরা অভিনেতা ছবি বিশ্বাসের কাছে নিয়ে যান। তাকে বলেন, এ হচ্ছে অপুর সংসারের অপু। এভাবেই শুরু। তারপর ৫৫ বছর ধরে টিকে আছি। অভিনয়ে নিজেকে আড়াল করা যায়। তাই নিজেকে আড়াল করার জন্যই অভিনয়ে আসা। অভিনয় ও আবৃত্তির পাশাপাশি কৈশোর থেকে কবিতাও লিখতেন সৌমিত্র। এ প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ওই বয়সে মেয়েদের ভালোলাগার ব্যাপারটা শুরু হয়। এরপর বিশেষ মেয়েকে ভালোলাগার ব্যাপার থাকে। তখন তো একটু হাত ধরতেও কত অপেক্ষা করতে হতো। নিজের কথা যেখানে বলা যাচ্ছে না তার একটা উপায় হিসেবেই কবিতা লেখার শুরু। কলকাতা ও বাংলাদেশের নাটকের তুলনামূলক পার্থক্য সম্পর্কে তিনি বলেন, কলকাতার নাটকের অবনমন হয়েছে খানিকটা। তবু সেখানে বছরে একটা-দুটো ভালো কাজ হয়। সিনেমারও একই অবস্থা ছিল। এখন নতুন করে ঘুম ভাঙছে। আগে থেকেই বাংলাদেশ সম্পর্কে আমাদের আগ্রহ ছিল। একটি জাতিকে অনেক মূল্য দিয়ে মুক্তি পেতে হয়েছিল। কলকাতায় এখন সবকিছু নষ্ট হয়ে যাচ্ছে। সেখানকার রাজনীতিতে নোংরা জলুস আছে। তরুণরা বাংলা ভুলে যাচ্ছে, মিশ্র ভাষায় কথা বলছে। না বাংলা, না হিন্দি, না ইংলিশ। বাঙালি জাতিসত্তাকে আপনারা ধরে রেখেছেন, বাঁচিয়ে রাখবেন। নাটকে পেশাদারিত্বের বিষয়ে প্রশ্ন করা হলে ওপার বাংলার কিংবদন্তি এই অভিনেতা ও আবৃত্তিকার বলেন, কলকাতার নাটকে পেশাদারিত্বের ইতিহাস শত বছরের বেশি। যখন প্রফেশনালিজম আর কমার্শিয়ালিজম গুলিয়ে ফেলা হলো, তখন থেকেই এর অবনমন শুরু হয়েছে। অভিনয় হোক আর যে কোনো মাধ্যমই হোক, সবখানেই কমিটমেন্ট আর প্রফেশনালিজম দরকার। একজন ভালো অভিনয়শিল্পীর কী কী গুণাবলি থাকা দরকার- এমন প্রশ্নের উত্তরে তিনি বলেন, অভিনেতার কাছে মানুষ বিষয়, সমাজ বিষয়। যে অভিনেতা শুধু আত্মপ্রদর্শন করে তাকে আমার বড় অভিনেতা মনে হয় না। বড় অভিনেতা তার অভিনয়ে সমাজের বিভিন্ন অনুষঙ্গ দেখায়। কণ্ঠ ও জিহ্বা দিয়ে কাজ করাই অভিনয়ের প্রথম শর্ত। অভিনেতার যদি বাচিক উৎকর্ষ না থাকে তাহলে কিছুই হবে না। আর সবচেয়ে যেটা প্রয়োজন সেটা হলো ভালোবাসা। আবৃত্তি প্রসঙ্গে সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায় বলেন, বাচিকশিল্পে রবিঠাকুরের কাছেই তার ‘ঋষিঋণ’। তিনি বলেন, রবীন্দ্রনাথের কণ্ঠ নিয়ে আমার পরিবারেও নানা কথা হতো। যেহেতু তার কণ্ঠে আবৃত্তির রেকর্ডিংগুলো বেশ খারাপ মানের ছিল। তবে দেশের বাইরে যে দু-একটা রেকর্ডিং আছে তা শুনেই বুঝেছি তার কণ্ঠে কী গভীরতা ছিল। বাংলা চলচ্চিত্রের বর্তমান অবস্থা সম্পর্কে সৌমিত্র বলেন, ২০ বছর ধরে একটি সিনেমাও কোনো বড় চলচ্চিত্র উৎসবে পুরস্কার পায়নি। তবে সিনেমায় যে অনুকরণ চলে আসছিল তা অনেকখানি কমেছে। ভালো অভিনয়ের প্রস্তুতি সম্পর্কে সৌমিত্র বলেন, অভিনয়টা মানুষ করতে করতেই শেখে। ৫৫ বছর অভিনয় করার পর এখন একটু-আধটু বলতে পারি, কিছুটা পেরেছি। একজন মানুষকে হয়তো কিছু মৌলিক জ্ঞান দেওয়া যেতে পারে, তবে সবকিছুই নির্ভর করবে নিজের ওপর। যে চিত্রকর ছোট ক্যানভাসে মানুষ আঁকতে পারেন, তিনি বড় ক্যানভাসেও মানুষ আঁকতে পারেন। ভিতরে ভালোবাসা না থাকলে শিল্পের কোনো মাধ্যমেই খুব বেশি কিছু করা যায় না। আলাপচারিতা শেষে জীবন্ত কিংবদন্তি এ অভিনতা ও বাচিকশিল্পীকে নানা ধরনের উপহার প্রদান করেন নাট্যাঙ্গনের সঙ্গে সংশ্লিষ্টরা। উপহারের মধ্যে বইয়ের প্রাধান্যই ছিল বেশি। এ সময় জনপ্রিয় এ অভিনয়শিল্পীর সঙ্গে ছবি তুলতে ও অটোগ্রাফ নিতেও ব্যস্ত হয়ে পড়েন নাট্যকর্মীরা। গতকাল রাতেই সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায় পশ্চিমবঙ্গের উদ্দেশে ঢাকা ত্যাগ করেছেন। প্রসঙ্গত, প্রায় ছয় দশকের অভিনয় জীবনে সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায় কাজ করেছেন পশ্চিমবঙ্গের চলচ্চিত্র, মঞ্চ ও টিভি নাটকে। এ ছাড়া বাচিকশিল্পেরও একজন জনপ্রিয় মানুষ তিনি। ১৯৫৯ সালে সত্যজিৎ রায়ের ‘অপুর সংসার’ ছবির মাধ্যমে অভিনয়ে আসেন। সত্যজিতের ৩৪টি চলচ্চিত্রের মধ্যে ১৪টিতেই অভিনয় করেছেন তিনি। তার অভিনীত চরিত্রগুলোর মধ্যে সবচেয়ে জনপ্রিয় ‘ফেলুদা’।

ঢাকায় সৌমিত্রের আড্ডা
বাংলা ভাষা ভুলে যাচ্ছে তরুণরা
- See more at: http://www.bd-pratidin.com/last-page/2015/09/06/104696#sthash.isgpWDyR.dpuf

সর্বশেষ খবর