শুক্রবার, ২০ নভেম্বর, ২০১৫ ০০:০০ টা

চিকিৎসার বদলে বিড়ম্বনা নওগাঁ সদর হাসপাতালে

বাবুল আখতার রানা, নওগাঁ

চিকিৎসার বদলে বিড়ম্বনা নওগাঁ সদর হাসপাতালে

নওগাঁ সদর হাসপাতালে শয্যা, ডাক্তার, নার্স ও প্রয়োজনীয় যন্ত্রপাতির অভাবে চিকিৎসাসেবায় দারুণ সংকট চলছে। ৫০ থেকে ১০০ শয্যায় উন্নীত করা হলেও আগের লোকবল দিয়েই চলছে কাজকর্ম। ফলে চিকিৎসাসেবার বিপরীতে বিড়ম্বনার শিকার হচ্ছেন রোগী ও তাদের লোকজন।

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, জেলার ২৮ লাখ মানুষ চিকিৎসার জন্য ‘আধুনিক’ এই সদর হাসপাতালে আসেন। এর মধ্যে প্রতিদিন গড়ে ৬০০ থেকে ৬৫০ জন রোগী বহির্বিভাগে টিকিট কাটেন। কিন্তু চিকিৎসকের অভাবে রোগীদের ঘণ্টার পর ঘণ্টা অপেক্ষা করতে হয়। অনেকে চিকিৎসা না নিয়েই বাড়ি ফিরে যান। ১০০ শয্যাবিশিষ্ট এই হাসপাতালে চিকিৎসকের পদ ৪২ জন থাকলেও কর্মরত রয়েছেন ৩০ জন। অনেক রোগীকে মেঝে ও বারান্দায় শুয়ে চিকিৎসা নিতে হয়। বর্তমানে হাসপাতালে সিনিয়র কনসালটেন্ট ১০ জনের স্থলে রয়েছেন ৬ জন, জুনিয়র কনসালটেন্ট ১১ জনের স্থলে রয়েছেন ৬ জন, গাইনি কনসালটেন্ট ২ জনের স্থলে রয়েছেন মাত্র ১ জন, সহকারী সার্জন ১৭ জনের স্থলে রয়েছেন ১৪ জন। এ ছাড়া স্কিন কনসালটেন্ট, রেডিওলজি কনসালটেন্ট, ফরেনসিক কনসালটেন্ট, মানসিক কনসালটেন্ট, চর্ম ও যৌন কনসালটেন্ট, নেফ্রলজি কনসালটেন্ট পদে কোনো বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক বা পরামর্শক নেই। অন্যদিকে হাসপাতালে মেডিসিন পরামর্শক পদে দীর্ঘদিন কোনো চিকিৎসক না থাকায় হƒদরোগ ও মস্তিষ্কে রক্তক্ষরণসহ জটিল রোগে আক্রান্ত রোগীকে রাজশাহী, ঢাকা ও বগুড়ায় স্থানান্তর করা ছাড়া কোনো উপায় থাকে না। অন্তর্বিভাগে রোগীর সংখ্যা বাড়লেও সেবিকাদের সংখ্যা বাড়েনি। দীর্ঘদিন ধরে দ্বিতীয় শ্রেণির কর্মচারী (নার্স) ৪২ জনের স্থলে রয়েছেন ৩৮ জন, তৃতীয় শ্রেণির কর্মচারী ৩৫ জনের স্থলে রয়েছেন মাত্র ২২ জন, চতুর্থ শ্রেণির কর্মচারী ৩৬ জনের স্থলে রয়েছেন মাত্র ২৯ জন ও সুইপারের সংখ্যা মাত্র ৫ জন। হাসপাতালে রয়েছে সেকেলের একটি পোর্টেবল এক্সরে মেশিন। এ মেশিন দিয়ে কোমর ও জটিল কোনো এক্সরে করানো সম্ভব হয় না। এসব রোগীকে যেতে হয় রাজশাহী ও বগুড়ায়। তাই এখানে একটি আধুনিক ৫০০ এমএম এক্সরে মেশিন জরুরি হয়ে পড়েছে। প্রি-মাচিউর শিশুর চিকিৎসা দেওয়ার ইনকিউবেটরটি দীর্ঘদিন ধরে নষ্ট হয়ে পড়ে আছে। ফলে ওই সব শিশু চিকিৎসাসেবা পাচ্ছে না। সবচেয়ে জরুরি ইমারজেন্সি মেডিকেল অফিসার পদটিও শূন্য। এই হাসপাতালে কেবিন রয়েছে মাত্র ৮টি। অভিযোগ পাওয়া গেছে, অনিয়োগপ্রাপ্ত জনবলে ভরে গেছে এই হাসপাতাল। এসব জনবল মানুষের উপকারের পরিবর্তে ভোগান্তির কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। কেননা এদের বেশির ভাগই বাইরের ক্লিনিক ও চিকিৎসকদের দালাল হিসেবে কাজ করে থাকেন। বিশেষ করে গ্রামাঞ্চল থেকে সেবা নিতে আসা রোগীদের হাসপাতালে চিকিৎসাসেবা নেওয়ার পরিবর্তে তারা তাদের পাঠিয়ে দেন মনোনীত ক্লিনিক ও ডাক্তারদের কাছে। ট্রলিতে রোগী বহন করলেও দিতে হয় বাড়তি টাকা। জানা গেছে, আবদুল জলিল মৃত্যুর আগে হাসপাতালটিতে স্থাপন করা হয় আবদুল জলিল হোমো ডায়ালাইসিস ইউনিট। যেখানে অর্থায়ন করেছিল মার্কেন্টাইল ব্যাংক। কিন্তু ৫ বছর অতিবাহিত হলেও আজ পর্যন্ত সরকারের সঙ্গে এমওইউ অর্থাৎ সমঝোতা স্মারক হয়নি। গত ২০১৪ সালের নভেম্বরে বর্তমান সরকারের স্বাস্থ্যমন্ত্রী মোহাম্মদ নাসিম হাসপাতাল পরিদর্শনে এসে সমঝোতা স্মারকের উদ্যোগের কথা বললেও হাসপাতাল কর্তৃপক্ষের উদাসীনতায় তা আজও সম্পন্ন হয়নি। এতে করে কোটি টাকার রাজস্ব থেকে বঞ্চিত হচ্ছে সরকার।

হাসপাতালে চিকিৎসা নিতে আসা আত্রাই উপজেলার হাটকালুপাড়া ইউনিয়নের সন্যাসবাড়ি গ্রামের রেজাউল ইসলাম জানান, একদিন হাসপাতালে গেলে আর যেতে ইচ্ছা করবে না। এতই দুর্গন্ধ ও নোংরা- যা বলে বোঝানো সম্ভব নয়। ফলে রোগী ছাড়াও সঙ্গে আসা স্বজনরা পর্যন্ত অসুস্থ হয়ে পড়েন। হাসপাতালে ভর্তি থাকা নওগাঁ জেলা কারাগারের কারারক্ষী জালাল উদ্দীন জানান, চলতি মাসের ১৫ তারিখে তার এপেন্ডিসাইড অপারেশন হয়েছে। তিনি বলেন, ‘এখানকার বাথরুমের যে অবস্থা তা বলে বোঝানো যাবে না। এতটাই জঘন্য, যা পরিবেশের জন্য মারাÍক ক্ষতিকর। ভবনের ভাঙা জানালা-দরজা দিয়েও শীতল বাতাস প্রবেশ করছে।’ বগুড়ার আদমদীঘি উপজেলার ছাতিয়ান গ্রামের আছির উদ্দীনের ছেলে ফিরোজ হোসেন জানান, সবচেয়ে বড় সমস্যা টয়লেট। এ ছাড়া ডাক্তাররা নিজস্ব ক্লিনিক ও চেম্বারে রোগী বাগিয়ে নিয়ে যেতে বেশ কিছু নারী-পুরুষ দালাল রেখেছেন। এসব কারণে রোগী ও তাদের লোকজন চিকিৎসা পাওয়ার পরিবর্তে নানা বিড়ম্বনার শিকার হচ্ছেন। হাসপাতালের আবাসিক চিকিৎসক (আরএমও) ডা. মাহফুজার রহমান বলেন, ‘হাসপাতালের অন্তর্বিভাগে প্রতিদিন গড়ে প্রায় ১৫০ থেকে ১৭০ জন রোগী ভর্তি থাকেন। শয্যা ছাড়াও অন্তর্বিভাগের মেঝে এমনকি বারান্দাতেও রোগীদের শুয়ে চিকিৎসা নিতে হয়। শিগগিরই সব পদে ডাক্তার নিয়োগ করা দরকার। এ ছাড়া হাসপাতালের রান্নাঘর, মর্গ সংস্কারের অভাবে বেহাল হয়ে পড়েছে। পুরনো ভবনে রোগী ভর্তি করার পর স্যাঁতসেঁতে পরিবেশেই চিকিৎসাসেবা দিতে হয়।’ নওগাঁ সদর হাসপাতালের তত্ত¡াবধায়ক ডা. আনজুমান আরা বলেন, ‘জনবল সংকটের কারণে প্রতিনিয়তই ব্যাহত হচ্ছে চিকিৎসাসেবা। অল্প সংখ্যক সেবিকা থাকার কারণে হিমশিম খেতে হয়। যন্ত্রপাতি সংকটের বিষয়টি অনেকবার লিখিত ও মৌখিকভাবে কর্তৃপক্ষকে অবহিত করা হয়েছে।’ অনিয়োগপ্রাপ্ত জনবলের বিষয়ে তিনি বলেন, ‘এতে বহু লোকের কর্মসংস্থান হয়েছে। তবে তাদের বিরুদ্ধে কোনো হয়রানির অভিযোগ এলে খতিয়ে দেখে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।’

সর্বশেষ খবর