শিরোনাম
বৃহস্পতিবার, ২৬ নভেম্বর, ২০১৫ ০০:০০ টা

নারী-শিশু সবাই জড়াচ্ছে চোরাকারবারে

শেখ সফিউদ্দিন জিন্নাহ্, হিলি থেকে ফিরে

নারী-শিশু সবাই জড়াচ্ছে চোরাকারবারে

রাব্বি নামের আট বছরের একটি শিশু গামছা দিয়ে বেঁধে পিঠে, কোমরে, মাথায় করে কী যেন নিয়ে রেললাইনের ওপর দিয়ে এক দৌড়ে ভারতের সীমান্ত হিলি থেকে বাংলাহিলিতে আসে। আর বাংলাদেশে এসেই পিঠ, কোমর ও মাথা থেকে পণ্যগুলো বের করেন তার মা বিলকিছ বেগম। একটু কাছে গিয়ে দেখা গেল গামছা দিয়ে যে পণ্য এনেছে ভারত থেকে তা আর কিছু নয়, ভারতীয় জিরা। জিজ্ঞেস করলে রাব্বি বলে, ‘চোরা না ভালো আমি জানি না। আমার বাবা রেললাইনের ওপার থেকে কয়েকটি প্যাকেট আমার শরীরে গামছা দিয়ে বেঁধে দেয়, আমি তা নিয়ে দৌড়ে বাংলাদেশে চলে আসি। এখানে আমার মা বিলকিছ বেগম তা নিয়ে দোকানে বিক্রি করেন।’ রাব্বি জানায়, ক্লাস টু পর্যন্ত পড়ে আর পড়া হয়নি। কারণ হিসেবে সে বলে, ‘বাবা-মা অনেক গরিব। তাই পড়াশোনা করাতে পারবে না। আর আমিও লেগে পড়ি বাবা-মার সঙ্গে এ ব্যবসায়।’ রাব্বির মা বিলকিছ বেগম বলেন, ‘এ ব্যবসা ভালোই। এখানকার সবাই এ ব্যবসার সঙ্গে জড়িত। এ ছাড়া অন্য কোনো কাজের ব্যবস্থাও নাই এ এলাকায়। তাই পেটের দায়ে এ ব্যবসা করি।’ তিনি বলেন, ‘এতে দোষের কী। রেললাইনের ওপারে মালের দাম কম। এপারে দাম বেশি। আমরা শুধু মাঝখানে এপার-ওপার করে দিই। তাতেই আমাদের একটু ব্যবসা হয়।’ নাঈম নামের ১০ বছরের আরেক শিশু একই কায়দায় ভারতের হিলি থেকে কয়েকটি জিরার ব্যাগ নিয়ে বাংলাহিলিতে এনে মায়ের কাছে দেয়। নাঈমও দারিদ্র্যের কশাঘাতে পড়াশোনা করতে পারেনি। তাই মায়ের সঙ্গে এ ব্যবসায় সহযোগিতা করছে বলে জানায় সে। নাঈম বলে, ‘এ থেকে যা আয় হয় তা দিয়ে আমাদের সংসার ভালোই চলে।’ শুধু রাব্বি আর নাঈম নয়, হিলি সীমান্তে এমন শতাধিক শিশু রয়েছে, যারা কাকডাকা ভোর থেকে মধ্যরাত পর্যন্ত ভারতের সীমান্ত হিলি থেকে বিভিন্ন পণ্য সীমান্ত দিয়ে চোরাই পথে বাংলাদেশে এনে বিক্রির কাজ করছে। শুধু শিশুরা নয়, এ কাজে শিশুদের পাশাপাশি রয়েছে নারীরাও। এখানে ছোট-বড় সব বয়সের নারীই এ পেশায় জড়িত। যেসব নারীর শিশুসন্তান রয়েছে তারা শিশুদের ব্যবহার করছেন বেশি। আর যাদের শিশুসন্তান নেই তারা নিজেরাই এপার-ওপার চোরাকারবারির ব্যবসা করছেন দেদারসে। তেমনই ষাটোর্ধ্ব অঞ্জলি রানী নামের এক বৃদ্ধা বলেন, ‘আমার তো স্বামী-সন্তান সবই ছিল। কিন্তু সংসারে অভাব-অনটন থাকায় আমার স্বামী দিনমজুরের কাজ করতেন। হঠাৎ একটি সড়ক দুর্ঘটনায় স্বামী মারা যান। আর আমার ছেলে বিয়ে করে আলাদা হয়ে গেছে। তাই আমি বাধ্য হয়ে এপার-ওপার মাল আনা-নেওয়া করি। এক প্যাকেট জিরা ভারত থেকে আনলেই ২০-২৫ টাকা লাভ হয়। আর একেকবার ১৫-২০ প্যাকেট জিরা এনে বিক্রি করি। তা দিয়ে যা আয় হয়, আমার সংসার চলে।’ হিলিতে জন্ম নেওয়া শিশুর জীবনে প্রথম কাজই যেন হচ্ছে চোরাকারবারি করা! এখানকার শিশুদের মতে, এটি কোনো খারাপ পেশা বা কাজ নয়। এটি অন্যান্য সাধারণ কাজের মতোই। ‘চোরাকারবার’ শব্দটি যেন এদের কাছে অচেনা। সরেজমিনে গিয়ে দেখা গেছে, হিলি এলাকায় বাংলাদেশ ও ভারতের মাঝখানে শুধু একটি রেললাইন। আর এ রেললাইনের ঠিক পরেই ভারতের সীমানা। ভারতীয় এলাকায় বিএসএফ ও বাংলাদেশি এলাকায় বিজিবি পাহারা দিচ্ছে। এর পরও এদের চোখ ফাঁকি দিয়ে প্রতিদিন ভারতীয় নানা পণ্য আসছে বাংলাদেশে। আর বাংলাদেশি মুদ্রা পাচার হচ্ছে ভারতে। হিলি রেলস্টেশনের আশপাশের ৫০০ মিটার এলাকায় নেই কোনো কাঁটাতারের বেড়া। আর এ সুযোগ কাজে লাগিয়ে চোরাকারবারিরা চোরাই পণ্য আনা-নেওয়ার কাজ করছে। ভোর থেকে শুরু হয় হিলি সীমান্ত দিয়ে চোরাকারবারিদের ভারতীয় পণ্য আনা-নেওয়ার কাজ। চলে রাত অবধি। নারী-শিশুরা এখানে প্রতিদিন শরীরের বিভিন্ন স্থানে কাপড় দিয়ে বেঁধে, ছোট ছোট ব্যাগে ভর্তি করে ভারতীয় জিরা, বিভিন্ন কসমেটিক, শাড়ি, চাদর, কম্বল, জুস, খাদ্যপণ্যসহ ৩০০ থেকে ৪০০ ধরনের পণ্য সীমান্ত পেরিয়ে এপারে নিয়ে আসে। পিঠে, কোমরে গামছা দিয়ে বেঁধে কিংবা মাথায় ভারতীয় জিরা নিয়ে ভারতের দক্ষিণ দিনাজপুরের ভালুরঘাট থানার সীমান্ত এলাকা হিলি থেকে রেললাইন পার হয়ে চলে আসে বাংলাহিলিতে। আর বাংলাদেশে আনার পর বিলকিছ বেগমের মতো নারীরা জিরাগুলো দোকানে বিক্রি করেন। তাদের সহযোগিতা করে থাকে ১০-১২ বছরের শিশুসন্তানরা। ছোট্ট এই শিশুদের যে বয়সে থাকার কথা স্কুলে, সেই বয়সে তারা শিক্ষা নিচ্ছে কীভাবে চোরাকারবার করা যায়। আর এখানকার বর্তমান চিত্র এটি। বাংলাহিলির চোরাকারবারি সিন্ডিকেটের সদস্য এনামুল জানান, এ সীমান্ত দিয়ে ভারত থেকে বাংলাদেশে সবকিছুই আসে। হিলি সীমান্তের বর্ডার গার্ড বাংলাদেশ (বিজিবি) ক্যাম্পের কমান্ডার লে. কর্নেল মো. খবির সরকার বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, ভারত থেকে চোরাই পণ্য আনা-নেওয়া বন্ধ করতে অভিযান চলছেই। এর পরও একটি সিন্ডিকেট ভারতীয় পণ্য চোরাই পথে এনে বাংলাদেশে বিক্রি করছে। তবে তিনি স্বীকার করে বলেন, হিলি সীমান্তসহ অন্যান্য সীমান্তে নারী-শিশুদের চোরাকারবারি হিসেবে ব্যবহার করা হয়। ছোট ছোট শিশু হঠাৎ হঠাৎ রেললাইনের ওপর দিয়ে দৌড়ে যায়, আবার বিভিন্ন পণ্য নিয়ে আসে। এটি সিন্ডিকেটের সদস্যরা করে থাকে, নারী-শিশুদের ওপর সহজে আক্রমণ করা যায় না বলে।

সর্বশেষ খবর