শুক্রবার, ২৭ নভেম্বর, ২০১৫ ০০:০০ টা

পাসপোর্ট-ভিসাই যেন ঝামেলা এখানে

শেখ সফিউদ্দিন জিন্নাহ্, হিলি থেকে ফিরে

পাসপোর্ট-ভিসাই যেন ঝামেলা এখানে

সাধারণত যাদের পাসপোর্ট-ভিসা আছে তাদের বৈধ পথে দ্রুত সীমান্ত পার হওয়ার কথা। কিন্তু হিলি সীমান্তে তার উল্টো। এখান দিয়ে বৈধ পথে সীমান্ত পার হতে চাইলে পড়তে হয় নানা ঝক্কি-ঝামেলা আর বিড়ম্বনায়। গাঁটের পয়সা তো অতিরিক্ত যাবেই, এরপর পড়তে হবে ভোগান্তিতে। অথচ পাসপোর্ট-ভিসা না থাকলে ঝক্কি-ঝামেলায় পড়ার তেমন আশঙ্কাই থাকে না। দালালদের হাতে জনপ্রতি হাজার দেড়েক করে টাকা ধরিয়ে দিলেই পাঁচ মিনিটের মধ্যে পার হওয়া যায় সীমানা। শুধু তা-ই নয়, বন্দর ছাড়া রেলস্টেশন দিয়ে পার হতে তো লাগে মাত্র ১০০ টাকা। রেললাইনের এপার-ওপার করতে থাকে কয়েকজন দালাল। আর দালালদের ১০০ টাকা ধরিয়ে দিলেই অসম্ভবকে সম্ভব করে দেয়। ইমিগ্রেশন, কাস্টমস, বিজিবি কিছুই মোকাবিলা করতে হয় না।

হিলি সীমান্ত দিয়ে ভারতে প্রবেশ ও ফেরার সময় দেখা গেছে, পাসপোর্টবিহীন যে-কেউ হাজার-পনেরশ’ টাকা দিয়ে অল্প সময়ের মধ্যেই বিজিবি (বর্ডার গার্ড বাংলাদেশ) ও বিএসএফের (ভারতীয় সীমান্তরক্ষী বাহিনী) সামনে দিয়ে সীমান্ত পার হচ্ছে শত শত নারী-পুরুষ। একটু দক্ষিণে এগোলেই রেলস্টেশন। আর সেখানেই দেখা মেলে ভিন্ন চিত্রের। রেলস্টেশন এলাকায় লাগে না হাজার টাকা। শুধু ১০০ টাকা হলেই ভারত যাওয়া-আসা দুটোই হয়। কিন্তু ঝামেলায় পড়তে হয় যারা বৈধভাবে পাসপোর্ট-ভিসা করে ভারত যেতে চান তাদের। দালাল, ইমিগ্রেশন, কাস্টমসসহ নানা বিড়ম্বনায় পড়তে হয় বৈধ পাসপোর্ট-ভিসাধারীদের। এতে নষ্ট হয় ঘণ্টা তিনেক। অপেক্ষা করতে হয় খোলা আকাশের নিচে কিংবা কোনো পরিবহন কাউন্টারে। বৈধ যাত্রীদের ক্ষেত্রে পাসপোর্ট বাবদ সাড়ে তিন হাজার থেকে ছয় হাজার, অনলাইনে ভিসা ফরম পূরণ বাবদ দুই হাজার থেকে তিন হাজার, ভিসা ফরম জমা দিতে ৬০০ এবং ভ্রমণ কর দিতে হয় ৫০০ টাকা। আর সঙ্গে জোটে সীমান্তঘেঁষা দালালচক্রের অত্যাচার। বৈধ যাত্রী সরাসরি পাসপোর্ট নিয়ে ইমিগ্রেশন ও কাস্টমসের কাজ সারতে পারেন না। কাস্টমস কর্মকর্তারাই সে সুযোগ দেন না। কোনো না কোনো দালালের মাধ্যমে ইমিগ্রেশন ও কাস্টমস চেক করাতে হয়। গত দুই দিনে দিনাজপুরের হিলি ও ভারতের হিলি সীমান্ত ঘুরে পাওয়া গেছে এ চিত্র। জানা গেছে, বাংলাদেশের হিলি সীমান্তঘেঁষা হানিফ, জাকের, কেয়া, শ্যামলী, রোজিনা, এসআরসহ আটটি পরিবহন কাউন্টার রয়েছে। প্রতি কাউন্টারে আছে চার থেকে ছয়জন করে দালাল। এ দালালদের নিয়ে গড়ে তোলা হয়েছে একটি শক্তিশালী সিন্ডিকেট। এ সিন্ডিকেটের হাত ছাড়া বৈধ কোনো যাত্রী ইমিগ্রেশন ও কাস্টমস চেক করাতে পারেন না। যাত্রীপ্রতি দিতে হয় ১২০ থেকে ৫০০ টাকা পর্যন্ত। আইনের তোয়াক্কা করা হয় না এখানে। বাস থেকে নেমেই দালালদের হাতে পাসপোর্ট জমা দিতে হয়। না হলে বসে থাকতে হয় ঘণ্টার পর ঘণ্টা। এরপর রয়েছে ব্যাগ টানাটানি পার্টির বকশিশ-বাণিজ্য। অন্যদিকে একজন অবৈধ যাত্রীকে এসবের কোনো ঝামেলা পোহাতে হয় না। মাত্র এক-দেড় হাজার টাকা দালালের হাতে দিলেই সীমান্ত পার হওয়া যায় চোখের পলকে। নানা পন্থায় বৈধ যাত্রীদের কাছ থেকে অবৈধভাবে আদায় করা অর্থের একটি অংশ চলে যাচ্ছে বিজিবি, বিএসএফ, ইমিগ্রেশন ও কাস্টমস কর্মকর্তাদের হাতে। বাংলাদেশের হিলি সীমান্তে ভারত গমনেচ্ছু পরেশ নামের এক যাত্রী জানান, মঙ্গলবার রাত সাড়ে ১০টায় কমলাপুর থেকে হানিফ পরিবহনে হিলি সীমান্তের উদ্দেশে তিনি আসেন ভারতে যাওয়ার জন্য। বুধবার ভোর ৫টায় সেখানে পৌঁছেন। তার পাসপোর্ট-ভিসা নেই। তবে তার সঙ্গে থাকা মামা ও দিদিমার পাসপোর্ট ভিসা আছে। কাউন্টারে থাকা এনামুল নামে এক দালালের মাধ্যমে ভোরেই সীমান্ত পার হয়ে ভারতের হিলিতে চলে যান পরেশ। কিন্তু তার সঙ্গে থাকা মামা ও দিদিমাকে সকাল ১০টা পর্যন্ত পরিবহন কাউন্টারে অপেক্ষা করতে হয় ইমিগ্রেশন ও কাস্টমস অফিস খোলা পর্যন্ত। এরপর সব ঝামেলা মোকাবিলা করে বেলা ১২টায় তারা সীমান্ত পার হন। একই পন্থায় তাদের বাংলাদেশের হিলিতে ফিরে আসতে হয়। এভাবে প্রতিদিন বৈধ যাত্রীদের নানাভাবে দুর্ভোগ পোহাতে হচ্ছে। অন্যদিকে রেলস্টেশন এলাকায় গিয়ে দেখা গেছে নাহিদ, এনামুল, এমারত, আমান নামের কয়েকজন দালাল লোকজনকে রেললাইনের এপার-ওপার করতে ব্যস্ত। কথা হয় এনামুলের সঙ্গে। মাত্র ১০০ টাকা দিলেই ওপারে (ভারত হিলি) পার করে দেবেন বলে জানান তিনি। ওপারে সীমান্তঘেঁষা রয়েছে কয়েকটি বাড়ি। সীমানা পার হওয়া মাত্রই ওই সব বাড়িতে আশ্রয় নিতে হয় ভারত গমনেচ্ছুদের। পরে সুবিধামতো নিজ নিজ গন্তব্যে যেতে হয়। শুধু তা-ই নয়, গন্তব্যে পৌঁছানোর জন্যও ভারতের হিলিতে মোটরসাইকেল নিয়ে রয়েছে আরও একটি সিন্ডিকেট। তেমনি সীমান্তঘেঁষা একটি বাড়ির মালিক হরিদাস ও গুড্ডু স্বর্ণকার। ওপারে (ভারত) পার হওয়ার পর হরিদাস ও গুড্ডুদের বাড়িতে আশ্রয় নেওয়া হলো। এসব সীমান্তঘেঁষা বাড়ির ঘরে ঘরে রয়েছে ভারতীয় পণ্যের বাজার। রয়েছে ফেনসিডিল, হেরোইন, ইয়াবাসহ নানা ধরনের মাদক। একাধিক সূত্রে জানা গেছে, ইমিগ্রেশন চেকপোস্টে নাগরিক সুযোগ-সুবিধা বাড়েনি। চেকপোস্টে থাকার মতো আবাসন কিংবা ব্যারাকও নেই। অথচ এ চেকপোস্ট দিয়ে প্রতিমাসে অন্তত ১৫ হাজার মানুষ যাতায়াত করে থাকে। এ হিসাবে বছরে প্রায় মপল লাখ ৮০ হাজার দেশি-বিদেশি মানুষ যাতায়াত করে এই পয়েন্ট দিয়ে। শুধু তা-ই নয়, শত শত কোটি টাকার পণ্য আমদানি ও রপ্তানি করা হয় এ বন্দর দিয়ে। কিন্তু ইমিগ্রেশন চেকপোস্টে উন্নয়নের কোনো ছোঁয়া লাগেনি। জোড়াতালি দিয়ে চলছে অফিস। বন্দর এলাকায় নেই কোনো যাত্রীদের বসার সুব্যবস্থা। ইমিগ্রেশন চেক করতে গিয়ে তাদের নানাভাবে কষ্ট করতে হয়। অবকাঠামোগত উন্নয়ন না হওয়ায় দৈনন্দিন কাজে কর্মকর্তাদের পোহাতে হয় নান দুর্ভোগ। তবে এ বিষয়ে বাংলা হিলি ইমিগ্রেশনের দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তা রকিবুজ্জামান বললেন, বাংলা হিলি ইমিগ্রেশনে কমপ্লেক্স ভবন আছে। আছে নাগরিক সুযোগ-সুবিধা। একই সঙ্গে যাত্রীদের কাছ থেকে দালালদের মাধ্যমে অবৈধভাবে অর্থ আদায়ের বিষয়টি অস্বীকার করেন তিনি। বাংলা হিলি কাস্টমসে কর্মরত নাম প্রকাশ না করার শর্তে এক কর্মকর্তা বলেন, ‘ভারত ও বাংলাদেশে প্রবেশ করতে অনেক যাত্রী ইমিগ্রেশন ও কাস্টমস বোঝেন না। স্থানীয় কিছু বেকার লোক তাদের সহযোগিতা করে থাকে। বিনিময়ে যাত্রীরা তাদের একটু আর্থিক সহযোগিতা করেন। এতে দোষের কিছু নেই।’ হিলি সীমান্তের বিজিবি ক্যাম্পের কমান্ডার লে. কর্নেল মো. খবির সরকার বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, ‘বাংলাদেশের অন্যান্য সীমান্তে কাঁটাতারের বেড়া থাকলেও হিলির কয়েকটি স্থানে তা নেই। আর এ সুযোগে কয়েকটি সিন্ডিকেট মিলে সীমান্ত পারাপারের কাজ করছে। বহুবার অভিযান চালিয়েছি। অভিযানের সময় একটু ভালো থাকলেও পরে আবার পূর্বের অবস্থায় ফিরে আসে।’

এই বিভাগের আরও খবর

সর্বশেষ খবর