বুধবার, ১৬ ডিসেম্বর, ২০১৫ ০০:০০ টা

যেভাবে বিজয় মেলা

মাহমুদুল ইসলাম চৌধুরী

যেভাবে বিজয় মেলা

১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর রক্তক্ষয়ী এক মুক্তিযুদ্ধে এবং লাখ লাখ প্রাণের বিনিময়ে আমাদের মহান বিজয় অর্জিত হয়েছে। এ বিজয়ের ফলে অভ্যুদ্বয় ঘটেছে প্রিয় মাতৃভূমি স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশের। এ বিজয়ের শক্তি নিয়ে আমরা নতুন উদ্যোমে উদ্দীপ্ত হয়ে সামনের দিকে এগিয়ে চলি। যে ভাবে ভারতীয় উপমহাদেশে আন্দোলনের সূতিকাগার হিসেবে চট্টগ্রাম গুরুত্বপূর্ণ, ঠিক একইভাবে এই মেলার পুরোধাও চট্টগ্রাম।

মহান বিজয়ের এ মাসে নানান আয়োজনের মধ্য দিয়ে আমরা উদযাপন করি আমাদের বিজয় দিবস। অনেক আয়োজনের মধ্যে ‘বিজয় মেলা’ নামে এখন অনুষ্ঠিত হয় মেলা, সাংস্কৃতিক উৎসব, টেলিভিশনের বিশেষ প্রোগ্রামসহ আরও অনেক কিছু। আজ বিজয় মেলা শব্দটি তার নিজস্ব পরিচিতি পেয়েছে। বিজয়ের মাস এলেই কানে বাজে ‘বিজয় মেলা’। কিন্তু এ বিজয় মেলা শব্দ বা বিজয় মেলার পথ চলার উত্পত্তি সম্পর্কে হয়তো দেশবাসী তেমন কিছু জানে না। আজ বিজয় মেলার গোড়াপত্তন বা বিজয় মেলার ভিত্তি সম্পর্কে কিছু আলোকপাত করতে চাই আমার এ ছোট লেখনীতে।

১৯৮৯ সালে চট্টগ্রামের মাটি থেকে শুরু হয় বিজয় মেলা। আমি তখন সংসদ সদস্য ও চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনের মেয়র। নভেম্বরের শেষে বা ডিসেম্বরের প্রথম দিকে প্রখ্যাত মুক্তিযোদ্ধা ফারুক-ই-আজম বীরপ্রতীক ও বাংলাদেশ সংবাদ সংস্থার (বাসস) তত্কালীন চট্টগ্রাম প্রতিনিধি পরবর্তীতে ব্যবস্থাপনা পরিচালক আজিজুল ইসলাম ভূঁইয়া আমার কাছে আসেন। যেহেতু ষাটের দশকের ছাত্র রাজনীতি থেকে শুরু করে মুক্তিযুদ্ধ পর্যন্ত বৃহত্তর চট্টগ্রামের সব কর্মকাণ্ডে আমি ওতপ্রোতভাবে জড়িত ছিলাম। সেই সুবাধে তারা আমার কাছে আসেন এবং অবহিত করেন যে, তারা বিজয় মেলা করতে চান। এ জন্য তারা বেছে নিলেন পুরানা সার্কিট হাউসের সামনের খোলামাঠ, যা বর্তমান চট্টগ্রাম সার্কিট হাউসের পাশের খালি জায়গাসহ শিশুপার্ক। কিন্তু ডিসি অফিস থেকে এ ব্যাপারে কোনো অনুমতি পাচ্ছেন না। এ সমস্যা সমাধানে তারা আমার সহযোগিতা কামনা করেন। এখানে উল্লেখ্য যে, সেই সময় মেয়র মহানগরের কর্তাব্যক্তি ছিলেন। আমি বিজয় মেলার প্রত্যয়গত ধারণা এবং এর ঐতিহাসিক গুরুত্ব অনুধাবনের পর তাদেরকে প্রায় দেড় ঘণ্টা বসিয়ে রাখি এ সমস্যা সমাধানের জন্য।

যেহেতু সার্কিট হাউসের সামনের জায়গাটি সেনাবাহিনীর আওতাধীন, সেহেতু জেলা প্রশাসক তাদের অনুমতি প্রদানের ব্যাপারে অপারগতা প্রকাশ করেন। আমি তখন চট্টগ্রামের তত্কালীন জিওসি পরবর্তীতে সংসদ সদস্য জেনারেল আবদুস সালামকে ফোন করি। বিজয় মেলা এবং এর তাত্পর্যের কথা শুনে তিনি উত্তর দেন সিটি ফাদার করতে চাইলে জিওসি না করতে পারে না এবং তিনি আবেদন পাঠাতে বলেন। প্রস্তাবিত স্থানে জিওসির হ্যাঁ সূচক জবাব পেয়ে বিজয় মেলা উদযাপনের সব পদক্ষেপ নেওয়া হয়। বিজয় মেলার সাংগঠনিক কমিটি গঠন করা হয় এবং আমাকে এ কমিটির প্রধান পৃষ্ঠপোষক করা হয়। এ কমিটির সভাপতি মনোনীত হন বীর মুক্তিযোদ্ধা ফারুক-ই-আজম এবং সাধারণ সম্পাদক বিশিষ্ট সাংবাদিক আজিজুল ইসলাম ভূঁইয়া। এরপর জিওসি বরাবর অফিশিয়াল আবেদন করা হয় এবং পুলিশ কমিশনারসহ প্রশাসনের সব স্তরে মেলা উদযাপনে সর্বপ্রকার সহযোগিতা প্রদানের জন্য আমি পরামর্শ দেই।

বিজয় মেলা উদযাপনের অনুমতি পাওয়ার পর মেলা কমিটির সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদক আমাকে জানান, মেলা আয়োজনের প্রয়োজনীয় অর্থ তাদের কাছে নেই এবং অল্প সময়ের মধ্যে টাকা জোগাড় করা তাহাদের পক্ষে দুরূহ ব্যাপার। তখন আমি তাদের মেলার একটি সুভ্যেনির বের করার পরামর্শ দেই এবং সিটি করপোরেশনের ফান্ড থেকে বিজ্ঞাপন বাবদ বড় অঙ্কের অর্থ দেই। এ ছাড়াও আমি ব্যক্তিগতভাবে আরও কয়েকটি বিজ্ঞাপন জোগাড় করে দেই। এর মধ্যে যাদের নাম উল্লেখযোগ্য, বর্তমান বৈদেশিক কর্মসংস্থান মন্ত্রী সানোয়ারা করপোরেশনের চেয়ারম্যান নুরুল ইসলাম বিএসসি, সাবেক মন্ত্রী আবদুল্লাহ আল নোমানের ছোট ভাই ব্যবসায়ী আবদুল্লাহ আল হাসান। এর মধ্যে একজন মেলার মঞ্চ সজ্জার ও অন্যজন আপ্যায়ন এবং শিল্পীসহ অন্যান্য সব ব্যবস্থা করেন।

বিজয় মাসে বিজয় মেলার এ আয়োজন আমাকে বিশেষভাবে উৎসাহিত করেছিল। মেলা সফল করতে এবং মেলার কার্যক্রম পরিচালনার জন্য তখন কাজীর দেউড়ি মোড়ে একটি দর্জি দোকান অস্থায়ীভাবে ভাড়া নেওয়া হয়। আমি মেয়র এবং মেলার প্রধান পৃষ্ঠপোষক হিসেবে অস্থায়ী এ কার্যালয়ের উদ্বোধন করেছিলাম। অস্থায়ী কার্যালয় উদ্বোধনের সময় আমার সঙ্গে অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিদের মধ্যে বার কাউন্সিলের সদস্য অ্যাডভোকেট আবুল কালাম আজাদ ভাইসহ অনেকে বক্তব্য রেখেছিলেন। তখন এ বিজয় মেলা শব্দটি দেশের অন্য কোথাও উচ্চারিত হতো না। চট্টগ্রাম থেকেই এর যাত্রা শুরু এবং প্রধান পৃষ্ঠপোষক ও মেয়র হিসেবে আনুষ্ঠানিকভাবে সর্বপ্রথম আমি এই মেলার উদ্বোধন করেছিলাম। আজ দেশের বিভিন্ন স্থানে বিজয় মেলা অতি আনন্দের সঙ্গে উদযাপিত হতে দেখে ভালো লাগে। বন্দর নগরীর সীমানা পেরিয়ে বিজয় মেলা আজ সারা দেশে জাতীয় ঐতিহ্যে পরিণত হয়েছে। মুক্তিযুদ্ধের চেতনালব্ধ এ ধরনের একটি ভিন্নধর্মী প্রয়াসের সূচনালগ্ন থেকে আমি জড়িত আছি, এটি আজ আমার জন্য বড় আত্মতৃপ্তির বিষয়। বিজয়ের এ মাসে আমি আজ ফারুক-ই-আজম ও আজিজুল ইসলাম ভূইয়ার অবদানের কথাও স্মরণ করছি।

লেখক : সাবেক মেয়র, চট্টগ্রাম ও সাবেক সংসদ সদস্য।

এই রকম আরও টপিক

সর্বশেষ খবর