শনিবার, ৩০ জানুয়ারি, ২০১৬ ০০:০০ টা

একুশে বইমেলার নিরাপত্তা প্রশ্নবিদ্ধ

এখনো কার্যকর হয়নি ৬১ কোটি টাকার পুলিশের সিসিটিভি

সাখাওয়াত কাওসার

নিরাপত্তার শঙ্কা মাথায় নিয়েই শুরু হচ্ছে অমর একুশে বইমেলা। ১ ফেব্রুয়ারি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার উদ্বোধনের মধ্য দিয়ে

আনুষ্ঠানিকভাবে শুরু হচ্ছে এ মেলা। তবে গত বছর বইমেলা চত্বরে ব্লগার অভিজিত্ রায় এবং বছর শেষে জাগৃতি প্রকাশনীর কর্ণধার আরেফিন দীপন হত্যা এবং আরও দুই ব্লগারকে কুপিয়ে জখমের ঘটনার পরও নিরাপত্তাব্যবস্থায় অনেক ঘাটতি থেকেই যাচ্ছে বলছেন সংশ্লিষ্টরা। যদিও আইন প্রয়োগকারী সংস্থার সদস্যরা বলছেন, পর‌্যাপ্ত নিরাপত্তা নিশ্চিত করা হচ্ছে বইমেলায়। অন্যদিকে ৬১টি কোটি টাকা খরচ করার পরও ১৫ বছরে শেষ হয়নি রাজধানীতে পুলিশের ১৫৫টি সিসিটিভি ক্যামেরা স্থাপনের কাজ। নিজেদের নিরাপত্তা নিশ্চিতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এলাকায় সিসিটিভি ক্যামেরা স্থাপনের উদ্যোগও নেয়নি বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ। অপরাধবিশেষজ্ঞ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অপরাধবিজ্ঞান বিভাগের চেয়ারম্যান অধ্যাপক জিয়া রহমান বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, গত বছরের ঘটনাগুলো সত্যি আতঙ্কের। যদিও আমরা এসব ঘটনায় অভ্যস্ত ছিলাম না। তাই কর্তৃপক্ষের উচিত স্বল্প ও দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা গ্রহণ করে পরিস্থিতি মোকাবিলা করা। এ ক্ষেত্রে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষও বাদ যায় না। তিনি বলেন, নাশকতা ঠেকাতে কর্তৃপক্ষের উচিত হবে একদিকে প্রবেশ ও অন্যদিকে বের হওয়ার ব্যবস্থা রাখা। একই সঙ্গে প্রযুক্তিগত ব্যবস্থা যতটুকু সম্ভব নিশ্চিত করা। গোয়েন্দা সূত্র জানায়, বেশ কয়েকটি উগ্রপন্থি সংগঠন থেকে সম্প্রতি দেশের বিভিন্ন স্থানে লেখক, প্রকাশক, ব্লগারসহ বিশিষ্টজনদের হত্যার হুমকি দেওয়ার ঘটনাগুলো মাথায় রেখে নতুন করে নিরাপত্তা প্রস্তুতি নেওয়া হয়েছে। গত বছর ২৬ ফেব্রুয়ারি বইমেলা থেকে বের হওয়ার পর টিএসসিতে কুপিয়ে হত্যা করা হয় লেখক ও ব্লগার অভিজিত্ রায়কে। বইমেলার ভিতর থেকেই তাকে অনুসরণ করছিল দুর্বৃত্তরা। এ বইমেলাতেই দুর্বৃত্তরা হামলে পড়েছিল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক হুমায়ুন আজাদের ওপর। সম্প্রতি পুলিশ, র?্যাব ও গোয়েন্দা প্রতিনিধিদের সঙ্গে আইনশৃঙ্খলা বিষয়ে সভা করেছে সংস্কৃতি মন্ত্রণালয়। সভা থেকেই প্রাথমিকভাবে সিদ্ধান্তগুলো নেওয়া হয়েছে। বাংলা একাডেমি কর্তৃপক্ষ বলছে, বইমেলা প্রাঙ্গণের ভিতরে ও আশপাশ এলাকায় বসানো হবে দুই শতাধিক ক্লোজ সার্কিট (সিসি) টিভি ক্যামেরা। এগুলো মনিটর করার জন্য থাকবে কন্ট্রোল রুম। এর বাইরে এবার অতিরিক্ত লাইটিংয়ের ব্যবস্থা নেওয়া হবে, যাতে অপরাধীরা অন্ধকারের সুবিধা না নিতে পারে। বইমেলার প্রকাশক, লেখক ও পাঠকদের শতভাগ নিশ্ছিদ্র নিরাপত্তা দিতে পুলিশ, র?্যাব এবং গোয়েন্দা পুলিশকে বলা হয়েছে। সম্প্রতি অপরাধের ধরন পাল্টে যাওয়া, উগ্রপন্থিদের অব্যাহত মাত্রায় নাশকতার চেষ্টার ঘটনায় বিশেষ করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এলাকায় বিভিন্ন স্পর্শকাতর ঘটনাকে কেন্দ্র এটিকে সিসিটিভি ক্যামেরার আওতায় নিয়ে আসতে অনুরোধ করেছিল ঢাকা মহানগর পুলিশ। সম্প্রতি ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের যুগ্ম-কমিশনার মনিরুল ইসলাম বলেছেন, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাইরেও আরও কয়েকটি সরকারি-বেসরকারি প্রতিষ্ঠানকে নিরাপত্তার স্বার্থে এমন অনুরোধ করা হয়েছিল। তবে অনেকেই এ ব্যাপারে সাড়া দিলেও ঢাবি কর্তৃপক্ষ এখনো কোনো উদ্যোগ নেয়নি। সূত্র জানায়, নিরাপত্তার আওতায় থাকবে বাংলা একাডেমির বইমেলা প্রাঙ্গণ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়-টিএসসি, দোয়েল চত্বর, শাহবাগ ও সোহরাওয়ার্দী উদ্যান। একাধিক পয়েন্টে থাকবে র?্যাব-পুলিশের চেকপোস্ট। সেই সঙ্গে আনসার, ভিডিপি, ফায়ার সার্ভিস ও সাদা পোশাকের পুলিশ সদস্যরাও দায়িত্ব পালন করবেন। পাশাপাশি এবারও থাকছে মেলা প্রাঙ্গণ ও প্রবেশপথে ক্লোজ সার্কিট ক্যামেরা। তবু অভিজিত্ রায় খুনের পর প্রকাশকদের ওপর হামলা এবং জাগৃতির প্রকাশক ফয়সল আরেফীন দীপনকে হত্যার পর আতঙ্ক কাটছে না। ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের (দক্ষিণ) উপকমিশনার মাশরুকুর রহমান খালেদ বলেন, ‘পরিস্থিতি বিবেচনায় এনে এবারের বইমেলায় পর‌্যাপ্ত নিরাপত্তাব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে। মেলা প্রাঙ্গণে থাকছে চার থেকে ছয়টি ওয়াচ টাওয়ার। থাকছে কন্ট্রোল রুম। কেউ কোনো ধরনের নিরাপত্তাহীনতায় ভুগলে সেখানে আমাদের অবহিত করতে পারবেন। এর বাইরেও মেলার প্রবেশপথেই থাকছে আর্চওয়ে। পোশাকে ও সাদা পোশাকে পুলিশ সদস্যরা মেলায় অবস্থান করবেন।’

তিনি জানান, মেলার ভিড়ে ইভ টিজিং কিংবা লাঞ্ছনার ঘটনা যাতে না ঘটে তাই এবার ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ও মেলা কর্তৃপক্ষের সঙ্গে কথা বলে ইতিমধ্যে ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে।

বাংলা একাডেমির মহাপরিচালক শামসুজ্জামান খান বলেন, ‘এবার পর‌্যাপ্ত নিরাপত্তাব্যবস্থা রাখা হয়েছে। যে কোনো অপ্রীতিকর ঘটনা মোকাবিলা করতে পর‌্যাপ্ত পুলিশ-র‌্যাব মেলার নিরাপত্তায় থাকবে। পুরো এলাকাকে সিসিটিভির আওতায় রাখা হবে। আশা করি এবারের বইমেলায় বইপ্রেমীরা স্বতঃস্ফূর্তভাবে আসতে পারবেন।’ র‌্যাব-৩-এর অধিনায়ক লে. ক. খন্দকার গোলাম সারোয়ার বলেন, বইমেলায় পোশাকে ও সাদা পোশাকে র‌্যাব সদস্যরা থাকবেন। পেট্রোলিংয়ে একাধিক টিম, যেখানে বেশি লোকের সমাগম হবে সেখানে বাড়তি নজরদারির ব্যবস্থা থাকছে। মেলা প্রাঙ্গণেই থাকছে র‌্যাবের একটি ওয়াচ টাওয়ার।

পানিতে সিসিটিভির ৬১ কোটি টাকা : ৬১ কোটি টাকা খরচ হওয়ার পরও রাজধানীতে এখনো স্থাপিত হয়নি পুলিশের ১৫৫টি সিসিটিভি ক্যামেরা। ডিজিটাল বাংলাদেশ গড়ার লক্ষ্যে পুলিশ বিভাগকে আধুনিকীকরণের জন্য ৬১ লাখ ৪১ হাজার ২০০ টাকার একটি প্রকল্প একনেকে অনুমোদিত হয় ১৯৯৮ সালে। প্রথমে স্থান নির্ধারণ, টাওয়ার নির্মাণ ও বেজস্টেশন ঠিক করার জন্যই চলে যায় আট বছর। পরে ২০০৬ সালে বাকি কাজ সম্পন্ন করার জন্য দরপত্র আহ্বান করলে পাঁচটি কোম্পানি অংশ নেয়। তত্কালীন পুলিশের কয়েকজন কর্মকর্তাকে ম্যানেজ করে ৬১ কোটি টাকার সিসিটিভি ক্যামেরার কাজ পায় যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক ‘ফলেক’ কমিউনিকেশনসের দেশীয় এজেন্ট রাফা ট্রেডিং লি.। তবে ১৫৫টি ক্যামেরা স্থাপনের কিছুদিনের মধ্যে ৫০টিরও বেশি অকেজো হয়ে যায়। ছবিও আসতে থাকে ঘোলাটে। অনেক সময় কিসের ছবি তা বুঝতেও হিমশিম খেতে হতো সংশ্লিষ্টদের। ওই ক্যামেরা থেকে পেনড্রাইভ ছাড়া ছবিগুলো সরাসরি আর্কাইভে নেওয়ারও কোনো ব্যবস্থা ছিল না। কমিটির অন্যতম একজন সদস্য পুলিশের সহকারী মহাপরিদর্শক (উন্নয়ন) মোজাম্মেল হক বলেন, ‘কমিটিতে বুয়েট ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের তিনজন এক্সপার্টাইজ রয়েছেন। ২৪ ডিসেম্বর সিঙ্গাপুরভিত্তিক একটি কোম্পানিকে ১৫ দিনের সময় দিয়ে ক্যামেরাগুলো সক্রিয় করে আমাদের কাছে বুঝিয়ে দেওয়ার জন্য বলা হয়েছে। তবে তারা সময় চেয়েছে। দেখা যাক।’সিসিটিভি বাজেটের ৬১ কোটি টাকা হরিলুট হয়েছে কি না—এমন প্রশ্নে পুলিশের টেলিকম বিভাগ থেকে জানানো হয়েছে, ৬১ কোটি টাকার মধ্যে ১০ কোটি টাকা ফেরত দেওয়া হয়েছে।

সর্বশেষ খবর