মঙ্গলবার, ২৯ মার্চ, ২০১৬ ০০:০০ টা

আশুলিয়ায় ‘মোল্লা দারোগার ঘাঁটি’র ভয়ে তটস্থ মানুষ

সাঈদুর রহমান রিমন

আশুলিয়ায় ‘মোল্লা দারোগার ঘাঁটি’র ভয়ে তটস্থ মানুষ

শহিদুল

পুলিশের বিতর্কিত এক সাব ইন্সপেক্টর আর সোর্সদের সমন্বয়ে ঢাকার আশুলিয়ায় গড়ে উঠা ‘বিকল্প থানা’র যন্ত্রণায় জনজীবন অতিষ্ঠ হয়ে উঠেছে। যখন যাকে খুশি ধরে নিয়ে সেখানে আটকে রাখা হচ্ছে, চাহিদামাফিক টাকা পয়সা আদায়ে চালানো হচ্ছে নির্যাতন। আশুলিয়ার মূল থানার বিপরীত দিকে একশ গজের মধ্যেই জাহাবাজ সোর্স আনিসুর রহমানের ভাড়া ঘরের কথিত থানা থেকেই সব খাতের চাঁদা ধার্য হয়, সেখানেই নির্ধারিত সময়ে মাসোহারা পৌঁছে দিয়ে তবেই নিস্তার মেলে সবার। থানা পুলিশ থেকে শুরু করে সাধারণ লোকজনের কাছে বিকল্প থানাটি ‘মোল্লা দারোগার ঘাঁটি’ নামেই বেশি পরিচিত।

অন্তত দুই দফা বিভাগীয় শাস্তিসহ অসংখ্য তিরস্কার পাওয়া সাব ইন্সপেক্টর শহিদুল ইসলাম মোল্লা হচ্ছেন এ বিকল্প থানার কর্ণধার। অবৈধ চাঁদাবাজির ঘাঁটি পরিচালনায় মুখ্য ভূমিকা পালন করে থাকেন তারই সোর্স আনিসুর রহমান। তাদের নানারকম বাণিজ্যে অতিষ্ঠ হয়ে উঠেছে জনগণ। সামান্য অজুহাতে নিরীহ মানুষকে গ্রেফতার করে হাতিয়ে নেওয়া হচ্ছে লাখ লাখ টাকা।

মিথ্যা মামলা দিয়ে করা হচ্ছে হয়রানি। বিকল্প থানার কথিত চাঁদাবাজির ঘাঁটি থেকে আবাসিক হোটেল, মাদক বাণিজ্য, জুয়া, জায়গা-জমিসংক্রান্ত বিরোধ, অবৈধ দখলবাজি, ঝুট বাণিজ্যসহ অন্তত ২০টি খাতে বেপরোয়া চাঁদাবাজি চালানো হয়। তাদের মাসিক অবৈধ আয়ের পরিমাণ ৫০ লক্ষাধিক টাকা বলে জানা গেছে। ওই এলাকায় গার্মেন্ট কর্মীদের স্বল্পমূল্যে বসবাসের জন্য নির্মিত ডেরা ও মেসগুলোও চাঁদাবাজির কবল থেকে রেহাই পাচ্ছে না। ভুক্তভোগীরা জানান, হয়রানিসহ ভয়ভীতি প্রদর্শন করে ঘুষ বাণিজ্যও চলে দেদার। প্রতিদিনই নিরীহ মানুষকে গ্রেফতার করে নানারকম হয়রানি আর চাঁদাবাজির ফাঁদে ফেলা হচ্ছে। রাতে বিভিন্ন পয়েন্ট থেকে সন্দেহভাজন নাম দিয়ে আটক করে কিছু লোককে পুলিশের গাড়িতে তোলা হয়। তাদের থানায় না নিয়ে মোল্লার ঘাঁটিতে নিয়ে দরকষাকষি চলতে থাকে। মোটা অঙ্কের টাকা হাতিয়ে নিয়ে তবেই ছেড়ে দেওয়ার এন্তার অভিযোগ রয়েছে। কারও সঙ্গে দরদামে বনিবনা না হলে নিপীড়ন-নির্যাতন আর মিথ্যা মামলা দিয়ে কোর্টে চালান দেওয়া হয়। অনুসন্ধানে জানা গেছে, এসআই শহিদুল ইসলাম মোল্লা গত কয়েক দিনে শুধু ভাদাইল-জামগড়া থেকেই নয়জন নিরীহ লোককে আটক করে বেদম মারধর করে এবং প্রত্যেকের কাছ থেকে ৫০ থেকে ৭০ হাজার টাকা পর্যন্ত নিয়ে ছেড়ে দেন। খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, লিটন নামে থানার আরেক দালালের মাধ্যমে এসব টাকা আদায় করা হয়। আশুলিয়া-বাইপাইল এলাকার শতাধিক কলার আড়ত থেকে আড়ত প্রতি ২ হাজার টাকা, ৪৫টি ভাঙাড়ির দোকান থেকে প্রতি দোকান বাবদ সাড়ে ৩ হাজার টাকা, ২টি আবাসিক হোটেলসহ ১৩টি অস্থায়ী যৌনপল্লী থেকে আলাদা আলাদাভাবে দুই লক্ষাধিক টাকা, রাস্তার দুধারের শতাধিক অবৈধ দোকান থেকে দোকানপ্রতি ৩শ টাকা আদায় করা হচ্ছে। তবে মাসোহারার সবচেয়ে বেশি টাকা আদায় হয় মাদক স্পটগুলো থেকে। আশুলিয়ার বিভিন্ন স্থানে গজিয়ে ওঠা ২৫টি মাদক স্পট থেকেই প্রতি মাসে আদায় করা হচ্ছে সাড়ে ছয় লক্ষাধিক টাকা। ওই স্পটগুলো থেকে আশুলিয়ার প্রকৃত থানার ক্যাশিয়ারও পৃথকভাবে সমপরিমাণ মাসোহারা হাতিয়ে নেয় বলে জানা গেছে।

আশুলিয়া, নবীনগর, জামগড়া, জিরাবো, হেমায়েতপুর ও গাবতলী এলাকায় অবস্থিত আবাসিক হোটেলগুলোতে দিনে-রাতে অবাধে নারীদেহ ব্যবসার পাশাপাশি মাদকদ্রব্য, হেরোইন, ফেনসিডিল ও ইয়াবা ব্যবসা রমরমা চললেও দেখার কেউ নেই। অনুসন্ধানে জানা যায়, সাভার বাসস্ট্যান্ড (ওভারব্রিজ) সংলগ্ন নিরালা হোটেল, সাভার-ইন, ইউনাইটেড আবাসিক হোটেল ও আশুলিয়ার হোটেল স্বর্ণালী, জামগড়ার ডিফান্টাসি, হোটেল রিফাজ ও হোটেল গার্ডেন রোজ, মিলন ইন্টারন্যাশনাল আবাসিক হোটেলে দিনে রাতে নারীদেহ ব্যবসার সঙ্গে মাদক ব্যবসাও পুরোদমে চলছে বলে অভিযোগ উঠেছে। এসব আবাসিক হোটেলে নামমাত্র সাইনবোর্ড থাকলেও এর অন্তরালে চলছে মাদকদ্রব্য হেরোইন, ফেনসিডিল ও ইয়াবা ব্যবসাসহ জমজমাট নারীদেহ ব্যবসা। যার ফলে এসব এলাকায় দিন-দিন অবৈধ কর্মকাণ্ড বৃদ্ধি পাচ্ছে। এই হোটেলগুলোয় কোনো রেজিস্ট্রারের নিয়ম মানা হচ্ছে না। নামমাত্র রেজিস্ট্রার আছে তারও কোনো কার্যকারিতা নেই। প্রতিটি হোটেল মালিকই সুন্দরী মেয়েদের কাঁড়ি কাঁড়ি টাকার লোভ দেখিয়ে দেহ ব্যবসায় নামাচ্ছে। এসব দেহ বাণিজ্য কেন্দ্রের নিয়মিত বখরা আদায়কারী হিসেবে দারোগা শহিদুল ইসলাম মোল্লার নাম সবার মুখে মুখে। বিকল্প থানা গড়ে তুললেও এসআই শহিদুল ইসলাম মোল্লার বিরুদ্ধে টুঁ-শব্দটি করার উপায় নেই। আশুলিয়া থানার অফিসার ইনচার্জ থেকে শুরু করে ইন্সপেক্টররা পর্যন্ত সবাই মোল্লা দারোগাকে তোয়াজ করে চলতে বাধ্য হন। ডিআইজির আত্মীয় পরিচয় দিয়ে বেপরোয়া দাপট নিয়েই চলেন শহিদুল ইসলাম মোল্লা। মাত্র দু’বছরের মধ্যে ওয়ারেন্টের আসামি গ্রেফতার করে সাভার থানার ভিতর থেকে নিজ ক্ষমতায় ছেড়ে দেওয়া ও আশুলিয়া থানায় বিনা অপরাধে এক জনপ্রতিনিধিকে হাজতে আটকে রাখার অভিযোগে বিভাগীয় শাস্তির শিকার হন তিনি। জানা যায়, আশুলিয়ায় বদলি হয়ে আসার আগে শহিদুল ইসলাম মোল্লা পার্শ্ববর্তী সাভার থানায় সাব ইন্সপেক্টর ছিলেন। সেখানে বাবাকে জবাই করে হত্যা চেষ্টার অভিযোগে গোপালগঞ্জ সদর থানায় দায়ের করা মামলার আসামি জাহিদুল ইসলাম পাপ্পু (৩৫)-কে গ্রেফতার করা হয়। তবে ওয়ারেন্টের এ আসামিকে আটক করে থানায় আনার পর হাজতে না ঢুকিয়ে এসআই শহীদুল ইসলাম মোল্লা নিজ ক্ষমতায় ডিউটি অফিসার এসআই মাহফুজা খানমের সামনে চেয়ারে বসিয়ে রাখেন। ওই সময় কর্তব্যরত অফিসারকে ফাঁকি দিয়ে মধ্যরাতেই পালিয়ে যায় পাপ্পু। এ ঘটনায় দায়িত্বে অবহেলার কারণে ঢাকা জেলার পুলিশ সুপারের নির্দেশে উপ-পরিদর্শক (এসআই) শহীদুল ইসলাম মোল্লা ও উপ-পরিদর্শক (এসআই) মাহফুজা খানমকে ঢাকায় পুলিশ লাইনে প্রত্যাহার করা হয়। সাভার মডেল থানায় দায়িত্বকালীন হলমার্ক কেলেঙ্কারি সম্পৃক্ত যেসব মামলায় ফাইনাল রিপোর্ট দিয়ে চার দারোগা কোটিপতি হয়েছেন তাদের মধ্যেও শীর্ষস্থানে রয়েছে শহিদুল ইসলাম মোল্লার নাম। হলমার্কের বিরুদ্ধে জালিয়াতি প্রতারণা ও আত্মসাতের অভিযোগ তুলে মোসাঃ মাহাবুবা বেগম, স্বামী-ফরহাদ, সাং-২/ই এডি., ১/৩ মিরপুর-২, ডিএমপি বাদী হয়ে ৩১/০৩/১২ তারিখে যে মামলাটি (নং-৬৭) দায়ের করেন, তার চূড়ান্ত প্রতিবেদন দাখিল করেন এসআই শহিদুল ইসলাম মোল্লা। সাভার থানায় কর্তব্যকালে তিনি ডাকাত-ছিনতাইকারীদের মাইক্রো, প্রাইভেটকার দখল করে নিজের মতো করেই ব্যবহার করেছেন। সাভারের হেমায়েতপুর এলাকায় ছিনতাই করার সময় স্থানীয় ব্যক্তিদের তাড়া খেয়ে ছিনতাইকারীরা গাড়িটি (ঢাকা-মেট্রো-চ-৫৩-৩২৩৭) ফেলে রেখে পালিয়ে যায়। এ সময় বিক্ষুব্ধ জনতা হামলা চালিয়ে গাড়িটির পেছনের ও পাশের গ্লাস ভেঙে ফেলে। খবর পেয়ে সাভার থানার এসআই শহীদুল ইসলাম মোল্লা ঘটনাস্থলে গিয়ে মাইক্রোবাসটি উদ্ধার করে থানায় নিয়ে যান। গাড়িটি থানায় নেওয়ার কয়েক দিন পর মেরামত করে তা ব্যবহার করেন তিনি। অথচ নিয়মানুযায়ী মামলার আলামত হিসেবে আটক করা যানবাহনের আকার পরিবর্তন বা মেরামত করা পুলিশের কাজ নয়। এমনকি আলামত হিসেবে জব্দ বা আটক করা কোনো যানবাহন থানার বাইরে নেওয়া, ব্যবহার করা এবং আদালতের নির্দেশ ছাড়া হস্তান্তর করা অপরাধ। গুরুতর সব অভিযোগ সত্ত্বেও বারবারই অদৃশ্য ইশারায় তিনি নানা অভিযোগ থেকে রেহাই পেয়ে যান। শুধু অভিযোগমুক্ত থাকার মধ্যেই তার তত্পরতা সীমাবদ্ধ থাকেনি, বরং বিভাগীয় শাস্তি আর অসংখ্য তিরস্কার সত্ত্বেও ‘নিজের অনুকূলে আইজিপি পদক’ জুটিয়ে নেওয়ার মতো অসাধ্য কর্মও সম্পাদন করেছেন তিনি। এসব ব্যাপারে যোগাযোগ করা হলে এসআই শহিদুল ইসলাম মোল্লা বাংলাদেশ প্রতিদিনকে জানান, আইনশৃঙ্খলা নিয়ন্ত্রণের স্বার্থে বিকল্প থানা বিকল্প ক্যাম্প করলেও তা অবৈধ নয়। এটা ভালো কাজ হিসেবে স্বীকৃত বলেই আইজিপি পদক আমার ভাগ্যে জুটেছে। মাসোহারা আদায় করা প্রসঙ্গে তিনি বলেন, এটা থানার অফিসার ইনচার্জ তার ক্যাশিয়ারের মাধ্যমে তুলে থাকতে পারেন, আমি তোলার কে?

এই বিভাগের আরও খবর

সর্বশেষ খবর