মঙ্গলবার, ১২ এপ্রিল, ২০১৬ ০০:০০ টা

রূপপুর আলোকিত ২০২২-এ

পারমাণবিক বিদ্যুেকন্দ্রে রাশিয়ার পর সহায়তার হাত বাড়াচ্ছে ভারত

জিন্নাতুন নূর, রূপপুর থেকে ফিরে

রূপপুর আলোকিত ২০২২-এ

দ্রুত গতিতে এগিয়ে চলছে রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুেকন্দ্রের কাজ —বাংলাদেশ প্রতিদিন

বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান দেশ স্বাধীনের পর পারমাণবিক বিদ্যুেকন্দ্র নিয়ে যে স্বপ্ন দেখেছিলেন সে স্বপ্নকেই বাস্তব করে তুলছেন দেশের বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। যে বিদ্যুেকন্দ্রটির নির্মাণের উদ্যোগ শুরু হয়েছিল অর্ধ শতাব্দীরও আগে তা এখন এক দৃশ্যমান উন্নয়ন প্রকল্প। আগামী ছয় বছরের মধ্যেই দেশের তৈরি হতে যাওয়া একমাত্র এই পারমাণবিক কেন্দ্র থেকে বিদ্যুৎ উৎপাদন হতে যাচ্ছে। প্রকল্প সংশ্লিষ্টরা জানান, এর অংশ হিসেবে ১ হাজার ২০০ মেগাওয়াট ক্ষমতার পারমাণবিক বিদ্যুেকন্দ্রের প্রথম ইউনিট  ২০২২ সালে এবং একই ক্ষমতার দ্বিতীয় ইউনিটটি ২০২৩ সালে চালু হবে। আর সরকার প্রথম ও দ্বিতীয় ইউনিট বুঝে নেবে যথাক্রমে ২০২৩ ও ২০২৪ সালে। এই বিদ্যুেকন্দ্র থেকে উৎপন্ন প্রতি ইউনিট (এক কিলোওয়াট ঘণ্টা) বিদ্যুৎ-এর দাম পড়বে সাড়ে তিন টাকা। আর এই প্রকল্পে ব্যয় হবে এক লাখ কোটি টাকার কিছু বেশি। যা বাংলাদেশে এযাবৎ পর্যন্ত সর্বোচ্চ ব্যয়বহুল প্রকল্প। তথ্য অধিদফতর গত ৯ এপ্রিল পাবনার ঈশ্বরদী উপজেলায় অবস্থিত এই পারমাণবিক বিদ্যুেকন্দ্রের প্রকল্প এলাকা পরিদর্শনের আয়োজন করে। প্রকল্প কর্মকর্তারা জানান, এই বিদ্যুেকন্দ্রটি নির্মাণে রাশিয়ার পর এবার প্রতিবেশী দেশ ভারতও বাংলাদেশকে সহযোগিতা করতে যাচ্ছে। ভারত কনসালটেন্ট দেশ হিসেবে পারমাণবিক বিদ্যুেকন্দ্র বিষয়ে তাদের অভিজ্ঞতা বাংলাদেশের সঙ্গে ভাগাভাগি করে আমাদের সাহায্য করবে।

সরেজমিন প্রকল্প এলাকা পরিদর্শন করে দেখা যায়, বিশাল এলাকাটিতে নিশ্ছিদ্র নিরাপত্তা বলয়ের মধ্যে রাশিয়ান ও স্থানীয় কর্মকর্তা-কর্মচারীরা কাজ করছেন। এরই মধ্যে বেশ কিছু অবকাঠামোগত কাজ শেষ হয়েছে। যে জায়গায় চুল্লি স্থাপন হবে সেখানে বালু ও মাটি ফেলে স্থানটিকে কাজের উপযোগী করে গড়ে তোলা হচ্ছে। এক প্রেস বিফিং-এ সাংবাদিকদের জানানো হয়, একক উৎস থেকে বিদ্যুৎ প্রাপ্তি এবং বাংলাদেশের বিদ্যুৎ ঘাটতি মেটাতে এই বিদ্যুেকন্দ্র নির্মাণের উদ্যোগ নেওয়া হয়। চালুর পর এর লাইফ আয়ুকাল ধরা হচ্ছে ৮০ বছর। এই প্রকল্প বাস্তবায়নে রাশিয়া বাংলাদেশকে চার হাজার কোটি টাকা দেবে এবং বাংলাদেশ সরকার দেবে সাড়ে চারশ কোটি টাকা। বর্তমানে প্রকল্পের প্রথম পর‌্যায়ের কাজ (কর্মকর্তাদের অফিস নির্মাণ, আবাসন, ল্যাবরেটরি, বৃষ্টির পানি ধরে রাখার স্থান ইত্যাদি) মিলিয়ে প্রায় ৮০ শতাংশ কাজ শেষ হয়েছে। পুরো কাজ শেষ হবে আগামী ডিসেম্বরে। ২০১৭ সাল থেকে বিদ্যুেকন্দ্র নির্মাণের মূল কাজ শুরু হবে। বিদ্যুেকন্দ্রটি এক হাজার ৬২ একর জায়গায় প্রতিষ্ঠিত হবে।

প্রকল্প সংশ্লিষ্টরা জানান, মূল চুক্তিতে যাওয়ার আগে আরও চারটি বিষয়ে সই করতে হবে। এগুলো হলো— জ্বালানি সরবরাহ নিশ্চিত করা, পারমাণবিক বিদ্যুেকন্দ্রের বিপজ্জনক জ্বালানি বর্জ্য ফেরত নেওয়া, যে কোনো বিষয়ে চাহিদামতো সেবা নিশ্চিত করা এবং পারমাণবিক অবকাঠামো উন্নয়ন। এ ছাড়া আর্থিক চুক্তি বা ক্রেডিট এগ্রিমেন্টের বিষয়ে অগ্রগতি হয়েছে। আশা করা হচ্ছে এ মাসের শেষে এ বিষয়ে চুক্তি স্বাক্ষরিত হবে।

জানা যায়, বিদ্যুেকন্দ্রটি নির্মাণে রাশিয়া যে ঋণ দেবে তা ব্যয় হবে ধাপে ধাপে। প্রতিটি ধাপ শেষ হওয়ার পর ওই ধাপের অর্থ পরিশোধিত হবে।

বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি মন্ত্রণালয়ের সচিব মো. সিরাজুল হক খান জানান, এই বিদ্যুেকন্দ্র থেকে উত্পন্ন প্রতি ইউনিট বিদ্যুতের দাম পড়বে সাড়ে তিন টাকা। এ প্রকল্প বাস্তবায়নে রাশিয়া তিন বছর বাংলাদেশকে বিনামূল্যে তেল দেবে। এ ছাড়া তারা বাংলাদেশের তরুণ বিজ্ঞানীদের প্রশিক্ষণও দেবে।

রূপপুর পারমাণবিক কেন্দ্রের স্থানীয় প্রকল্প পরিচালক শৌকত আকবর বলেন, বিদ্যুেকন্দ্র নির্মাণে ভারত বাংলাদেশকে সহযোগিতা করবে। যেহেতু ভারতের পারমাণবিক বিদ্যুেকন্দ্র নির্মাণের অভিজ্ঞতা আছে। সে জন্য বাংলাদেশের সংশ্লিষ্টদের এ ব্যাপারে প্রশিক্ষণ দিয়ে ভারত বাংলাদেশকে সাহায্য করবে।

রাশিয়ার প্রকল্প পরিচালক পাভেল ভালসভ বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, বিদ্যুেকন্দ্র নির্মাণে আমরা ভিন্ন ধরনের রিঅ্যাক্টর ব্যবহার করছি। এ প্রকল্পে ব্যবহূত হচ্ছে রাশিয়ার তৈরি ‘ভিভিইআর-১২০০’ প্রযুক্তির পারমাণবিক রিঅ্যাক্টর। যা ‘থ্রি প্লাস’ জেনারেশনের প্রযুক্তি। এটি এখন পর্যন্ত সর্বাধিক নিরাপদ। আমরা নিরাপত্তাকে প্রাধান্য দিচ্ছি। যার ফলে দুর্ঘটনা সৃষ্টির আশঙ্কা থাকছে না। আমাদের ব্যবহূত রিঅ্যাক্টরটি মানুষের নিয়ন্ত্রণ ছাড়াই স্বাধীন ও স্বয়ংক্রিয়ভাবে কাজ করবে। তিনি আরও বলেন, আমরা আশা করছি ২০১৬ সালে আমরা অবকাঠামোগত নির্মাণকাজের প্রাথমিক পর‌্যায়ের কাজ শেষ করতে পারব। আমরা খুব কঠোরভাবে নির্মাণ কাজের সময়সূচি মেনে চলছি। আশা করছি সময়ের আগেই কাজ শেষ করতে পারব।

১৯৬১ সালে এই বিদ্যুেকন্দ্র নির্মাণের উদ্যোগ নেওয়া হয়। এরপর ১৯৬২-৬৮ সালে রূপপুরকে এই বিদ্যুেকন্দ্র নির্মাণের স্থান হিসেবে বেছে নেওয়া হয়। স্বাধীন বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান তখন ২০০ মেগাওয়াটের বিদ্যুেকন্দ্র নির্মাণের উদ্যোগ নেন। তারপর বিভিন্ন সময় পার হয়ে ২০১১ সালে রাশিয়া ও বাংলাদেশ সরকারের মধ্যে এই কেন্দ্র স্থাপন সংক্রান্ত সহযোগিতা চুক্তি স্বাক্ষর হয়।

সর্বশেষ খবর