রবিবার, ২২ মে, ২০১৬ ০০:০০ টা

সর্বত্রই দূষণ, নগর জীবন দুর্বিষহ

বিপর্যস্ত হচ্ছে পরিবেশ

সাঈদুর রহমান রিমন

সর্বত্রই দূষণ, নগর জীবন দুর্বিষহ

জলাধার ধ্বংস, পানিদূষণ, বায়ুদূষণ, শব্দদূষণ চলছেই। খোদ রাজধানী ঢাকায় রাসায়নিক বর্জ্যসহ ময়লা-আবর্জনার উন্মাতাল ছড়াছড়ি। আবাসিক এলাকার ঘন ঘিঞ্জি বসতির মধ্যেই চলছে পরিবেশ দূষণকারী কল-কারখানা। আবাদি জমি, ডোবা, নালা, জলাশয় সব ভরাট হয়ে যাচ্ছে। থেমে নেই মাটিদূষণ। ঢাকার মাটি ভরাট করা হয় নানা বর্জ্য ও পলিথিন দিয়ে। পলিথিন কখনো পচে না, পুড়িয়ে ফেললে বাতাস দূষিত হয়। ধূলিকণা, বালুকণা ও অন্যান্য ময়লা বাতাসে মিশে মুক্ত বাতাসের কথা যেন কল্পনাও করা যায় না। তাই ঢাকায় বায়ুবাহিত, পানিবাহিত, ছোঁয়াচে কোনো রোগেরই কমতি নেই। কল-কারখানার বিষোদ্গার, বিষাক্ত ধোঁয়া, জীবাণুযুক্ত পানীয় জল আর চারদিকে উত্কট গন্ধ— সব মিলিয়ে রাজধানী দিন দিন বসবাসের অনুপযোগী হয়ে পড়েছে। সৃষ্টি হচ্ছে ভারসাম্যহীন পরিবেশ। শুধু রাজধানী শহর ঢাকা নয়, অন্যান্য মহানগরীসহ দেশজুড়ে অবস্থা এক ও অভিন্ন। বৃক্ষ উজাড়, জমিতে রাসায়নিক সার ও কীটনাশক ব্যবহারের প্রবণতা বৃদ্ধির কারণে গ্রামাঞ্চলেও ছড়িয়ে পড়ছে পরিবেশদূষণের ব্যাপকতা। মানুষের জীবন হচ্ছে বিপন্ন। বিপন্ন হচ্ছে পশু-পাখিসহ সব শ্রেণির প্রাণিকুল।

পরিবেশদূষণের ক্ষেত্রে বিষাক্ত ধোঁয়া বিশেষ ভূমিকা রেখে চলেছে। শহর এলাকায় ত্রুটিপূর্ণ যানবাহন, কল-কারখানার বিষোদ্গার, ইটভাটার জনপদ। শুধু রাজধানীর আশপাশে রাজউকের নিষেধাজ্ঞা উপেক্ষা করে গড়ে উঠেছে প্রায় আড়াইশ ইটভাটা। আইন অমান্য করেই সেসব ভাটায় কয়লার পরিবর্তে দেদারসে চলছে জ্বালানি কাঠের ব্যবহার। অথচ আইন প্রয়োগকারী সংস্থাগুলো সংশ্লিষ্টদের বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা গ্রহণ করতে পারছে না। পরিবেশ ও বন মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা যায়, জ্বালানি কাঠের যথেচ্ছ ব্যবহারের বিরুদ্ধে কঠোর আইন প্রণয়নের জন্য আইন মন্ত্রণালয় বরাবর বিশেষ সুপারিশমালা পাঠানো হয়। জনগুরুত্বপূর্ণ এ সুপারিশমালার ভিত্তিতে আইন প্রণয়নের ক্ষেত্রে আইন মন্ত্রণালয় রীতিমতো গাফিলতি প্রদর্শন করে চলেছে বলে অভিযোগ পাওয়া গেছে।

কলুষিত ঢাকা : বায়ুদূষণ বন্ধে ২০০৩ সালে রাজধানীতে দুই স্ট্রোক ইঞ্জিনবিশিষ্ট বেবিট্যাক্সি চলাচল সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ করা হয়। ঢাকার পরিবেশদূষণের এটি একটি বড় কারণ ছিল। ২০০৩ সালে পেট্রল, ডিজেল ও গ্যাসচালিত যানবাহনে ক্যাটালাইটিক কনভার্টার, অক্সিডেশন ক্যাটালিস্ট ও ডিজেল পার্টিকুলেট ফিল্টার সংযোজন বাধ্যতামূলক করা হয়। সেসব আইনের সঠিক প্রয়োগ ও তদারকি না থাকায় এখন আবার দূষণ মারাত্মক পর্যায়ে পৌঁছেছে। এ ছাড়া রয়েছে ফিটনেসবিহীন যানবাহন। এসব ফিটনেসবিহীন বাসের প্রচণ্ড শব্দ ও ধোঁয়া ঢাকাকে করছে কলুষিত। ২০ বছরের পুরনো যানবাহনের বিরুদ্ধে অভিযান চললেও পুরনো গাড়ি নতুন রং করে চালানো হচ্ছে। ফলে শব্দ ও বায়ুদূষণের সমাধান হয়নি। এ ছাড়া নগরীতে কল-কারখানা, চারপাশে ইটভাটা, বিড়ি-সিগারেটের ধোঁয়া পরিবেশের ক্ষতি করছে। যতটা কার্বন ডাই-অক্সাইড নির্গমিত হয়, ততটা অক্সিজেন পাওয়া যায় না। তাই ঢাকার বাতাসে অক্সিজেন ঘাটতির পাশাপাশি রয়েছে সিসা। মড়ার ওপর খাঁড়ার ঘা হয়ে উঠেছে আবাসিক এলাকার মধ্যে বিভিন্ন রাসায়নিক কারখানা ও গুদাম।

বায়ুদূষণে বিপর্যয় : রাজধানী ঢাকা এখন মাত্রাতিরিক্ত বায়ুদূষণ বিপর্যস্ত। ত্রুটিপূর্ণ যানবাহনের কারণেই বায়ুদূষণ বেশি হচ্ছে। রিকন্ডিশন্ড ও দুর্বল ইঞ্জিনবিশিষ্ট পুরনো বাস-ট্রাক থেকে সহনীয় মাত্রার চেয়ে অনেক বেশি কালো ধোঁয়া ও বিষাক্ত গ্যাস নির্গত হচ্ছে। এ ছাড়া শিল্প-কারখানার ধোঁয়া, ট্যানারিশিল্প, গার্মেন্ট ফ্যাক্টরি, রি-রোলিং মিলের বর্জ্য, রাসায়নিক, ওষুধশিল্প ও মেটাল ওয়ার্কস বায়ুদূষণের অন্যতম কারণ। ইটভাটা, ব্রেড-বিস্কুট কারখানায় পোড়ানো কাঠ থেকে সৃষ্ট ধোঁয়া জনাকীর্ণ এলাকায় নানা বিপন্নতার সৃষ্টি করছে। হাইড্রোজেন, সালফাইড, অ্যামোনিয়া, ক্লোরিনসহ বিভিন্ন কেমিক্যালযুক্ত নির্গত ধোঁয়ার কারণে লোকজন মাথাব্যথা ও অন্যান্য স্বাস্থ্যগত সমস্যার শিকার হচ্ছে। পরিবেশ অধিদফতরের এয়ার কোয়ালিটি ম্যানেজমেন্ট প্রজেক্ট পরিচালিত গবেষণা প্রতিবেদন সূত্রে জানা যায়, বায়ুমণ্ডলের প্রতি ঘন মিটারে মাত্র ৪০০ মাইক্রোগ্রাম দূষণকণা গ্রহণযোগ্য বলে বিবেচিত। অথচ ঢাকার বিভিন্ন স্থানে বাতাসে বিদ্যমান দূষণকণার ঘনত্ব প্রতি ঘন মিটারে ৩ হাজার মাইক্রোগ্রাম ছাড়িয়ে গেছে। পরিবেশ বিশেষজ্ঞরা জানিয়েছেন, ধুলা-ধোঁয়ায় যতটা কার্বন ডাই-অক্সাইড নির্গমিত হয়, ততটা অক্সিজেন পাওয়া যায় না। ঢাকার বাতাসে অক্সিজেন ঘাটতির পাশাপাশি প্রতিবছর সিসা যুক্ত হচ্ছে ৫০ টনেরও বেশি। পরিবেশ অধিদফতরের এয়ার কোয়ালিটি ম্যানেজমেন্ট প্রজেক্ট পরিচালিত গবেষণা সূত্রে জানা যায়, দূষণের এ ভয়াবহতায় দেশে প্রতিবছর মাতৃগর্ভেই মারা যায় প্রায় চার হাজার শিশু। দূষণজনিত নানা রোগে অকালে প্রাণ হারায় আরও প্রায় ২০ হাজার মানুষ।

শব্দদূষণ রোধে কথা হয় বেশি : শব্দদূষণে অসহনীয় হয়ে উঠেছে রাজধানীর জনজীবন। গাড়ির তীব্র হর্ন, মাইকের আওয়াজ, উচ্চমাত্রার মিউজিক আর নানা হুইসেলের শব্দে নগরবাসীর ত্রাহি অবস্থা। আইন উপেক্ষা করে যানবাহনগুলোয় অবাধে ব্যবহূত হচ্ছে হাইড্রলিক হর্ন। যানজটে অবরুদ্ধ থাকাবস্থায় বা মধ্যরাতের ফাঁকা রাস্তায়ও অবিরাম বেজে চলে অ্যাম্বুলেন্সের হুইসেল। আবাসিক এলাকার পাশেই গড়ে তোলা কল-কারখানার হুইসেলেও আঁতকে উঠতে হয় ঘুমন্ত মানুষকে। বিদ্যুত্ সমস্যা থেকে রক্ষায় মহল্লায় মহল্লায় বসানো উচ্চক্ষমতার জেনারেটরের বিরক্তিকর শব্দও আরেক যন্ত্রণাময় পরিবেশের সৃষ্টি করেছে। নগরীতে এমন বহুবিধ উচ্চমাত্রার শব্দের কারণে রক্তচাপ, মাথাব্যথা, বদহজম, পেপটিক আলসার, কানে কম শোনা, হূদরোগসহ বিভিন্ন রোগের ঝুঁকি বেড়ে যাচ্ছে বলে বিশেষজ্ঞরা জানিয়েছেন। পরিবেশ সংরক্ষণ বিধিমালায় নীরব, আবাসিক, মিশ্র, বাণিজ্যিক ও শিল্প এলাকা হিসেবে পাঁচটি ‘পৃথক এলাকা’ নির্ধারণ করা হয়েছে। এসব এলাকায় শব্দের সহনীয় মাত্রাও আলাদাভাবে নির্ধারণ করে দেওয়া আছে। নীরব এলাকায় শব্দের ধার্যকৃত মাত্রা হচ্ছে দিনে ৪৫ ও রাতে ৩৫ ডেসিবল। আবাসিক এলাকায় এ মাত্রা দিনে ৫০ ও রাতে ৪০ ডেসিবল। আইন অনুযায়ী হাসপাতাল, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানসহ নির্ধারিত কিছু প্রতিষ্ঠান থেকে ১০০ মিটার দূরত্ব পর্যন্ত নীরব এলাকা হিসেবে চিহ্নিত। সেখানে গাড়ির হর্ন বা মাইকিং সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ। অথচ সেসব স্থানে ৮০-৮৫ ডেসিবলেরও বেশি ‘শব্দ’ থাকছে হামেশা। শব্দসংক্রান্ত নিষেধাজ্ঞা অমান্য যে শাস্তিযোগ্য অপরাধ, সে তথ্যটিও জানা নেই অনেকের।

শব্দের উত্সসমূহ : সচেতনতার অভাব এবং সঠিকভাবে আইন বাস্তবায়ন না করার কারণেই শব্দদূষণ দিন দিন বাড়ছে বলে বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর গবেষণা প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে। গবেষণায় দেখা যায়, গাড়ির হর্ন শব্দদূষণের প্রধান উত্স। এ ছাড়া ৬১ শতাংশ মাইকিং, ৪৫ শতাংশ মোটরগাড়ি, ৩৫ শতাংশ কল-কারখানা, ১৯ শতাংশ ইটভাঙার মেশিন, ১৩ শতাংশ সমাবেশ এবং ৪ শতাংশ অন্যান্য কারণে অতিশব্দের সূত্রপাত ঘটে। গাড়ির তীব্র হর্ন বেশ বিরক্তিকর। তবু চালকরা প্রতিনিয়ত তীব্র হর্ন বাজিয়েই গাড়ি চালান। অনেকে হাইড্রলিক হর্ন ব্যবহার করেন, যা কানের জন্য খুবই মারাত্মক।

আইন আছে প্রয়োগ নেই : শব্দদূষণ আইন নিয়ন্ত্রণে বিভিন্ন আইন থাকলেও তা প্রয়োগ হচ্ছে না। শব্দদূষণের অপরাধে প্রথমবারের মতো তিন মাস পর্যন্ত কারাদণ্ড অথবা ২ হাজার টাকা জরিমানা হতে পারে। দ্বিতীবারের মতো এ অপরাধ করলে ছয় মাসের কারাদণ্ড বা ৫ হাজার টাকা জরিমানার বিধান আছে। মোটরযান অধ্যাদেশেও অনেক ধারা রয়েছে, কিন্তু এর বেশির ভাগই প্রয়োগ হচ্ছে না। সরকার আসে সরকার যায়, কিন্তু ঢাকার বাতাসে সিসার পরিমাণ বেড়েই চলে।

অধিদফতর শুধু ‘সতর্ক’ করে : শব্দদূষণ রোধে পরিবেশ অধিদফতর কঠোর পদক্ষেপ নেওয়ার ব্যাপারে কয়েক দফা ঘোষণা দিয়েও তা কার্যকর করতে পারেনি। অধিদফতর থেকে বলা হয়, মোবাইল কোর্ট ও ট্রাফিক পুলিশের মাধ্যমে শব্দদূষণ সৃষ্টিকারীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হবে। পরিবেশ অধিদফতরের মহাপরিচালক নিজেও শব্দদূষণকে নীরব ঘাতক হিসেবে চিহ্নিত করে বলেছেন, জনবলসহ নানা সীমাবদ্ধতার মধ্যেও সব ধরনের দূষণের বিরুদ্ধে পরিবেশ অধিদফতর ভূমিকা রেখে চলেছে।

সর্বশেষ খবর