শনিবার, ২৫ জুন, ২০১৬ ০০:০০ টা

রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে ৪১ খুন অন্ধকারে তদন্ত রিপোর্ট

কাজী শাহেদ ও জয়শ্রী ভাদুড়ী, রাজশাহী

১৯৬৯ সালের ১৮ ফেব্রুয়ারি গণঅভ্যুত্থানের সময় পাকিস্তানি বাহিনীর হাত থেকে ছাত্রদের বাঁচাতে বুকের রক্ত ঢেলে দিয়েছিলেন রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের (রাবি) শিক্ষক ড. শামসুজ্জোহা। এরপর মুক্তির সংগ্রামে শিক্ষক-শিক্ষার্থী, কর্মকর্তা-কর্মচারীদের রক্তে ভিজে উঠেছে সর্বোচ্চ এই বিদ্যাপীঠ।

স্বাধীনতা পরবর্তীতে ১৯৭৬ সালে রাবি শিক্ষার্থী নীহার বানু হত্যাকাণ্ডের নৃশংসতায় কেঁপে ওঠে পুরো দেশ। ২৭ জানুয়ারি নিখোঁজ হওয়ার প্রায় ছয় মাস পর নাটকীয়ভাবে সামনে আসে নীহার বানু হত্যাকাণ্ডের বীভৎসতা। প্রেমের প্রস্তাবে সাড়া না দেওয়ায় তারই তিন সহপাঠী মিলে খুন করে লাশ ট্রাঙ্কে করে পুঁতে রেখেছিল বিশ্ববিদ্যালয়ের অদূরে মিনা মঞ্জিল নামের বাড়ির উঠানের এক কোণে। এই হত্যামামলায় মূল আসামি আহমেদ হোসেন বাবুসহ ফাঁসির দণ্ডপ্রাপ্ত দুই আসামি আজও পলাতক। তবে, একজনের মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করা হয়েছে।

এরপর ১৯৮২ সাল থেকে রাজনৈতিক প্রতিহিংসায় বাড়তে থাকে খুনের মিছিল। এই ৩৭ বছরে ৪০ জনের রক্তে ভিজে যায় মতিহারের সবুজ চত্বর। এর মধ্যে ছাত্রলীগের ৭ জন, ছাত্র শিবিরের ১৬ জন, জাসদ ছাত্রলীগের ৭ জন, ছাত্রদলের ৩ জন, ছাত্রমৈত্রীর ২ জন ও ছাত্র ইউনিয়নের একজন। এ সময়ে হত্যাকাণ্ডের শিকার হয়েছেন বিশ্ববিদ্যালয়ের চার শিক্ষকও। এ ছাড়া নিহতের তালিকায় আছেন নিরীহ, হকার ও সাধারণ শিক্ষার্থী। এসব হত্যাকাণ্ডের সুষ্ঠু তদন্তের আশ্বাসে কমিটি গঠন হলেও আলোর মুখ দেখেনি তদন্ত প্রতিবেদন। আবার রাজনৈতিক পট পরিবর্তনে দলীয় বিবেচনায় ছেড়ে দেওয়া হয়েছে দোষীদের। তাই সুষ্ঠু বিচার কখনো পায়নি নিহতের পরিবার। বিশ্ববিদ্যালয় সূত্রে জানা যায়, ২০১৪ সালের ১৫ নভেম্বর বিশ্ববিদ্যালয় সংলগ্ন চৌদ্দপাই এলাকায় নিজ বাসার সামনে খুন হন সমাজবিজ্ঞান বিভাগের শিক্ষক শফিউল ইসলাম লিলন। এই মামলার প্রধান আসামি যুবদল নেতা আনোয়ার হোসেন উজ্জ্বল দীর্ঘদিন পলাতক থাকার পর গত মে মাসে আত্মসমর্পণ করে জামিনে আছেন। ওই বছরেই নিজ কক্ষে গুলিবিদ্ধ হন শহীদ সোহরাওয়ার্দী হল শাখা ছাত্রলীগের সাবেক যুগ্ম-সাধারণ সম্পাদক রুস্তম আলী আকন্দ। তিনি রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের শিক্ষার্থী ছিলেন। হল কমিটিকে কেন্দ্র করে প্রতিপক্ষের হামলায় তিনি নিহত হন। এর আগে ২০০৬ সালের ১ ফেব্রুয়ারি ভূ-তত্ত্ব ও খনিবিদ্যা বিভাগের প্রফেসর ড. এস তাহের আহমেদ বিশ্ববিদ্যালয়ের আবাসিক এলাকা থেকে নিখোঁজ হন। এর দুই দিনপর তার বাসার পেছনের সেফটিক ট্যাংক থেকে তার লাশ উদ্ধার করা হয়। হত্যাকাণ্ডে জড়িত থাকার দায়ে বিভাগের সহকর্মী, শিবির নেতাসহ চারজনের মৃত্যুদণ্ডাদেশ দেন আদালত। আসামিরা রায়ের বিরুদ্ধে উচ্চ আদালতে আপিল করলে একই বিভাগের শিক্ষক ড. মিয়া মো. মহিউদ্দিন এবং ড. তাহেরের বাসার তত্ত্বাবধায়ক মো. জাহাঙ্গীর আলমের মৃত্যুদণ্ড বহাল রাখেন হাইকোর্ট। ২০০৪ সালে ২৪ ডিসেম্বর প্রাতঃভ্রমণে বের হলে বিশ্ববিদ্যালয় সংলগ্ন বিনোদপুরে নিজ বাস ভবনের সামনে খুন হন অর্থনীতি বিভাগের আওয়ামী ঘরানার শিক্ষক অধ্যাপক ড. ইউনুস। ওইদিন তার ছোট ভাই আবদুল হালিম নগরীর মতিহার থানায় মামলা করেন। সিআইডি এ মামলার তদন্ত শেষে আট জেএমবি সদস্যকে আসামি করে আদালতে চার্জশিট দেয়। পরে ২০১০ সালের ২ জানুয়ারি ছয়জনকে বেকসুর খালাস দিয়ে দুই আসামির মৃত্যুদণ্ডাদেশ বহাল রাখেন রাজশাহীর দ্রুত বিচার ট্রাইব্যুনাল। আর সর্বশেষ চলতি বছরের ২৩ এপ্রিল বাড়ি থেকে ১০০ গজ দূরে বিশ্ববিদ্যালয়ে আসার পথে খুন হন ইংরেজি বিভাগের শিক্ষক প্রফেসর ড. রেজাউল করিম সিদ্দিকী। শিক্ষক হত্যাকাণ্ডের পাশাপাশি শিক্ষার্থী খুনের নজিরও কম নেই রাবি ক্যাম্পাসে। ২০১২ সালে পদ্মা সেতুর টাকা ভাগাভাগিকে কেন্দ্র করে সভাপতি আহমেদ আলী মোল্লা এবং সাধারণ সম্পাদক আবু হুসাইন বিপু গ্রুপের কর্মীদের গোলাগুলি হয়। এতে ছাত্রলীগ কর্মী আবদুল্লাহ আল হাসান সোহেল নিহত হন। ২০১০ সালের ৮ ফেব্রুয়ারি রাতে বিশ্ববিদ্যালয়ের বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান হল দখলকে কেন্দ্র করে শিবিরের ক্যাডাররা ছাত্রলীগের নেতা-কর্মীদের ওপর সশস্ত্র হামলা চালায়। এই সংঘর্ষে শিবিরের ক্যাডাররা বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রলীগের কর্মী ও গণিত বিভাগের শিক্ষার্থী ফারুক হোসেনকে নির্মমভাবে খুন করে লাশ শাহ মখদুম হলের পেছনের ম্যানহলে ফেলে রাখে। একই রাতে শিবির ক্যাডাররা আরও তিন ছাত্রলীগ কর্মীর হাত ও পায়ের রগও কেটে দেয়। এরা হলেন বাংলা বিভাগের সাইফুর রহমান বাদশা, ব্যবস্থাপনা বিভাগের ফিরোজ মো. আরিফুজ্জামান ও রুহুল আমীন লেলিন। আসাদুর রহমান নামের আরেক ছাত্রলীগ কর্মীকে শিবির ক্যাডাররা হাতুড়ি দিয়ে মাথায় আঘাত করে। এ ঘটনার পর থেকে তিনি অন্ধ। ২০১২ সালের ৩০ জুলাই রাজপাড়া থানার তৎকালীন ওসি জিল্লুর রহমান চিফ মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট আদালতে ফারুক হত্যামামলার চার্জশিট দাখিল করেন। চার্জশিটে জামায়াতের আমির মতিউর রহমান নিজামী, সেক্রেটারি জেনারেল আলী আহসান মুহাম্মদ মুজাহিদ, নায়েবে আমির দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদীসহ ১১০ জনকে অভিযুক্ত করা হয়। একই বছরের ১৫ আগস্ট ছাত্রলীগ কর্মী নাসরুল্লাহ নাসিমকে মারপিটের পর দোতলা থেকে ফেলে দেন তার দলের কর্মীরা। ৯ দিন মৃত্যু শয্যায় থেকে ঢাকা মেডিকেলে মারা যান নাসিম। ২০০৯ সালের ১৩ মার্চ বিনোদপুরে ছাত্রলীগ, শিবির এবং বিনোদপুর বাজারের ব্যবসায়ীদের ত্রিমুখী সংঘর্ষে শিবিরের বিশ্ববিদ্যালয় শাখার সাধারণ সম্পাদক শরীফুজ্জামান নোমানী নিহত হন। ১৯৮২ সালের ১১ মার্চ প্রগতিশীল ছাত্র সংগঠনের সঙ্গে সংঘর্ষে চার শিবির কর্মী ও একজন ছাত্রলীগ নেতা নিহত হন। ১৯৮৮ সালে রাজশাহী মেডিকেল কলেজ ক্যাম্পাসে প্রকাশ্যে শিবিরকর্মীরা রগ কেটে ও খুঁচিয়ে খুঁচিয়ে হত্যা করে ছাত্রমৈত্রীর নেতা জামিল আকতার রতনকে। এসব হত্যাকাণ্ডের পর বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের গঠন করা তদন্ত কমিটির রিপোর্ট নিয়ে অবশ্য কোনো মন্তব্য করতে রাজি হননি দায়িত্বশীলরা।

সর্বশেষ খবর