শনিবার, ২৫ জুন, ২০১৬ ০০:০০ টা
প্রকৃতি

মৃত্যুর মুখে লাউয়াছড়ার ২৫ হাজার গাছ

দীপংকর ভট্টাচার্য লিটন, শ্রীমঙ্গল (মৌলভীবাজার)

মৃত্যুর মুখে লাউয়াছড়ার ২৫ হাজার গাছ

মৃত্যুর মুখে দাঁড়িয়ে আছে মৌলভীবাজারের লাউয়াছড়া জাতীয় উদ্যানের ২৫ হাজার গাছ। নির্বিঘ্নে ট্রেন চলাচল ও দুর্ঘটনা এড়াতে লাউয়াছড়া জাতীয় উদ্যানের ভিতর রেল লাইনের দুই পাশের গাছ কাটতে বন্যপ্রাণী ব্যবস্থাপনা ও প্রকৃতি সংরক্ষণ বিভাগকে চিঠি দিয়েছে বাংলাদেশ রেলওয়ে। আর এতে করে প্রাণ সংশয়ে পড়েছে বনের ওই গাছগুলো। রেলওয়ের পরিকল্পনা বাস্তবায়িত হলে সংরক্ষিত এ বনাঞ্চলের ২৫ হাজারেরও বেশি গাছ কাটা পড়বে বলে জানিয়েছে বন বিভাগ (বন্যপ্রাণী ব্যবস্থাপনা ও প্রকৃতি)। গবেষকরা বলছেন, রেলওয়ের এ সিদ্ধান্তটি প্রকৃতিবিরোধী ও পরিবেশ আইনের লঙ্ঘন। যদি লাউয়াছড়ার একটি গাছও কাটা হয় তাহলে তা হবে বন্যপ্রাণীদের জন্য হুমকিস্বরূপ। আর যদি বিপুলসংখ্যক এ গাছ কাটা পড়ে তাহলে শুধু বনাঞ্চলের জীববৈচিত্র্য ও পরিবেশই ক্ষতিগ্রস্ত হবে না, একই সঙ্গে এ বনকে আঁকড়ে ধরে বেঁচে থাকা আদিবাসীদের জীবন-জীবিকাও হুমকির মুখে পড়বে। বন্যপ্রাণী ব্যবস্থাপনা ও প্রকৃতি সংরক্ষণ বিভাগ সূত্রে জানা গেছে, ৯ এপ্রিল বাংলাদেশ রেলওয়ের বিভাগীয় প্রকোশলী-২ মো. আরমান হোসেন একটি চিঠি দিয়ে বলেছেন, ঢাকা-সিলেট রেল লাইনের শ্রীমঙ্গল-ভানুগাছ সেকশনের ২৯৩/১ থেকে ২৯৮/১ কিলোমিটারের পাহাড়ি এলাকায় ঝড়-বৃষ্টিতে গাছ উপড়ে ও ভেঙে রেল লাইনের ওপর পড়ছে। এতে যে কোনো সময় দুর্ঘটনা ও যাত্রী সাধারণের প্রাণহানি ঘটতে পারে। চিঠিতে বলা হয়, গত বছর ২১ এপ্রিল রাতে ঝড়ে ৩০-৩৫টি গাছ রেল লাইনের ওপর ভেঙে পড়ে ট্রেন চলাচল ব্যাহত হয়। এ ছাড়া চলতি বছর ৭ এপ্রিল রাতে ঝড়ে আরও ৩০টির মতো গাছ রেল লাইনের ওপর পড়ে। এতে উপবন এক্সপ্রেসের ইঞ্জিনের একটি হেডলাইট ভেঙে যায় ও ট্রেনটি আটকা পড়ে। এ অবস্থায় উদ্যান এলাকার রেল লাইনের উভয় পাশের ন্যূনতম ৫০ ফুট পর্যন্ত গাছ কাটতে হবে। একইভাবে রেললাইনের রশিদপুর-সাতগাঁও বিভাগের ২৭১/২ থেকে ২৭৯/৭ কিলোমিটার পর্যন্ত উভয় পাশের গাছও কাটতে হবে। নইলে পরবর্তী সময়ে কোনো দুর্ঘটনা ঘটলে ‘দ্য রেলওয়েজ অ্যাক্ট, ১৮৯০’-এর ১২৮ ধারা মোতাবেক পদক্ষেপ নেওয়া হবে। রেলওয়ের এ চিঠির জবাব দিয়ে ১২ মে বন্যপ্রাণী ব্যবস্থাপনা ও প্রকৃতি সংরক্ষণ বিভাগের বিভাগীয় বন কর্মকর্তা মিহির কুমার দে জানিয়েছেন, মৌলভীবাজারের লাউয়াছড়া উদ্যানটি ১৬৭ প্রজাতির বৃক্ষ, ২৪৬ প্রজাতির পাখি, ২০ প্রজাতির স্তন্যপায়ীসহ অসংখ্য বিরল ও বিপন্ন প্রজাতির প্রাণী-উদ্ভিদের আবাসস্থল। এর ভিতর শ্রীমঙ্গল-ভানুগাছ সেকশনের রেল লাইনের ২৯৩/১ থেকে ২৯৮/১ এই পাঁচ কিলোমিটারের উভয় পাশে ৫০ ফুট এলাকার মধ্যে জরিপে দেখা গেছে, এখানে শতবর্ষী ও তার অধিক বয়সী ২৫ হাজারের বেশি গাছ আছে। এ ছাড়া এই এলাকার প্রতি বর্গমিটারে আছে ২০টি করে চারাগাছ ও অন্যান্য লতাপাতা-ঝোপঝাড়, যেখানে বিভিন্ন প্রজাতির অসংখ্য বন্যপ্রাণী বাস করে। এসব গাছ কাটা হলে বনাঞ্চলের জীববৈচিত্র্য ও পরিবেশ মারাত্মক হুমকির মুখে পড়বে। বন বিভাগের ওই চিঠির পর ১৮ মে আবারও রেলওয়ে থেকে বন কর্মকর্তাকে আরেকটি চিঠি দিয়ে বলা হয়েছে, রেলপথের উভয় পাশের গাছপালা কাটার অনুরোধ জানানো হলেও এ বিষয়ে কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি। আগামী সাত কার্যদিবসের মধ্যে গাছগুলো না কাটলে রেলওয়ে আইন অনুযায়ী রেল কর্তৃপক্ষ ব্যবস্থা নেবে। যদিও গত শনিবার পর্যন্ত রেলওয়ের পক্ষ থেকে গাছ কাটার কোনো উদ্যোগ নেওয়া হয়নি। বাংলাদেশ রেলওয়ে ঢাকার বিভাগীয় প্রকৌশলী আরমান হোসেন বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, ‘বন বিভাগকে দেওয়া আমাদের চিঠির মেয়াদ শেষ হয়ে গেছে। তাই আমাদের উদ্যোগেই গাছ কাটার বিষয়টি এখন প্রক্রিয়াধীন আছে।’ প্রাণ ও প্রতিবেশ বিষয়ক গবেষক পাভেল পার্থ বলেন, ‘বিশ্বের কোথাও সংরক্ষিত বনের ভিতর রেল লাইন নেই। যেহেতু আমাদের দেশে এটি আছে, তাই এই বনভূমির ভিতর যতটুকু রেল লাইন রয়েছে সেই পরিমাণ একটি টানেল তৈরি করা যেতে পারে। তাহলে গাছ কাটার প্রয়োজন হবে না। আর ঝড়ে কোনো গাছ পড়লে ওই টানেলের ওপর পড়বে। তখন ট্রেনের কোনো ক্ষতি হবে না। আর যদি তা না করা হয় তাহলে অবশ্যই রেল লাইনটি অন্যদিকে সরিয়ে নিতে হবে। গাছ কেটে রেল লাইন রক্ষার কোনো মানে হয় না।’

সর্বশেষ খবর