তাদের নিষ্ঠুর আচরণ যেন কল্পনাকেও হার মানায়। গ্রামের সহজ-সরল মানুষকে বিদেশে নিয়ে গিয়ে জিম্মি করছে আন্তর্জাতিক মানব পাচারকারী চক্র। করছে অমানুষিক নির্যাতন আর নির্যাতিতের দেশে বসবাসকারী স্বজনদের কাছ থেকে হাতিয়ে নিচ্ছে কাঁড়ি কাঁড়ি টাকা। এমনই হতাভাগাদের একজন নাটোরের নলডাঙ্গা উপজেলার মো. মিন্টু আলী খান। বহু চড়াই-উতরাই ডিঙিয়ে মিন্টু দেশে ফেরার পর দুর্নীতিগ্রস্ত কিছু পুলিশ সদস্যকে নিয়ে পাচারকারী চক্রটি ফের মিন্টুকে অপহরণ করতে চেয়েছিল। সৌভাগ্যক্রমে র্যাবের উপস্থিতির কারণে বেঁচে যান তিনি। হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর থেকে মিন্টুকে উদ্ধার এবং ওই চক্রের দুই সদস্যকে গ্রেফতার করে র্যাব। জানা গেছে, দালাল চক্র গত অক্টোবরে মিন্টুকে লিবিয়া নিয়ে যায়। সেখানে নেওয়ার পরই ওরা আবির্ভূত হয় নরপিশাচের ভূমিকায়। মিন্টুর নির্যাতনের ভিডিও দেখিয়ে তার স্বজনদের ব্ল্যাকমেইল করে। কয়েক দফায় হাতিয়ে নেয় মোটা অঙ্কের মুক্তিপণ। টানা ৪০ দিনের নির্যাতনের চিহ্ন মিন্টুর শরীরে স্পষ্ট। দগদগে ঘা এখনো শুকায়নি। মিন্টুর প্রাণ বাঁচাতে নিজেদের শেষ সম্বলটুকুও বিক্রি করে দিয়েছেন স্বজনরা। গতকাল মিন্টুর সঙ্গে কথা হয় এই প্রতিবেদকের। তার বাবার নাম মনতাজ আলী খান। বাড়ি নলডাঙ্গা উপজেলার সোমসখুলশী গ্রামে। কথা বলার একপর্যায়ে হাউমাউ করে কাঁদতে শুরু করেন মিন্টু। কিছু সময় পর নিজেকে সংযত করে আবার বলতে শুরু করেন। ‘ভাই, ৪০ দিন পর দেশে আওনের পর এয়ারপোর্ট থেকে পুলিশ নিয়া আমারে কিডন্যাপ করতে আইছিল হেরা। পুলিশ আনোয়ার ও পুলিশ বাবুল এয়ারপোর্টের ভিতর থাইক্যাই আমারে জোর কইর্যা তাদের লগে যাইতে কইছিল। র্যাব থাকায় এই যাত্রায় বাঁইচ্যা গেছি।’ মিন্টু বলেন, ২০১২ সালে প্রথমে তিনি ভিসা নিয়ে লিবিয়া যান। আয়-রোজগার করছিলেন ভালোই। ২০১৪ সালে টাকা পাঠাতে না পারায় নোয়াখালীর বেলাল আহমদের কাছে ২ লাখ ১৩ হাজার টাকা রেখে দেশে চলে আসেন। ওই সময় লিবিয়ায় ব্যাংক বন্ধ ছিল। মিন্টু বলেন, ‘বেলালরে আমি মামা কইতাম। তার বয়স ৫৫-এর মতো। দেশে আসার পর বহুবার তাকে ফোন দিছি। দেই-দিচ্ছি করে হে আমারে কোনো টাকা দেয় নাই। সবশেষ অক্টোবর মাসে বেলাল আমাকে ফোন দিয়ে ঢাকায় রুবেলের সঙ্গে দেখা করতে কয়। আমি ১ হাজার টাকা ধার কইর্যা ঢাকায় আসি। তখন রুবেল আমারে আনোয়ার নামে তার ভাগ্নের মোবাইল নম্বর দেয়। তার সঙ্গে দেখা করতে কয়। কিছু সময় পর আনোয়ারসহ চার-পাঁচ জন লোক ঢাকায় নামার সঙ্গে সঙ্গেই আমারে চিটাগংয়ের বাসে ওঠায়। কয়, চিটাগং গেলেই টাকা দেওয়া হবে।’ তারপর কী হলো? মিন্টু বলেন, চট্টগ্রামে বিআরডিএস হোটেলে নেওয়ার পর তিনি দেখেন আরও ১৫-২০ জন লোক সেখানে। রমজান নামে এক ব্যক্তি একটি পাসপোর্ট দিয়ে মিন্টুকে সোজা বিমানবন্দরে গিয়ে উড়োজাহাজে তুলে দেন। পাসপোর্ট কোথা থেকে এলো? মিন্টু জানান, লিবিয়ায় থাকার সময় তিনি তার পাসপোর্টের ফটোকপি বেলালকে দিয়ে এসেছিলেন। কয়েকটি ছবিও তার কাছে দিয়েছিলেন। তিনি বলেন, ‘ওরাই আমার পাসপোর্ট বানাইছে। দুবাইর বিমানে (ফ্লাই দুবাই) আমারে তুইল্যা দেয়। প্রথমে যাই দুবাই। সেখান থেকে আম্মান। এরপর ইস্তানবুল। সবশেষে আমাগো লইয়্যা আসে ত্রিপোলি। টানা তিন দিন আমাগের এক ফোঁটা পানিও দেয় নাই। ইস্তানবুল আওনের পর এক লোক আমাগের সাদা গেঞ্জি পরাইয়া দেয়। সেখানে দেহি আরও ৫০-৬০ জন বাংলাদেশি। আমাদের এক বিমানে কইর্যাই লিবিয়ায় আনা হয়। তবে চট্টগ্রাম থেকে আসা ১৫ জনরে এক কালারের গেঞ্জি পরিয়ে দেওয়া হয়।’ নির্যাতনের বিষয়ে একটু বলবেন? এ কথা বলার সঙ্গে সঙ্গেই আবার হাউমাউ করে কান্না শুরু করেন মিন্টু। বলতে থাকেন, ‘ভাই, এয়ারপোর্ট থেকে সোজা মদিনা নামের একটি এলাকায় কাশেমের বাসায় নিয়ে যাওয়া হয়। তার বাড়ি নোয়াখালী। কাশেম আমাকে কোনো কথা বলার আগেই নির্যাতন করতে থাকে। একসময় একটি ফোন নিয়ে আমার আত্মীয়ের সঙ্গে কথা বলতে বলে। আমি প্রাণে বাঁচতে আমার ছোট ভাইকে ফোন দেই। কাশেম আমাকে একটি অ্যাকাউন্ট নম্বরে ১ লাখ টাকা জমা দিতে কয়। আমার ছোট ভাই তার একটি দোকান বিক্রি করে ১ লাখ টাকা দেয় নোয়াখালীর একটি ইসলামী ব্যাংকের অ্যাকাউন্টে। পরদিন কাশেম আমারে আবার পেটাতে থাকে। বলে একটি বিকাশ নম্বরে আরও টাকা জমা দিতে। আমার ছোট ভাই রেন্টু করজা করে ৭ হাজার টাকা দেয়।’ মিন্টু বলতে থাকেন, ‘আমার রুমে তরুণ নামে সিলেটের এক ছেলে ছিল। তাকেও এভাবে মারধর করত। তার আত্মীয়স্বজন দালালদের দাবি অনুযায়ী টাকা পরিশোধ করে আসছিল। সারা দিন আমাদের মারধর করত ওই চক্রের লোকজন। তিন-চার দিন পর আমাকে এসবিয়া নামের একটি এলাকায় গাফফার নামের আরেক জল্লাদের কাছে পাঠাইয়া দেয় কাশেম। সেখানে আসার পরই আমাকে মরুভূমিতে নিয়ে মারধর করতে থাকে গাফফার। গ্যাসের চুলার পাইপ দিয়ে পিটাইতে থাকে। আমারে কয়, ‘জানে বাঁচতে হইলে বাড়িতে ফোন দিয়া ৩ লাখ টাকা ২৪ ঘণ্টার মধ্যে দিতে বল’। আমার বাবার নিজের ভিটাও নাই।
আমরা আমাদের ফুফুর বাড়িতে থাকি। নিজেদের ভিটা থাকলে সেইটা বিক্রি করে টাকা দিয়ে দিতাম। একটা দোকান ছিল ছোট ভাইয়ের সেইটাও বিক্রি করে দিছি। এর পরও আমাকে দিয়া ফোন দেওয়ায়। টাকা না পেয়ে আমার ওপর নির্যাতন আরও বাড়তে থাকে। রুবেল নামের এক লোকের নম্বরে ফোন দিয়া আবার টাকা দিতে কইছিল। এদিকে আমাদের এলাকার সাবেক উপজেলা ভাইস চেয়ারম্যান আসাদুজ্জামান ডিবি (পুলিশ) দিয়ে রুবেলকে ধরাইয়্যা ফেলেন। এরপর রুবেলের ভাই সুমনসহ আরও পাঁচ-ছয় জন লোক আমাকে বেধড়ক পেটাতে থাকে। সারা দিন-রাত হাত-পা বাঁইধ্যা মারপিট করে। কয় থানার ওসিকে ফোন দিয়া তুই বল তুই এখানে ভালো আছিস। রুবেলের কোনো দোষ নাই। তাকে যেন পুলিশ ছাইড়্যা দেয়। একপর্যায়ে আমাকে দেশে পাঠানোর কথায় রাজি হয় কাশেম, গাফফাররা। শর্ত দেয় ৭০ হাজার টাকা দিতে হবে। তাদের কথা অনুযায়ী আসাদ ভাই এলাকার মানুষের কাছ থেকে সাহায্য উঠিয়ে ৭০ হাজার টাকা পাঠিয়ে দেন। গত শনিবার বিকাল ৫টায় আমি দেশে আসি। বিমানবন্দরে নামোনের পর এসআই আনোয়ার ও বাবুল আমারে কিডন্যাপ করতে চাইছিল। তয় আমাগের চেয়ারম্যান আসাদ ভাইরে ফোন দেওয়ার পরই তিনি র্যাব লইয়্যা আসেন। আমারে উদ্ধার করেন। হুনছি এসআই আনোয়ার রুবেলের আত্মীয়।’