রবিবার, ৭ মে, ২০১৭ ০০:০০ টা

অসাবধানতা ডেকে আনছে মৃত্যু

চলতি পথে বাড়ছে মোবাইল হেডফোন ব্যবহার

জিন্নাতুন নূর

অসাবধানতা ডেকে আনছে মৃত্যু

ঢাকাসহ সারা দেশের সড়ক-মহাসড়ক ও রেললাইনের ওপর দিয়ে চলার সময় এয়ারফোন বা হেডফোন ব্যবহারের ফলে দুর্ঘটনায় মৃত্যুহার ক্রমেই বাড়ছে। যানজটে বসে গান শুনতে, উচ্চশব্দ এড়াতে, মোবাইলে কথা বলতে এবং মেয়েরা ইভ টিজিং এড়াতে হেডফোন বা এয়ারফোন ব্যবহার করলেও উচ্চশব্দে বিপরীত থেকে আসা যানবাহনের ভেঁপুর শব্দ শুনতে না পেয়ে অসাবধানতায় দুর্ঘটনায় পড়ছেন। বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয় (বুয়েট)-এর অ্যাক্সিডেন্ট রিসার্চ ইনস্টিটিউটের তথ্য— ২০১১-১৫ সাল পর্যন্ত শুধু এয়ারফোন ব্যবহারের জন্য রেলপথে প্রাণ হারিয়েছে সাড়ে ৫ হাজার মানুষ। রাজধানীর বেশ কয়েকটি প্রধান সড়ক ঘুরে দেখা যায়, প্রাইভেট কারচালক থেকে শুরু করে বাসচালক, মোটরসাইকেল চালক ও অন্যান্য যানবাহনের চালকরা গাড়ি চালানোর সময় মোবাইলে কথা বলছেন। এ সময় উল্লেখযোগ্যসংখ্যক চালককে এয়ারফোন ব্যবহার করতে দেখা যায়। অনেকে আবার ব্যস্ত সড়কে গাড়ি চালাতে চালাতেই এয়ারফোন লাগিয়ে গান শুনছিলেন। তবে এ বিষয়ে ট্রাফিক পুলিশ চালকদের বাধা দিয়েছে এমনটি দেখা যায়নি। রাজধানীর মিরপুর ২ নম্বর এলাকায় মোটরসাইকেল চালক রাশেদুর রহমানের সঙ্গে এ প্রসঙ্গে কথা হলে তিনি বলেন, ‘মোবাইলে গান শুনতে শুনতে মোটরসাইকেল চালাতে ভালো লাগে। এখন এয়ারফোন ব্যবহার না করলে গাড়ি চালাতে পারি না।’ যদিও তিনি স্বীকার করেছেন যে, এতে দুর্ঘটনার আশঙ্কাও থেকে যায়। বিশেষজ্ঞরা জানান, দীর্ঘক্ষণ ধরে কানে হেডফোন লাগিয়ে উচ্চ স্বরে গান-বাজনা শুনলে নানারকম শারীরিক ও মানসিক সমস্যা তৈরি হয়। বুয়েট ও বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার গবেষণায়ও একই আশঙ্কা করা হয়েছে। এতে উল্লেখ করা হয়েছে যে, দিনে ৮ ঘণ্টা করে উচ্চশব্দে হেডফোনে গান শুনলে স্বল্পসময়ের মধ্যে বধির হয়ে যাওয়ার আশঙ্কা আছে। এ-সংক্রান্ত গবেষণা থেকে আরও জানা যায়, হেডফোন কানে লাগিয়ে যারা দুর্ঘটনার শিকার হন তাদের ৭০ শতাংশেরই মৃত্যু হয়। আর দুর্ঘটনার শিকার ব্যক্তিদের মধ্যে অধিকাংশই পুরুষ এবং তারা বয়সে তরুণ। রাজধানীর প্রধান সড়কগুলো, বিভিন্ন বাসস্ট্যান্ড ও বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর সড়কের সামনে দাঁড়িয়ে লক্ষ্য করা যায় যে, অধিকাংশ তরুণ-তরুণী ও কিশোর-কিশোরীর কানেই হেডফোন ও এয়ারফোন। এদের কেউ কেউ মোবাইলে কথা বলছে। আবার কেউ গান, ভিডিও কল এবং কোনো ভিডিও দেখার জন্য হেডফোন ব্যবহার করছে। শিক্ষার্থীদের সঙ্গে কথা বলে আরও জানা যায়, অনেকে আজকাল ফ্যাশনের একটি অনুষঙ্গ হিসেবেও বড় বড় হেডফোন দিয়ে কানজোড়া ঢেকে রাখেন। আবার সকাল ও বিকালে শরীরচর্চার জন্য যারা হাঁটতে বের হন তারাও হেডফোন ও এয়ারফোন ব্যবহার করছেন। তবে এ ক্ষেত্রে সবারই সতর্কতার সঙ্গে পথেঘাটে মোবাইলে এয়ারফোন বা হেডফোন ব্যবহার করা উচিত বলে সংশ্লিষ্টরা মনে করেন। রাজধানীর বাংলামোটরে গতকাল ব্যস্ত রাস্তা পারাপারের সময় এয়ারফোন ব্যবহার করার কারণ সম্পর্কে জানতে চাইলে একটি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রী সোনিয়া আক্তার জানান, গাড়ির উচ্চ হর্নের হাত থেকে রেহাই পেতে এয়ারফোন ব্যবহার করেন। এমনকি পথে চলতে গিয়ে প্রায়ই বখাটেদের আপত্তিকর কথা এড়ানোর জন্যও তিনি কানে এয়ারফোন গুঁজে রাখেন। রাজশাহী প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের সিভিল ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের শিক্ষার্থী আরিফ হোসেন সজীব (২১) ৬ এপ্রিল রাজশাহী কাদিরগঞ্জ গ্রেটার রোড মসজিদ এলাকায় রেললাইনের ওপর দিয়ে হাঁটার সময় কানে হেডফোন লাগিয়ে মোবাইলে কথা বলছিলেন। এ সময় বিপরীত দিক থেকে আসা ট্রেনটি লক্ষ্য না করায় সজীব ট্রেনে কাটা পড়েন। দুর্ঘটনাটির আগে আশপাশের লোকজন সজীবকে সতর্ক করে চিৎকার করলেও কানে হেডফোন থাকায় তিনি শুনতে পাননি। এর আগে গত বছরের ১৮ ফেব্রুয়ারি বুয়েটের সিভিল ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের তৃতীয় বর্ষের আরেক শিক্ষার্থী তানভীর গওহর তপু হেডফোন ব্যবহারে অসতর্কতার কারণে ঢাকার মগবাজার ওয়ারলেস রেলগেট এলাকায় ট্রেনে কাটা পড়েন। বুয়েটের অ্যাক্সিডেন্ট রিসার্চ ইনস্টিটিউটের পরিচালক ড. মোয়াজ্জেম হোসেন বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, গাড়ি চালানোর সময় যদি কেউ এয়ারফোন ব্যবহার করে গান শোনেন বা মোবাইলে কথা বলেন তবে ট্রাফিক পুলিশ তাকে জরিমানা করতেই পারে। রাস্তায় চলাচলের সময় দুর্ঘটনার হাত থেকে বাঁচতে পথচারীদের মোবাইল ব্যবহার সম্পর্কে নিজেদেরই সচেতন হতে হবে। আর হেডফোন বা এয়ারফোনের জন্য দুর্ঘটনা যদি সাধারণ ঘটনায় রূপ নেয় তখন সরকারের পক্ষ থেকে এ বিষয়ে সচেতনতামূলক প্রচার চালাতে হবে।

সর্বশেষ খবর