রবিবার, ৭ মে, ২০১৭ ০০:০০ টা

পিস্তল চাপাতি বোমা নিয়ে ডাকাতি করতে নামে ওরা

তুহিন হাওলাদার

ঘড়ির কাঁটায় তখন বিকাল ৩টা ১৫ মিনিট। সবাই ব্যস্ত যে যার কাজে। পূর্ব পরিকল্পনা অনুযায়ী এরই মধ্যে সব কিছু গুছিয়ে দিনদুপুরে ডাকাতি করতে এসেছে ১০ জনের ভয়ঙ্কর একটি দল। হুড় হুড় করে ঢুকে পড়েছে রাজধানীর গুলশানের ডিসিসি মার্কেটের আমিন জুয়েলার্সে। পরে সবাইকে অস্ত্রের মুখে জিম্মি করে স্বর্ণালঙ্কার ব্যাগে ঢুকিয়ে দ্রুত পালানোর প্রস্তুতি নেয় ডাকাত দল। এমন সময় বিপদ সংকেত দিয়ে দোকানের সাইরেন বেজে ওঠে। ফলে মার্কেটের ভিতরে কেনাকাটা করতে আসা সাধারণ  মানুষ দৌড়ঝাঁপ শুরু করেন। এরই মধ্যে নিরাপত্তায় নিয়োজিতরা পুরো এলাকা ঘিরে ফেলে। ঘটনাস্থলে উপস্থিত উৎসাহী জনতাসহ সবাই মিলে বাবুল শেখ ও সেলিম নামের দুই ডাকাতকে আটক করে। এ ঘটনায় ২০০৯ সালের ২৩ জুলাই গুলশান থানায় আমিন জুয়েলার্সের তৎকালীন ম্যানেজার শাহজাহান মোল্লা বাদী হয়ে মামলা করেন। পরে আসামি বাবুলসহ কয়েকজন ডাকাত আদালতে ফৌজদারি কার্যবিধির ১৬৪ ধারায় স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দেয়। বাবুল শেখ আদালতে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দিতে বলেছে, পেশায় আমি সিএনজি চালক। একদিন সেন্টু (আরেক আসামি) চট্টগ্রামের ইপিজেড এলাকা থেকে আমার সিএনজিতে ওঠে। সেন্টুকে নিয়ে কালুরঘাট যাই। রাস্তায় সেন্টুর সঙ্গে কথাবার্তার একপর্যায়ে সে আমাকে চাকরি দেবে বলে জানায়। পরে সেন্টুর মোবাইলে যোগাযোগ করে ঢাকায় এসে মিরপুরে তাদের সঙ্গে থাকি। এক সময় সেন্টু ও জাফর আমাকে ডাকাতি করার প্রস্তাব দেয়। আমি রাজি হলে তারা আমাকে গুলশানের আমিন জুয়েলার্সের সামনে নিয়ে যায় এবং বাইরে থেকে ঘুরে আসি। তারপর হেলাল, এবাদুর, টিটু, বিলকু, জাকির, সুজনসহ ৯ জনকে সঙ্গে নিয়ে সেন্টুর মিরপুরের বাসায় বসে ডাকাতির প্রস্তুতি নিতে থাকি। পরে ২৩ জুন আমরা বেলা ২টায় বাসা থেকে বের হই। ৩টি সিএনজি ভাড়া করা হয়। আমার হাতে পিস্তল ছিল। সেন্টুর হাতে রিভলবার, হেলালের হাতে কাটা বন্দুক, সুজনের হাতে রিভলবার এবং বিলকুর হাতে বোমা ছিল। এ ছাড়া জাফরসহ অন্যদের হাতে ছিল চাপাতি। কিছুক্ষণের মধ্যে আমিন জুয়েলার্সের সামনে পৌঁছি। প্রথমে সেন্টু, হেলাল ও জাফর ঢোকে। তারপর সুজন ও জাকির ঢোকে। এরপর আমি ঢুকি। এবাদুর ও বিলকু বাইরে ছিল। টিটুও দোকানের ভিতরে ঢোকে। জাকির ব্যাগে কিছু স্বর্ণালঙ্কার ভরে। দোকানের সাইরেন বেজে উঠলে জাকিরসহ অন্যরা ব্যাগ রেখে বের হয়ে যায়। আমি তখন ওই ব্যাগটি নিয়ে বের হওয়ার চেষ্টা করলে দোকানের নিচে লোকজন ও দারোয়ান আমাকে ধরে ফেলে। অন্য আসামি হেলাল উদ্দিন জবানবন্দিতে বলেছে, আমি গার্মেন্টে সোয়েটার তৈরির কাজ করতাম। হঠাৎ গার্মেন্ট বন্ধ হয়ে যায়। পরে অফিস থেকে পাওনা টাকা তুলে বাসায় ফেরার পথে ২০০৯ সালের ৭ মে খিলগাঁও চৌরাস্তায় ছিনতাইকারীরা আমার সব টাকা নিয়ে যায়। আমি মনের কষ্টে অনেক কাঁদি। এমন সময় ডাকাত বাবুল শেখ এসে আমাকে এক হাজার টাকা দেয় এবং মোবাইল নম্বর দিয়ে আমাকে যোগাযোগ করতে বলে। কিছু দিন পরে আমি বিয়ে করে গ্রামের বাড়িতে গিয়ে নতুন জীবন শুরু করি। পরে একই বছরের ২২ জুন বাবুল ফোন করে আমাকে ঢাকায় আসতে বলে। আমি মিরপুরের আমতলা কাঁচাবাজার এলাকায় যাই। সেখান থেকে আমাকে নিয়ে একটা সিএনজিতে ওঠে বাবুল। তার হাতে অস্ত্রের ব্যাগ ছিল। গাড়িতে ওঠার পর বাবুল জানায়, গুলশানের আমিন জুয়েলার্সে ডাকাতি করবে। পরে সেখানে গিয়ে দেখি পুলিশ ও র‌্যাবের গাড়ি। কিছুক্ষণ অপেক্ষা করি। পুলিশ ও র‌্যাবের গাড়ি চলে গেলে আরও ৭/৮ জন গুলশানের ডিসিসি মার্কেটে ঢোকার জন্য সবাই একত্রিত হই। বাবুল নিজের হাতে পিস্তল নেয় এবং তার ব্যাগ থেকে আমাকে একটা চাপাতি দেয়। বাবুল শেখ পিস্তল উঁচিয়ে জুয়েলার্সের সবাইকে চুপচাপ থাকতে বলে। এমন সময় সাইরেন বেজে ওঠে। আমরা সঙ্গে সঙ্গে দৌড় দিয়ে বের হয়ে যাই। কিন্তু বাবুল শেখ অস্ত্রসহ ধরা পড়ে। মামলার নথি সূত্রে জানা গেছে, ২০১০ সালের ১০ অগাস্ট ১০ জন আসামির বিরুদ্ধে আদালতে অভিযোগ দাখিল করে পুলিশ। আসামিরা হলো— বাবুল শেখ, হেলাল উদ্দিন, সেন্টু মোল্লা, জাকির হোসেন, তাজুল ওরফে সুজন মৃধা, এমদাদুল দফাদার ওরফে এবাদুল, বিলকু, আবু জাফর, রেজাউল করিম টুটুল ও ওবায়দুল। এ মামলা বর্তমানে সাক্ষ্য গ্রহণের পর্যায়ে রয়েছে। পরবর্তী সাক্ষ্য গ্রহণের জন্য ঢাকার পরিবেশ আপিল আদালতের বিচারক মশিউর রহমান চৌধুরী ১৬ মে দিন ধার্য করেন। এ বিষয়ে রাষ্ট্রপক্ষের আইনজীবী এ এফ এম রেজাউল করিম হিরন বলেন, এ মামলার ১০ আসামির মধ্যে রেজাউল করিম টুটুল ও ওবায়দুল জামিনে আছে। এ ছাড়া প্রধান আসামি বাবুল, সেন্টু, হেলালসহ ৮ জন আসামি ২০১১ ও ২০১২ সালের বিভিন্ন সময়ে জামিন পেয়ে পলাতক রয়েছে। এ মামলায় মোট ১৩ জন সাক্ষীর সাক্ষ্য গ্রহণ হয়েছে।

সর্বশেষ খবর