সোমবার, ২২ মে, ২০১৭ ০০:০০ টা

রমজানের আগেই বাজার অস্থির

তেল পিয়াজ আদা রসুন ছোলা ডাল চিনির দাম বাড়ছে ► মসলার দাম দেড়শ গুণ বৃদ্ধি

সাঈদুর রহমান রিমন

দেশে ঈদ-পার্বণ অনুষ্ঠানাদি এলেই অঘোষিতভাবে নানা পণ্যসামগ্রীর দাম আকাশচুম্বী বাড়িয়ে দেওয়া হয়। সারা বিশ্বে জাতীয় বা ধর্মীয় যে কোনো অনুষ্ঠানের সময় সব ধরনের পণ্যসামগ্রীর মূল্য ছাড় দিয়ে নানা প্রচার-প্রচারণা চালানো হয়। এমনকি প্রতিবেশী দেশ ভারতেও পূজা-পার্বণের ১০-১২ দিন আগে থেকেই পোশাক-পরিচ্ছদ থেকে শুরু করে উৎসব আয়োজনের প্রয়োজনীয় সবকিছুতে মূল্য হ্রাসের ঢাকঢোল বাজতে থাকে। এসব ক্ষেত্রে শুধু বাংলাদেশেই উল্টো চিত্র লক্ষ্য করা যায়। দেশের জাতীয়, ধর্মীয়, সর্বজনীন যে কোনো উৎসব আয়োজনে পণ্যমূল্য বৃদ্ধির পাল্লাপাল্লি শুরু হয়ে যায়। সে ক্ষেত্রে সরকারের বাজার মনিটরিং ও মূল্য নিয়ন্ত্রণে দায়িত্বশীলদের ভূমিকা নিষ্ক্রিয় থাকায় ভোক্তারা নানাভাবেই ঠকেন, বঞ্চনা ও প্রতারণার শিকার হন। প্রতি বছর রমজান ও ঈদ এলেই মূল্য বৃদ্ধির ন্যক্কারজনক এ চিত্র দেখতে পাওয়া যায়।

এবারও রমজান উপলক্ষে আরও দেড়-দুই মাস আগে থেকেই প্রধান ভোগ্যপণ্যগুলোর দাম বেড়েই চলেছে। পিয়াজ, আদা, রসুন, ছোলা, ডাল, চিনির দাম বাড়ছে লাফিয়ে লাফিয়ে। ব্যবসায়ী সিন্ডিকেট এবার নানা পণ্যসামগ্রীর দাম বাড়ানোর ক্ষেত্রে নতুন ফন্দি নিয়ে মাঠে নেমেছে। অধিকাংশ নিত্যপণ্যের দাম এমনভাবে বাড়ানো হচ্ছে যে রমজানে তা আর বাড়ানোর কোনো প্রয়োজনই পড়বে না। বরং রমজান উপলক্ষে পণ্যমূল্য কিছুটা ছাড় দিলেও ব্যবসায়ীদের উচ্চ মুনাফা নিশ্চিতই থাকবে। বাজার পর্যবেক্ষকরা বলেন, এক সময় রমজান মাসে হঠাৎ করেই ব্যবসায়ীরা পণ্যের মজুদ ও দাম বাড়াতেন। তবে কয়েক বছর ধরে রমজানের আগে বাজার মনিটরিং কমিটি হঠাৎ ‘করিত্কর্মা’ হয়ে ওঠায় ব্যবসায়ীরা তাদের ছক পাল্টেছেন। তারা রমজানের দেড়-দুই মাস আগেই পণ্যের মজুদ ও দাম বাড়িয়ে রাখেন। ব্যবসায়ী গ্রুপের এমন ছকে দেশি পিয়াজের দামেও আগুন ধরিয়ে দেওয়া হয়েছে। পিয়াজে কয়েকগুণ বেশি লাভ করছেন বিক্রেতারা। কৃষকরা জানিয়েছেন, তারা ৮ থেকে ১০ টাকা কেজি দরে পিয়াজ বিক্রি করছেন। দিনাজপুরের চাষিরা পিয়াজ বিক্রি করছেন সর্বোচ্চ ১১ টাকায়। কিন্তু ঢাকার খুচরা বাজারে এই দেশি পিয়াজ বিক্রি হচ্ছে প্রায় ৫০ টাকায়। চড়া দামের পেছনে কৃত্রিম মজুদ সংকটকে দায়ী করছেন সংশ্লিষ্টরা। ইন্ডিয়ান পিয়াজের ক্ষেত্রেও আমদানি ব্যয় থেকে শুরু করে সব ধরনের খরচ মেটানোর পর ১৫ শতাংশ লাভ ধরেও প্রতি কেজি সর্বোচ্চ ২৩ টাকায় বিক্রি হওয়ার কথা। সেই পিয়াজ এখন বিক্রি হচ্ছে ৩৫ টাকায়। বাজারে দেশি পিয়াজের সরবরাহ ভালো, কারণ কৃষকরা এখন পিয়াজ তুলছেন। এতে সরবরাহ বাড়ছে ঠিকই, কিন্তু দাম কমছে না। ধাপে ধাপে বাড়ছে রসুন, আদার দামও। এলাচ, লবঙ্গ, দারচিনি, শুকনা মরিচ, হলুদ, জিরা, তেজপাতার দরও অনেকটা পাল্লা দিয়ে ছুটছে ঊর্ধ্বমুখে। বিশেষ করে খুচরা বাজারে বিভিন্ন মসলার দাম লাগামহীনভাবে বাড়ছে। এলপ্পি গ্রিন এলাচ পাইকারি বাজারে দেড় হাজার টাকা দরে বিক্রি হলেও খুচরা বাজারে আড়াই হাজার ছুঁই ছুঁই করছে। অথচ এক মাস আগেও এই এলাচ ১১০০ টাকায় বিক্রি হয়েছে। দেশের খুচরা বাজারে দুই দিনের ব্যবধানে রসুনের দামও বেড়েছে কেজিতে ৬০ থেকে ৮০ টাকা। খুচরা বাজারে প্রতি কেজি আমদানি করা রসুন বিক্রি হচ্ছে ২৭০ থেকে ২৮০ টাকায় এবং দেশি রসুন বিক্রি হচ্ছে ১২০ থেকে ১৪০ টাকায়। আমদানিকারকরা বললেন, মসুর ডাল আমদানি খরচ, পরিবহন ব্যয়সহ সব খরচ যোগ করেই প্রতি কেজির দাম দাঁড়ায় ১২৪ টাকা। কিন্তু খুচরা বাজারে মসুর ডাল বিক্রি হচ্ছে ১৫০ থেকে ১৬০ টাকায়। আমদানি করা মটর ডাল দাম পড়ে প্রতি কেজি প্রায় ২৮ টাকা। অথচ খুচরা বাজারে এই ডাল বিক্রি হচ্ছে ৫০ থেকে ৫৫ টাকায়। প্রায় প্রতিটি পণ্যের ক্ষেত্রেই আকাশচুম্বী দাম বাড়িয়ে মাত্রাতিরিক্ত মুনাফা হাতিয়ে নিচ্ছেন ব্যবসায়ীরা। সারা দিন রোজা রাখার পর দিনশেষে ইফতারে ছোলা না হলে আয়োজনে পূর্ণতা আসে না। সারা বছর যেমন-তেমন, রমজান এলে ছোলার চাহিদা বাড়ে কয়েকগুণ। পাল্লা দিয়ে বাড়ে দাম। এবার রোজার আগে থেকেই ছোলার দাম বেড়ে গেছে। চাহিদার তুলনায় আমদানিও হয়েছে বেশি। এর পরও কেন প্রতিদিন দাম বাড়ছে? প্রতি কেজি ছোলার পাইকারি দাম ৮২ টাকা। আকারে একটু বড় সাদা রঙের ছোলা এখানে বিক্রি হচ্ছে ৮৮ থেকে ৯০ টাকায়। দোকানিরা জানালেন, সাদা রঙের এই ছোলা আসে মিয়ানমার থেকে। ঢাকার মৌলভীবাজারে যে ছোলা কেজিপ্রতি বিকাচ্ছে ৮২ টাকায়, কারওয়ান বাজারে গিয়েই তা কিনতে হচ্ছে ৯২ থেকে ৯৫ টাকায়। আমদানিকারকদের তথ্যমতে, এখন যে ছোলা বাজারে আসছে, তা আমদানি হয়েছে প্রায় দুই মাস আগে। এই ছোলা শুল্কায়ন শেষে খাতুনগঞ্জ পর্যন্ত পৌঁছাতে প্রতি কেজির দাম পড়েছে ৪১ টাকা। মৌলভীবাজারের পাইকারি দোকানসমূহে প্রতি কেজি চিনি বিক্রি হচ্ছে ৫৪ টাকা দরে। অথচ কারওয়ান বাজারেই সে চিনি বিক্রি হচ্ছে ৬৫ থেকে ৬৮ টাকায়। হিসাবে প্রতি কেজিতে খুচরা বিক্রেতারা মুনাফা গুনছেন সর্বনিম্ন ১১ টাকা থেকে সর্বোচ্চ ১৪ টাকা। অথচ বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের তথ্যমতে, আমদানি করা চিনি সব ধরনের খরচ মিলিয়ে কেজিপ্রতি ৪২ থেকে ৪৩ টাকা হওয়ার কথা। দেশে প্রতি মাসে ১ লাখ ১০ হাজার টন সয়াবিন ও পাম তেলের চাহিদা আছে। রমজানে এ চাহিদা প্রায় দ্বিগুণ হয়। এনবিআরের হিসাবে, চলতি অর্থবছরের প্রথম আট মাসে (ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত) ১৪ লাখ ৬৬ হাজার টন পরিশোধিত ও অপরিশোধিত ভোজ্যতেল দেশে প্রবেশ করেছে। এর পাশাপাশি দেশে রিফাইনারিগুলোর উত্পাদন ক্ষমতা রয়েছে ২ লাখ টন। একইভাবে চলতি বছরের ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত আমদানি হওয়া ১০ লাখ ৮২ হাজার টন চিনি প্রবেশ করেছে, যেখানে ১৩ লাখ টনের এলসি নিষ্পত্তি হয়েছে। মসুর ডাল এসেছে ১ লাখ ৩০ হাজার টন। এলসি নিষ্পত্তি হয়েছে আরও ১ লাখ ৭ হাজার টনের। একইভাবে পিয়াজ, রসুন, আদা, হলুদেরও ব্যাপক উত্পাদন ও আমদানি হয়েছে। বাজারে এসব পণ্যের সরবরাহে কোনো ঘাটতি নেই। তবু অযৌক্তিকভাবে দফায় দফায় দাম বাড়িয়ে দেওয়ার অভিযোগ উঠেছে। এদিকে বর্তমান বাজারে দারচিনি মানভেদে প্রতি কেজি পৌনে তিনশ থেকে তিনশ টাকায় বিক্রি হচ্ছে, যা কদিন আগেও ছিল মাত্র আড়াইশ টাকা। ভারতীয় গোলমরিচের দামও কেজিপ্রতি দেড় থেকে দুইশ টাকা বেড়েছে। গত দুই সপ্তাহে বিভিন্ন মানের জিরার দামও ধাপে ধাপে চড়েছে। বাজার-সংশ্লিষ্টরা জানান, বিভিন্ন ধরনের মসলার দাম আগের বছরের তুলনায় এবার সর্বনিম্ন ২৫ থেকে প্রায় দেড়শ গুণ পর্যন্ত বেড়েছে, যা অতীতের সব রেকর্ড ভেঙেছে। তবে মসলার বাজার দর দফায় দফায় বাড়ায় তা অনেকেরই নজরে পড়েনি বলে দাবি করেন তারা। বাজার ঘুরে ক্রেতারা বলছেন, বাজারে কোনো পণ্যের সরবারহ কম নেই। এর পরও প্রতিদিনই পণ্যের দাম বাড়ছে। সব ধরনের জিনিসপত্রের দাম চড়া। বাংলাদেশ কনজুমার রাইটস সোসাইটি, ঢাকার নির্বাহী পরিচালক গোলাম মোস্তফা বলেন, রমজান সামনে রেখে প্রতি বছরই অসাধু ব্যবসায়ী সিন্ডিকেট ছোলা, চিনিসহ নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের দাম বাড়িয়ে দেয়। রমজান শুরুর এক-দুই মাস আগেই শুধু নয়, বছরজুড়ে বাজার নিয়ন্ত্রণে সরকারি নজরদারি বাড়াতে হবে। মনিটরিং টিমের সার্বক্ষণিক বাজার মনিটর করা উচিত বলেও দাবি করেন তিনি।

রমজানে সরকারি ব্যবস্থাপনা : বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বশীল সূত্রগুলো বলছে, বাজারের এ অস্বাভাবিক পরিস্থিতি রমজানের আগেই নিয়ন্ত্রণে আনা হবে। অসৎ ব্যবসায়ীদের দৌরাত্ম্য প্রতিরোধ ও সিন্ডিকেটের কারসাজি রুখতে শিগগিরই সরকার হার্ডলাইনে যাবে। প্রাথমিক পদক্ষেপ হিসেবে রমজানে ভোগ্যপণ্যের বাজার স্বাভাবিক রাখতে ১৭টি পণ্যকে অত্যাবশ্যকীয় চিহ্নিত করে সংশ্লিষ্ট ব্যবসা-প্রতিষ্ঠান ও সংগঠনকে সংযত ব্যবসা করার কঠোর নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে। সম্প্রতি দ্রব্যমূল্যবিষয়ক আন্ত মন্ত্রণালয়ের এক বৈঠকে চিহ্নিত অত্যাবশ্যকীয় পণ্যগুলোর সার্বিক মজুদ, আমদানি, উত্পাদন ও বাজার পরিস্থিতি নিয়ে আলোচনা হয়। পণ্যগুলো হচ্ছে ছোলা, মসুর ডাল, সয়াবিন তেল, পাম তেল, চিনি, লবণ, পিয়াজ, রসুন, আদা, ধনিয়া, শুকনা মরিচ, দারচিনি, লবঙ্গ, এলাচ, জিরা, হলুদ ও তেজপাতা। রমজান উপলক্ষে সারা দেশের ১৭৪টি পয়েন্টে টিসিবি ট্রাক বসাবে। সেখানে চিনি, মসুর ডাল, ছোলা, সয়াবিন তেল ও খেজুর সরকার-নির্ধারিত দামে বিক্রি হবে। রাজধানী ঢাকার ২৫টি পয়েন্টে, চট্টগ্রামে ১০টি, অন্য বিভাগীয় শহরে পাঁচটি করে ট্রাক বসবে। এ ছাড়া জেলা শহরে দুটি করে মোট ১৭৪টি স্থানে অস্থায়ীভাবে ট্রাক বসিয়ে স্থানীয় বাজারের তুলনায় কিছুটা কম দামে পাঁচটি পণ্য বিক্রি করা হবে বলে জানিয়েছেন টিসিবির জনসংযোগ কর্মকর্তা হুমায়ুন কবির।

সর্বশেষ খবর