শুক্রবার, ৩০ জুন, ২০১৭ ০০:০০ টা

ই-বর্জ্যের ভয়াবহ হুমকিতে দেশ

জয়শ্রী ভাদুড়ী

ই-বর্জ্যের ভয়াবহ হুমকিতে দেশ

দৈনন্দিন জীবনে নষ্ট হয়ে যাওয়া টিভি, ফ্রিজ, কম্পিউটার, মুঠোফোন, বৈদ্যুতিক বাতিসহ বিভিন্ন সরঞ্জাম স্বাস্থ্য ও পরিবেশের জন্য নতুন ঝুঁকি তৈরি করছে। একটি এনজিওর গবেষণায় দেখা গেছে, দেশে প্রতিবছর গড়ে ২০ লাখ মেট্রিক টন ই-বর্জ্য তৈরি হয়। অথচ এই বর্জ্য ব্যবস্থাপনা, ধ্বংস অথবা রক্ষণাবেক্ষণে নেই কোনো আইন, নীতিমালা কিংবা উদ্যোগ। অথচ পাশের দেশ ভারত, পাকিস্তান, শ্রীলঙ্কাতে রয়েছে ই-বর্জ্য ব্যবস্থাপনায় আলাদা আইন। বাংলাদেশের বেসরকারি সংস্থা এনভায়রনমেন্ট অ্যান্ড সোশ্যাল ডেভেলপমেন্ট অর্গানাইজেশন (এসডো) পরিচালিত ‘ই-বর্জ্য : বাংলাদেশের বর্তমান চিত্র, ২০১৪’ শীর্ষক গবেষণা প্রতিবেদনের তথ্য অনুসারে, ২০১১-১২ অর্থবছরে দেশে বাতিল হয়ে যাওয়া ই-বর্জ্যের পরিমাণ ছিল প্রায় ৫১ লাখ মেট্রিক টন। ২০১৩-১৪ অর্থবছরে তা প্রায় দ্বিগুণ বেড়ে দাঁড়ায় ১ কোটি ১০ লাখ টনে। এর মধ্যে শুধু মুঠোফোন থেকেই তৈরি হয়েছে ৫১ হাজার ৫০০ টন বর্জ্য। আর টেলিভিশন ও কম্পিউটার বর্জ্য তৈরি হয়েছে যথাক্রমে ৮ লাখ ৬০ হাজার ও ৩৪ হাজার ৪০০ টন। এদিকে বাংলাদেশে জাহাজভাঙা শিল্পের জন্য আমদানি করা প্রতিটি জাহাজে বিপুল পরিমাণ অব্যবহূত বৈদ্যুতিক পণ্য থাকায় এ থেকে তৈরি হওয়া বর্জ্যের পরিমাণই সর্বাধিক, যা প্রায় ৯০ লাখ মেট্রিক টনের কাছাকাছি। এর বাইরে সিএফএল বাতি, মার্কারি বাতি, থার্মোমিটারসহ বিভিন্ন ধরনের চিকিৎসা ও গৃহস্থালি যন্ত্র থেকে তৈরি হওয়া বর্জ্যের পরিমাণ ২ লাখ ১০ হাজার ৩৩৬ মেট্রিক টন।

এসব ই-বর্জ্যের স্বাস্থ্য ও পরিবেশগত ঝুঁকির বিষয়ে কথা হয় এসডো সম্পাদিত গবেষণাটির প্রধান সমন্বয়ক ও প্রাণ-প্রতিবেশ বিশেষজ্ঞ (ইকোলজিস্ট) শাহরিয়ার হোসেনের সঙ্গে। বাতিল হয়ে যাওয়া ফোনের উদাহরণ দিয়ে তিনি বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, ‘বছরে যদি তিন কোটি ফোন আমদানি হয়, তাহলে ধরে নিতে হবে একই পরিমাণ ফোন বাতিলও হয়ে যাচ্ছে। আর এসব বাতিল ফোন পরিবেশের জন্য তৈরি করছে মারাত্মক ঝুঁকি। আমাদের গবেষণা বলছে, বাংলাদেশে প্রতিবছর ২০ লাখ মেট্রিক টন ই-বর্জ্য তৈরি হয়। তার ২৫ থেকে ৩০ ভাগই আসে মোবাইল ফোন থেকে।’

এসব পরিত্যক্ত বর্জ্য পরিবেশ দূষণের পাশাপাশি খাদ্য শৃঙ্খলের মাধ্যমে মানুষের শরীরের ভিতর প্রবেশ করে। এসব বর্জ্যের ভিতর থাকে সিসা, মার্কারি, ক্যাডমিয়াম, ক্রোমিয়াম, আর্সেনিকসহ বিভিন্ন ধরনের হেভি মেটাল। এটি শরীরের জন্য মারাত্মক ক্ষতিকর। উন্নত দেশগুলোতে মোবাইল বিক্রেতা প্রতিষ্ঠানই বাতিল মোবাইল পুনরায় কিনতে বাধ্য থাকে। বাংলাদেশেও এ রকম ব্যবস্থা চালুর জন্য সরকারকে উদ্যোগ নিতে হবে। তাহলে কমবে ই-বর্জ্যের পরিমাণ। ই-বর্জ্য ফেলার জন্য কোনো নির্দিষ্ট ভাগাড় নেই। হকাররা বিভিন্ন বাতিল বৈদ্যুতিক পণ্য এনে          বিভিন্ন স্থানের ভাঙ্গারি দোকানে জড়ো করেন। এগুলো থেকে শুধু প্লাস্টিকটা এবং যেগুলো বিক্রি বা রিসাইকেল করা যাবে তা নেওয়া হয়। বাকি যেগুলো কাজে লাগানো যাচ্ছে না, সেগুলোই সবচেয়ে ক্ষতির কারণ হয়ে দাঁড়াচ্ছে। ই-বর্জ্যের ক্ষতির বিষয়ে রোগতত্ত্ব, রোগ নিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের পরিচালক অধ্যাপক ড. মীরজাদি সেরিনা ফ্লোরা বলেন, ই-বর্জ্য পচনশীল না হওয়ায় এর প্রভাব দীর্ঘমেয়াদি। এর থেকে নির্গত বিষাক্ত বর্জ্যের প্রভাবে শরীরে বাসা বাঁধছে দুরারোগ্য ব্যাধি। এসব ক্ষতিকর উপাদানে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে শিশুরা। বাধাগ্রস্ত হচ্ছে শিশুদের শারীরিক বিকাশ। ই-বর্জ্য ব্যবস্থাপনায় অসচেতনতার বিষয়ে আক্ষেপ করে বাংলাদেশ অ্যাসোসিয়েশন অব সফটওয়্যার অ্যান্ড সার্ভিসেসের (বেসিস) সভাপতি মোস্তাফা জব্বার বলেন, ‘আমরা দিনে দিনে অন্ধকারের দিকে যাচ্ছি। ৮ কোটি মোবাইল ফোনের ব্যাটারি, মাদারবোর্ড, প্লাস্টিক থেকে প্রতিদিন কী পরিমাণ বর্জ্য উৎপাদিত হয় এর কোনো হিসাব নেই। এই বর্জ্য ব্যবস্থাপনা বা রিসাইকেলের কোনো উদ্যোগ নেই।’ ই-বর্জ্য ব্যবস্থাপনায় রিসাইক্লিং প্লান্ট, ভাগাড় এবং নতুন আইনের দাবি জানান তিনি। দেশের মানুষ প্রতিবছর কী পরিমাণ বৈদ্যুতিক পণ্য ব্যবহার করে বা এর কতটা বাতিল হয়, তার সঠিক কোনো পরিসংখ্যান নেই। ২০১২ সালের ডিসেম্বরে প্রকাশিত সিরিয়াস মার্কেটিং অ্যান্ড সোশ্যাল রিসার্চ লিমিটেডের ‘ন্যাশনাল মিডিয়া সার্ভে’ বলছে, সে সময় দেশে টিভিসেটের সংখ্যা ছিল দুই কোটির কাছাকাছি। বাংলাদেশ ইলেকট্রিক্যাল মার্চেন্ডাইজ ম্যানুফ্যাকচারার্স অ্যাসোসিয়েশনের হিসাবে, দেশের মানুষ প্রতিবছর গড়ে ৩০ হাজার কোটি টাকার বৈদ্যুতিক পণ্য ব্যবহার করে। বাংলাদেশ টেলিযোগাযোগ নিয়ন্ত্রণ কমিশনের (বিটিআরসি) হিসেবে, বর্তমানে দেশে প্রায় ১৩ কোটি মুঠোফোনের সংযোগ চালু আছে। আর প্রতিদিন এসব ইলেকট্রনিকস জিনিস নষ্ট হয়ে বাড়াচ্ছে ই-বর্জ্যের পরিমাণ। কিন্তু এই বর্জ্য ব্যবস্থাপনায় নেই কোনো উদ্যোগ। পরিবেশ অধিদফতর সূত্রে জানা যায়, ই-বর্জ্যের গুরুত্ব ও ঝুঁকি বিবেচনায় নিয়ে এর ব্যবস্থাপনাকে একটি কাঠামোর মধ্যে আনার প্রক্রিয়া শুরু করা হয়। ২০১২ সালে এ বিষয়ে ‘ডিসপোজাল ম্যানেজমেন্ট রুল’ নামের একটি বিধিমালা তৈরি করা হয়। এরপর মতামতের জন্য পরিবেশ অধিদফতর থেকে তা পাঠানো হয় আইন মন্ত্রণালয়ে। কিন্তু এরপর আর কোনো অগ্রগতি নেই। এ ব্যাপারে পরিবেশ ও বন মন্ত্রণালয়ের ভারপ্রাপ্ত সচিব ইসতিয়াক আহমদ এবং মহাপরিচালক মো. রইছউল আলম মণ্ডলের সঙ্গে একাধিকবার যোগাযোগ করা হলে তারা এ বিষয়ে মতামত দিতে অপারগতা প্রকাশ করেন।

সর্বশেষ খবর