শুক্রবার, ৩০ জুন, ২০১৭ ০০:০০ টা
মানবতা

অন্ধ চোখে আলো ফেরানোর মিশন

সাইফুল ইসলাম, যশোর

ঝিনাইদহের মহেশপুর উপজেলার ৬৫ বছরের বৃদ্ধ মোশারেফ মণ্ডল। সারা জীবন দুই চোখ ভরে দেখেছেন সুন্দর পৃথিবী আর প্রিয় স্বজনদের। কিন্তু চোখে ছানি পড়ায় চার-পাঁচ বছর ধরে কিছুই দেখতে পাচ্ছিলেন না। তাই কেবলই মনের কোণে ভেসে উঠেছে পুরনো সেই দিনের কথা। জন্মান্ধের চেয়েও এ ছিল অনেক বেশি কষ্টের। কিন্তু এ থেকে মুক্তির পথ ছিল, দরকার ছিল একটি অপারেশনের। দরিদ্রতার কারণে তা করা সম্ভব হচ্ছিল না।

মাগুরার নতুন বাজার এলাকার মাছ ব্যবসায়ী সর্বেশ্বর সরকারের স্ত্রী চামেলী সরকারেরও (৭০) একই সমস্যা। যশোরের চৌগাছা উপজেলার জগদীশপুর গ্রামের খিদির মোড়ল চোখে ছানি পড়ায় দেখতে পাচ্ছিলেন না ২০০৩ সাল থেকে। কিন্তু এখন মিলেছে সংকটের মুক্তি। বেসরকারি সংস্থা আদ-দ্বীন প্রত্যন্ত গ্রামগঞ্জে বিশেষ ক্যাম্প করে এসব রোগী শনাক্ত করছে। পরে তাদের যশোর, খুলনা ও কুষ্টিয়া আদ-দ্বীন হাসপাতাল এবং ঢাকার কেরানীগঞ্জে বসুন্ধরা-আদ-দ্বীন হাসপাতালে নিয়ে বিনামূল্যে অপারেশন করানো হচ্ছে। শুধু তাই নয়, অপারেশন-সংক্রান্ত যাবতীয় খরচ, ওষুধ দেওয়া হচ্ছে বিনামূল্যে। এমনকি রোগীর বাড়ি থেকে হাসপাতাল পর্যন্ত যাওয়া-আসার দায়িত্বটি নিচ্ছে এই সংস্থা। এর ফলে খুলনা ও ঢাকা বিভাগের বিভিন্ন এলাকায় ছড়িয়ে-ছিটিয়ে থাকা হাজারো মানুষ এখন আবার চোখে দেখতে পাচ্ছেন।

এমন উদ্যোগের কারণে অন্যদের মতো মাগুরার শ্রীপুর উপজেলার রাধানগর গ্রামের ৮০ বছরের বৃদ্ধা জিরেমতী আজ দুই চোখ ভরে দেখতে পাচ্ছেন। তিন বছর তিনি অন্ধ ছিলেন। নারায়ণগঞ্জের ফতুল্লা থানার ধর্মগঞ্জ গ্রামের ৬৫ বছরের বৃদ্ধা হালিমা খাতুনও তিন বছর অন্ধ ছিলেন। বিনামূল্যে তার চোখের ছানি অপারেশন করা হয় কেরানীগঞ্জে বসুন্ধরা-আদ-দ্বীন হাসপাতালে। হালিমার ছেলে রিয়াদ হোসেন বললেন, ‘আমার মা আগে কিছুই দেখতে পেতেন না। দৃষ্টিশক্তি ফিরে পেয়ে এখন নিজেই সবকিছু করছেন।’ যশোর সদর উপজেলার ভাতুড়িয়া গ্রামের ৭০ বছরের বৃদ্ধ মোকাম বিশ্বাস। যশোর আদ-দ্বীন হাসপাতালে তার চোখের ছানি অপারেশন করা হয়। বললেন, ‘চার-পাঁচ বছর কিছুই দেখতে পাইনি। একরকম মেনেই নিয়েছিলাম অন্ধ হয়েই বাকি জীবন কাটাতে হবে। আদ-দ্বীন বিনা টাকায় আমার অপারেশন করেছে। আমি এখন দেখতে পাচ্ছি, এর চেয়ে আনন্দের আর কী হতে পারে!’

আদ-দ্বীন হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ জানায়, এভাবে গত এক যুগে তারা বিনামূল্যে প্রায় ৫০ হাজার নারী-পুরুষের দৃষ্টিশক্তি ফেরাতে সহায়তা করেছে। আদ-দ্বীন হাসপাতালের উপপরিচালক চক্ষু বিশেষজ্ঞ মিনহাজুর রহমান বলেন, ‘গ্রামের অসচেতন গরিব মানুষ চোখে ছানি নিয়ে বাড়ির উঠানে বসে থাকছেন। আমরা গ্রামে গ্রামে ক্যাম্প করে তাদের হাসপাতালে এনে অপারেশন করছি। মাত্র ১০ মিনিটের ছানি অপারেশনে তারা দৃষ্টিশক্তি ফিরে পাচ্ছেন।’ আদ-দ্বীন হাসপাতালের সিনিয়র ম্যানেজার রবিউল হক জানান, ‘আগামী পাঁচ বছরে সংস্থাটির পক্ষ থেকে বিনামূল্যে ১ লাখ মানুষের চোখের ছানি অপারেশন করার লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে।’ আদ-দ্বীনের নির্বাহী পরিচালক ডা. শেখ মহিউদ্দিন বলেন, ‘সামাজিক দায়বদ্ধতা থেকেই আমরা দরিদ্র মানুষকে অন্ধত্বের অভিশাপ থেকে মুক্তি দেওয়ার জন্য কাজ করে চলেছি। চোখে ছানি পড়ার কারণে অন্ধ হয়ে যাওয়া নারী-পুরুষকে তাদের দৃষ্টিশক্তি ফিরিয়ে দিয়ে আবারও কর্মক্ষম করে তুলছি। আমাদের এ প্রচেষ্টা অব্যাহত থাকবে।’ এর ফলে নিকট ভবিষ্যতে এ অঞ্চলে ছানির কারণে দৃষ্টিহীন কোনো মানুষ থাকবে না বলে তিনি আশা প্রকাশ করেন।

সর্বশেষ খবর