শুক্রবার, ২৮ জুলাই, ২০১৭ ০০:০০ টা

পাটকাঠির কার্বন যাচ্ছে বিদেশে

সামছুজ্জামান শাহীন, খুলনা

পাটকাঠির কার্বন যাচ্ছে বিদেশে

পাটকাঠি বা পাটখড়ি এখন আর ফেলনা নয়। পাট দিয়ে চট, বস্তা, কাপড়, কার্পেট তৈরি হলেও পাটকাঠি এতদিন গ্রামে জ্বালানি ও ঘরের বেড়া দেওয়ার কাজেই ব্যবহার হতো। কিন্তু সেই পাটকাঠির ছাই এখন কার্বন তৈরির অন্যতম উপকরণ। তাই এ দেশ থেকে পাটকাঠির ছাই কিনে নিচ্ছে চীন, তাইওয়ান, ব্রাজিলসহ আরও কয়েকটি দেশ। সেখানে মোবাইলের ব্যাটারি, কার্বন পেপার, ফটোকপির কালি, আঁতশবাজি ও প্রসাধনী তৈরিতে কাঁচামাল হিসেবে এটি কাজে লাগছে। বিদেশে পাটকাঠি ছাইয়ের চাহিদা দিন দিন বাড়ছে। পাশাপাশি এর ওপর ভিত্তি করে দেশে তৈরি হয়েছে বিকল্প কর্মসংস্থান ও রাজস্ব আয়ের নতুন ক্ষেত্র।

পাটকাঠি পুড়িয়ে ছাই উৎপাদনের জন্য খুলনার রূপসা উপজেলার তিলকে গড়ে উঠেছে মিমকো কার্বন কোম্পানি। প্রায় ১০ একর জমির ওপর প্রতিষ্ঠানটির এলাকায় ‘কার্বন কোম্পানি’ নামে পরিচিতি পেয়েছে। ২০১৩ সালে প্রতিষ্ঠানটির স্বত্বাধিকারী ইউসুফ মোল্লা যৌথ উদ্যোগে খুলনা ও ফরিদপুরে এই কোম্পানি চালু করেন। খুলনায় প্রতিষ্ঠানটির ভিতরে ঢুকলেই চোখে পড়ে বিশাল বিশাল কয়েকটি চুল্লি। রয়েছে উঁচু পাইপের মাধ্যমে ধোয়া নির্গমনের ব্যবস্থা। প্রায় ২৫-৩০ জন কর্মচারী এখানে পাটকাঠি পুড়িয়ে ছাই তৈরি করছেন।

ফ্যাক্টরি ইনচার্জ রেজাউল ইসলাম বাংলাদেশ প্রতিদিনকে জানান, কারখানার বিশাল এসব চুল্লিতে পাটকাঠি পুড়িয়ে ছাই করা হয়। প্রতিদিন গড়ে ৫ থেকে ৮ টন পাটকাঠি এখানে পোড়ানো হয়। এই পরিমাণ পাটকাঠি থেকে ছাই পাওয়া যায় আড়াই টনের মতো। দুই সপ্তাহের উৎপাদিত ছাই একত্রে জাহাজে করে পাঠানো হয় চীনে। তিনি জানান, চায়নার আল-হুইলো লিন নামের কোম্পানি সরাসরি এই উৎপাদন ব্যবস্থা পরিচালনা করছে। যেভাবে কার্বন তৈরি করা হয় : পাটখড়ি বা পাটকাঠির ছাই চারকোল নামেও পরিচিত। পাটকাঠিকে ছাই বানিয়ে সর্বপ্রথম তা রপ্তানির পথ দেখান ওয়াং ফেই নামের চীনের এক নাগরিক। তিনি বাংলাদেশে এ ধরনের ছাই উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে জড়িত ছিলেন। তার দেখাদেখি দেশের বিভিন্ন স্থানে আরও কয়েকটি প্রতিষ্ঠান গড়ে ওঠে। খুলনার মিমকো কার্বন কোম্পানিতে কর্মরত শ্রমিকরা জানান, প্রায় ১৫ ফুট উঁচু চুল্লির ওপর দিক থেকে পাটকাঠি ঢোকানো হয়। তারপর চুল্লির ভিতরে আগুনে পোড়ানো হয় পাটখড়ি। পরে তা মেশিনের মাধ্যমে মিহি করে ছাই তৈরি করা হয়। ধোঁয়া বের করার জন্য সবগুলো চুল্লির সঙ্গে সংযুক্ত উঁচু পাইপের চিমনি রয়েছে। পাইপের মধ্য দিয়ে ধোঁয়া বের হওয়ার আগে পানির প্রবাহ তৈরি করে বিশেষ পদ্ধতিতে দূষণের মাত্রা কমানো হয়। শীতকাল ও শুষ্ক মৌসুমে (ফেব্রুয়ারি-এপ্রিল) সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত চলে পাটকাঠি পোড়ানোর কাজ।

পাটকাঠি সংগ্রহ ও বিকল্প কর্মসংস্থান : সাধারণত ফরিদপুর, গোপালগঞ্জ ও মাগুরা থেকে পাটকাঠি সংগ্রহ করা হয়। মৌসুমে প্রতি মণ পাটকাঠি কিনতে হয় ১৮০-২০০ টাকা দরে। আর যখন মৌসুম থাকে না, তখন দাম পড়ে ২৫০ থেকে ৩০০ টাকা। গোপালগঞ্জের পাটকাঠি বিক্রেতা তরুণ বিষ্ণু (৪৫) জানান, আগে পাটকাঠির সঙ্গে গোবর মাখিয়ে ঘুটে (জ্বালানি) বানানো হতো। এই ঘুটে শহরের বাসাবাড়িতে বিক্রি হতো। কিন্তু এখন গ্রামের মানুষজন পাঠকাঠি সংগ্রহ করে তা কার্বন কোম্পানিতে বিক্রি করেন। এতে লাভ বেশি। এ কাজে পরিবার-পরিজন নিয়ে দু’মুঠো ভাতের ব্যবস্থা হয়েছে। জানা গেছে, খুলনার এই কারখানায় তিন জেলার প্রায় অর্ধশত পাটকাটি বিক্রেতা রয়েছেন। তাদের কাছ থেকে পূর্বনির্ধারিত দরে পাটকাঠি কেনা হয়। তারা গ্রামে ঘুরে ঘুরে পাটকাঠি সংগ্রহ করেন। এ ছাড়া কারখানায় দৈনিক মজুরিতে শ্রমিক ও মাসিক চুক্তিতে কর্মচারী মিলিয়ে অনেকের কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা হয়েছে।

রপ্তানিতে সম্ভাবনা : খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি ডিসিপ্লিনের প্রধান ড. শাহনেওয়াজ নাজিমুদ্দিন আহমেদ জানান, ‘গ্রিন ইন্ডাস্ট্রি’ আখ্যা দিয়ে পাটকাঠির ছাই উৎপাদন ও রপ্তানি বৃদ্ধিতে সরকার ইতিবাচক। তিনি বলেন, দেশে বছরে ৩০ লাখ টন পাটকাঠি উৎপাদিত হয়। এর মাত্র ৫০ শতাংশকেও যদি ছাই করা যায়, তাহলে বছরে উৎপাদন দাঁড়াবে প্রায় ২ লাখ ৫০ হাজার টন। এক টন ছাইয়ের দাম ১ হাজার থেকে ১ হাজার ২০০ ডলার। সে হিসাবে বছরে এ খাতে রপ্তানি আয়ের সম্ভাবনা রয়েছে ৩১ কোটি ২৫ লাখ ডলার। আর সরকার এ খাত থেকে বছরে রাজস্ব পাবে ৪০ কোটি টাকা। এ ছাড়া প্রত্যক্ষভাবে ২০ হাজার ও পরোক্ষভাবে ২০ লাখ লোকের কর্মসংস্থান হবে এ খাত থেকে।

নানামুখী সংকট : অর্থনীতিবিদদের মতে, বিদেশে ছাইয়ের ভালো চাহিদা রয়েছে এবং সহজেই আন্তর্জাতিক বাজার ধরা যাবে। এ কারখানায় বিদ্যুৎ বেশি লাগে না, কারখানা স্থাপনে বিনিয়োগের পরিমাণও খুব বেশি নয়। তা ছাড়া কাঁচামাল পাওয়া যায় সহজেই। তবে খুলনায় কার্বন কোম্পানি চালুর পর থেকে পরিবেশ দূষণের দাবি করে প্রতিষ্ঠানটি বন্ধের জন্য বন ও পরিবেশ মন্ত্রণালয়ে চিঠি দেওয়া হয়। এই কোম্পানির পরিবেশগত ছাড়পত্র দেওয়ার ক্ষেত্রে কনসালটেন্ট হিসেবে ছিলেন খুলনা প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক তরিকুল ইসলাম। পরিবেশ অধিদফতর খুলনার পরিচালক হাবিবুল হক খান জানান, এই কোম্পানিকে ঢাকা থেকে পরিবেশগত ছাড়পত্র দেওয়া হয়েছে। তবে পরিবেশ দূষণের অভিযোগের সত্যতা মেলেনি। বাংলাদেশ চারকোল উৎপাদক ও রপ্তানিকারক সমিতি (প্রস্তাবিত) সূত্রে জানা গেছে, এ খাত থেকে বছরে ১৫০ কোটি টাকা বৈদেশিক মুদ্রা অর্জন করা সম্ভব। সম্প্রতি বাংলাদেশ বিনিয়োগ উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ আয়োজিত বিভাগীয় বিনিয়োগ সম্মেলনে খুলনা বিভাগীয় কমিশনার আবদুস সামাদ বলেন, সামান্য পাটকাঠির ছাইও এখন আর ফেলনা নয়। পাটকাঠির ছাই বিদেশে রপ্তানি হওয়ায় দেশের কৃষি খাত অর্থনৈতিকভাবে সমৃদ্ধ হবে। মানুষ পাটচাষে আরও আগ্রহী হবেন।

এই বিভাগের আরও খবর

সর্বশেষ খবর