বুধবার, ৯ আগস্ট, ২০১৭ ০০:০০ টা
বেনাপোল-পেট্রাপোল সীমান্ত

সোনা চোরাচালানের রমরমা ব্যবসা

দীপক দেবনাথ, কলকাতা

ভারত-বাংলাদেশ আন্তর্জাতিক সীমান্ত বরাবর পাচারকারীদের অন্যতম লোভনীয় পণ্য হয়ে দাঁড়িয়েছে সোনা। এ কথা স্বীকার করে নিয়েছে সীমান্ত রক্ষার দায়িত্বে থাকা বিভিন্ন নিরাপত্তা এজেন্সিও। ডিরেক্টরেট অব রেভিনিউ ইনটেলিজেন্স (ডিআরআই)-এর এক কর্মকর্তা জানান, ‘কেন্দ্রীয় সরকারের নোট বাতিলের ঘোষণার পর পরই সোনা পাচারের ক্ষেত্রে ভাটা পড়েছিল। কিন্তু গত তিন-চার মাস ধরে অবস্থার পরিবর্তন হয়েছে। চোরাকারবারিদের হাতে নতুন নোটের জোগান আসায় তারা ফের সক্রিয় হয়ে উঠেছে। যেটা সোনা পাচারের কাজে লাগানো হচ্ছে। জানা গেছে চোরাপথে ভারতে যে সোনা ঢোকে তা আসে দুবাই থেকে বাংলাদেশ হয়ে। পদ্মাপাড়ের এই দেশটি থেকে সীমান্ত পার হয়ে কলকাতায় ঢুকে তা চলে যায় সোজা বউবাজার এবং বড়বাজারের সোনাপট্টিতে। সেখানে সোনার বিস্কুট বা সোনার বাঁটগুলোকে গহনায় পরিণত করে তা ছড়িয়ে দেওয়া হয় বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তে। কিছু সোনা আবার দেশেই সংরক্ষিত করে রেখে দেওয়া হয় কালো রুপির হাত থেকে বাঁচতে। সংশ্লিষ্ট অভিজ্ঞমহলের মতে, ভারতে সোনা প্রচুর চাহিদা রয়েছে এবং বাংলাদেশ থেকে ভারতে সোনা পাচারের পেছনে রয়েছে মূলত প্রচুর অর্থের হাতছানি। সোনা পাচারকারীদের কাছে লাভের অঙ্কটাও নেহাত কম নয়। এক পরিসংখ্যানে দেখা গেছে দুবাই আন্তর্জাতিক সোনা বাজারে প্রতি ১০ গ্রাম সোনার দাম আনুমানিক ২৬ হাজার রুপির কাছাকাছি। ভারতের বাণিজ্য নগরী মুম্বাইয়ে এর মূল্য ২৯ হাজারের মতো। অর্থাৎ পার্থক্যটা ৩ হাজার রুপি এবং এক কেজি সোনার ক্ষেত্রে পার্থক্য দাঁড়ায় ৩ লাখ রুপি। যা  সোনা পাচারকারীদের কাছে খুবই লোভনীয়। এমনকি কোনো পাচারকারী যদি সোনা বহনকারীদের পেছনে ২৫-৩০ হাজার রুপি এবং বিমানের খরচও বহন করে তবে সেক্ষেত্রেও পাচারকারীর প্রতি কেজি সোনায় দেড় থেকে ২ লাখ রুপি মুনাফা হয়। বাংলাদেশ নিরাপত্তা এজেন্সিগুলোও জানাচ্ছে গবাদি পশু পাচারকারীদের একটা বড় অংশ সাম্প্রতিক সোনা পাচারের সঙ্গে যুক্ত হয়েছে। নিজেদের আটকের হাত থেকে বাঁচাতেই তারা এই পথ নিয়েছে। গবাদিপশুর তুলনায় সোনা পাচার অনেকটাই সহজ। এক্ষেত্রে জুতার তলায়, মিষ্টির প্যাকেট, মোবাইল ফোন কিংবা স্যুটকেসের মধ্যে করে সোনা পাচার হচ্ছে এবং মূলত শিশু ও বয়স্ক মানুষদের এই পাচারের কাজে ব্যবহার করা হচ্ছে। পাচারের সময় কিছু কিছু ক্ষেত্রে পাচারকারীরা ধরা পড়লেও একটা বড় অংশই ধরা ছোঁয়ার বাইরে থেকে যাচ্ছে। বিএসএফ সূত্রে খবর চলতি বছরের জুলাই পর্যন্ত বিএসএফ দক্ষিণবঙ্গ ফ্রন্টিয়ার ২৭.৭৩৮ কেজি সোনা আটক করেছে। যার আনুমানিক মূল্য ৮ কোটি রুপিরও বেশি। আটক করা হয়েছে ৯  সোনা পাচারকারীকেও। শেষবার গত ২০ জুলাই উত্তর চব্বিশ পরগনা জেলার স্বরূপনগরের হাকিমপুরে অবস্থিত বিএসএফের ৭৬ নম্বর ব্যাটালিয়নের বিওপির কাছ থেকে নির্দিষ্ট তথ্যের ভিত্তিতে বাংলাদেশ থেকে ভারতে প্রবেশের মুখেই একজনকে চ্যালেঞ্জ করে ৭ কেজি ওজনের সোনার বিস্কুট উদ্ধার করা হয়। যদিও সেই পাচারকারীকে আটক করা সম্ভব হয়নি। পরিসংখ্যান বলছে প্রতিদিন গড়ে প্রায় পাঁচ হাজার বাংলাদেশি নাগরিক বেনাপোল-পেট্রাপোল সীমান্ত দিয়ে ভারতে প্রবেশ করেন। আর সোনা পাচারের ক্ষেত্রে এই স্থলপথকেই বেছে নিয়েছে পাচারকারী চক্র কারণ জলপথ কিংবা আকাশপথের চেয়ে স্থলপথ তুলনামূলকভাবে অনেক বেশি নিরাপদ। তবে বেনাপোল-পেট্রাপোল স্থলবন্দর ছাড়াও পশ্চিমবঙ্গের উত্তরচব্বিশ পরগনা, নদীয়া, কোচবিহার জেলার বেশ কিছু সীমান্ত দিয়ে দীর্ঘদিন ধরেই  সোনা পাচার হয়ে আসছে বলে অভিযোগ। সেক্ষেত্রে নিরাপত্তা বাহিনীর নজরদারির অভাবের সুযোগ নিয়ে থাকে পাচারকারীরা। আবার কিছু কিছু ক্ষেত্রে এই পাচারের সঙ্গে বিএসএফের যোগসাজশেরও অভিযোগ রয়েছে। বিএসএফের আইজি (দক্ষিণবঙ্গ) পিএসআর অঞ্জনেউলু জানান,  ‘চোরাকারবারিদের বেশিরভাগই সোনা পাচারের সঙ্গে যুক্ত হয়েছে বলে মনে করা হচ্ছে’। তিনি আরও জানান, ‘গত বছর ১৪ কেজি সোনা আটক করা হয়েছিল। চলতি বছরে এখনো পর্যন্ত বিএসএফ ২৭ কেজি সোনা আটক করেছে। চলতি বছরের সবেমাত্র আট মাস চলছে। আমার মনে হয় এটা হিমশৈলের একটি চূড়া মাত্র। স্থানীয় কাস্টমস, পুলিশ এবং বাংলাদেশ কাস্টমসকে এই অভিযানে রাখলে আমি নিশ্চিত যে, বছরের শেষে এই পাচারকৃত সোনার পরিমাণ গিয়ে দাঁড়াবে ৬০-৭০  কেজি’। বিএসএফ সূত্রে খবর, বেনাপোল-পেট্রাপোল সীমান্তের যে পয়েন্ট দিয়ে মূলত সোনা পাচার হয়ে থাকে সেসব জায়গা ইতিমধ্যেই সিল করে দেওয়া হয়েছে। পাশাপাশি নো-ম্যানস ল্যান্ডে বিএসএফের নজরদারি বাড়ানো হয়েছে। সেইসঙ্গে দুই দেশের আন্তর্জাতিক সীমান্ত বরাবর যে গ্রামগুলো রয়েছে সেখানেও কড়া নজরদারি চালানো হচ্ছে।

সর্বশেষ খবর